ঢাকা: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) মেঝেতে বসে আছেন সাফিয়া বেগম। হুইল চেয়ারে বসে থাকা মেয়ের কঙ্কালসার ক্ষত-বিক্ষত ১০ বছরের দেহটাকে দেখে আবারও গুমরে কান্না আসে মায়ের।
ডাকের উত্তর দেওয়ার শক্তি নেই ডাস্টবিন থেকে হাসপাতালের বেডে ওঠা আদুরীর। সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। শরীরে এখন শুধু হাড়টুকু অবশিষ্ট। মাথায়, পিঠে রয়েছে নির্মম আঘাতের ক্ষত।
রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট বেড়িবাঁধ এলাকায় ডাস্টবিনের পাশ থেকে গত সোমবার শিশুটিকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধারের পর তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক ) হাসপাতালে।
শনিবার দুপুরে ঢামেকে গিয়ে দেখা যায়, দগদগে ক্ষত ছাড়া এক ইঞ্চি জায়গাও নেই আদুরীর শরীরে। ঠোঁটে এখনো কাটা ক্ষত, ব্লেডের কাটাকুটি পুরো শরীরের এখানে-সেখানে।
আদুরীর মা সাফিয়া বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রায় এক বছর আগে স্থানীয় ঠিকাদার চুন্নু মিয়ার কথায় মেয়েকে কাজে পাঠান তিনি। চুন্নু মিয়া কথা দিয়েছিলেন, নিজের শিশু সন্তানদের সঙ্গে খেলে সময় কাটাবে আদুরী। আর টুকটাক ঘরের কাজ করবে। মাসে ৫০০ টাকা করে দেওয়া হবে। ’
অভাবের তাড়নায় স্বামীহারা নয় সন্তানের জননী সাফিয়া বেগম রাজি হয়ে যান চুন্নুর কথায়। তবে মাস না ঘুরতেই আদুরীকে চুন্নু মিয়া তার শ্বশুরের বাসায় কাজে লাগিয়ে দেন। এরপর আবারও পৃথিবী বদলায় আদুরীর। মাস চারেক আগে ওই বাসা থেকে আবারও সে বদলি হয় চুন্নুর শালা-বৌয়ের বাসায়।
আদুরীর চাচা আব্দুল খালেক বাংলানিউজকে বলেন, ‘আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত আদুরীর জ্ঞান ফেরে গত বুধবার। প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বারান্দায় রাখা হয়েছিল। ’
আদুরীকে উদ্ধার করেন ক্যান্টনমেন্ট থানার সহকারী উপপরির্দশক (এএসআই) আব্দুল মান্নান।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘গত সোমবার সন্ধ্যায় আদুরীকে বারিধারা ও ডিওএইচএস তেলের ডিপোর মাঝামাঝি রেল লাইন সংলগ্ন একটি ডাস্টবিনের পাশ থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে পোড়া ও নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে। এরপর কঙ্কালসার মেয়েটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ’
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে মেয়েটির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। বর্তমানে তার উঠে দাঁড়ানোর কোনো ক্ষমতা নেই। পাশাপাশি মানসিকভাবেও সে চরম অসুস্থ। পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে আদুরী সপ্তম।
ওসিসি জুড়ে এখন আদুরীর আত্মীয়-স্বজন। গরিব এ স্বজনদের অনেকের মলিন, ছেঁড়া কাপড় দেখে অনেক সময়ই ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছেন ওসিসির দারোয়ান।
আদুরীদের বাড়ি পটুয়াখালীর জিয়রকাটি গ্রামে।
আদুরীর বাবা আবুল খালেক মৃধা মারা গেছেন চার বছর আগে। বড় ছেলে সোহেল, দ্বিতীয় ছেলে সোহাগ নদীতে মাছ ধরে। মূলত তাদের অর্থেই চলে সাফিয়া বেগমের সংসার।
বোনের নির্যাতনের খবর ভাবায় না আট বছরের শান্তাকে আর সাত বছরের ভাই পান্নাকে। সাফিয়া বেগমের আশপাশ ঘিরে থাকে এরা। পান্না বলে- মা ক্ষুধা লাগছে। কিছুই বলেন না সাফিয়া বেগম।
বড় বোন তানিয়া নিজেও মধ্য বাড্ডায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। তার স্বামী একটি ভাঙরি দোকানে কাজ করেন।
আদুরী অনেকদিন অভুক্ত অবস্থায় ছিল। পাঁজরের হাড়গুলো বের হয়ে এসেছে। নির্যাতনে মাথায় খাবলা খাবলা দিয়ে উঠে গেছে চুল।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচালক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘আদুরীকে যেদিন নিয়ে আসা হয়েছিল, সে মৃত্যুর মুখোমুখি ছিল। এখন নিজে নড়তে পারছে। ওয়ার্ড থেকে ওসিসিতে ট্রান্সফার করা হয়েছে তাকে।
তিনি বলেন, ‘শিশুটির দীর্ঘদিন ধরে খাবার বন্ধ ছিল। এর ফলে শরীরে প্রোটিন ও ক্যালরির অভাবে ধীরে ধীরে ম্যারাসমজ হয়ে ওঠে। হাড্ডির সঙ্গে চামড়া লেগে যেতে থাকে। আরো বেশি অপুষ্টি থেকে বোন বার্ন শুরু হয়। ’
পাঁচ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড আদুরীর চিকিৎসায় নজর রাখছেন এবং মেয়েটি পুরো সুস্থ হয়ে ওঠা পর্যন্ত সব সেবা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
দরিদ্র এই পরিবার ও মেয়েটির পাশে বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে, শনিবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ আদুরীকে দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মামলাটি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে দ্রুত আইনে বিচার হবে। ’
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা যেন আর না হয়, সে জন্য পৃথক আইন হওয়া প্রয়োজন। এতে গৃহকর্মীদের কর্মঘণ্টা ও বেতনসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার কথা থাকবে। ’
উল্লেখ্য, এরই মধ্যে পল্লবীর নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার হয়েছেন আদুরির গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদী।
এ ঘটনায় নজরুল ইসলাম চৌধুরী বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার পল্লবী থানায় নদী, তার স্বামী সাইফুল ইসলাম মাসুদ, মাসুদের দুলাভাই চুন্নু মীর ও তাদের আত্মীয় রনিসহ চারজনকে আসামি করে মামলা করেন।
নদীকে শুক্রবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে হাজির করা হলে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৩
এমএন/এবি/জিসিপি