ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রধানমন্ত্রী কি আদুরীর কপালেও স্নেহের চুম্বন আঁকবেন?

জিনিয়া জাহিদ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৩
প্রধানমন্ত্রী কি আদুরীর কপালেও স্নেহের চুম্বন আঁকবেন?

কঙ্কালের মতো ভাগাড়ে পড়ে ছিল আদুরী নামের হাড্ডিসার একটি শিশু। মহানুভব পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে উদ্ধার হয়ে ছোট্ট শিশুটির ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালে।

জানা যায়, ১১ বছরের ছোট্ট মেয়েটি ছিল একজন গৃহকর্মী। বেতন ছিল মাসে ৫০০ টাকা। সঙ্গে থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত।

মাত্র ৫০০ টাকায় ৯ বছরের একটি শিশু ২৪ ঘণ্টার শ্রম বিক্রি করেছিলো নওরীন নদী নামক এক গৃহকর্ত্রীর বাসায়। দুই বছর ধরে আদুরী সেখানে কাজ করছিলো। বিনিময়ে দু’বেলা ভাত তো দূরের কথা, স্বাস্থ্যবান গৃহকর্মীর অসহনীয় অত্যাচার ছিল তার নিত্যদিনের প্রাপ্তি।
 
জানিনা কি এমন গুরুতর অপরাধ করতে পারে ওই ছোট্ট শিশুটি, যে শাস্তি হিসেবে ব্লেড দিয়ে চিরে দেওয়া হয়েছিলো তার নিষ্পাপ মুখ। গরম খুন্তি দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো ওর বাড়ন্ত বয়সের অপুষ্ট শরীর। না খেয়ে খেয়ে এতই দুর্বল হয়েছিলো যে, ভাগাড়ের পাশে পড়ে থেকেও নড়ার মতো তার শক্তি ছিল না। লাশ ভেবে ওর ক্ষত বিক্ষত শরীরের উপর ভন ভন করা ওর থেকেও স্বাস্থ্যবান ডুমো নীল মাছিগুলো তাড়ানোর মতো শক্তিটুকুও নিঃশেষ করে নিয়েছিলো ৫০০ টাকায় কিনে নেওয়া পাষণ্ড গৃহকর্ত্রী।
Aduri-01
আদুরী কিংবা আদুরীর মতো সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার কি আদৌ এদেশে আছে? যদি থেকে থাকে তবে আদুরীদের অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে শপথ নেওয়া সেসব মন্ত্রীরা এখন কোথায়?
 
জানি সমস্যাসংকুল এই দেশে সবার ঘরে ঘরে গিয়ে অধিকার রক্ষা হচ্ছে কি না জানা কখনই সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে আদুরীরা যখন দেশের উন্নয়নের চিত্রটি নগ্নভাবে জনসম্মুখে প্রকাশ করে, তখন জানতে ইচ্ছে করে আমাদের জনগণের কষ্টার্জিত টাকায় শপথ নেওয়া এসব মন্ত্রীরা আসলে করেন কি?
 
বাংলাদেশে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় আছে। মেহের আফরোজ চুমকি নামক একজন জনপ্রতিনিধি সেই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়েছিলেন বলে জেনেছি।
Aduri
এ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গেলে মহিলা ও শিশুদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে অনেক সুন্দর সুন্দর কথার ফুলঝুরি দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবায়ন কি আদৌ হয়? পোশাকশিল্পের নারীদের স্বার্থ রক্ষায় তাদের এগিয়ে আসতে দেখি না। আদুরী নামক শিশুদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রেও তারা নিশ্চুপ। সবিনয়ে জানতে চাই, মাননীয় প্রতিমন্ত্রী কি ছোট্ট এই কন্যা শিশুটির মৌলিক অধিকার রক্ষায় কোনো ভূমিকা পালন করবেন?
 
শ্রম মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী রাজু উদ্দিন আহমেদ রাজু ও প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান কি আদুরী নামক শিশুটির শ্রম বিক্রির ন্যায্য অধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসবেন? এভাবে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে আদুরীর মতো শিশুরা নাম মাত্র টাকায় ২৪ ঘণ্টা শ্রম দিয়ে ঠিকমতো খেতে পর্যন্ত পারে না, তাদের অধিকার রক্ষায় মন্ত্রীমহোদয়ের কি কিছুই করণীয় নেই?

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কাছে জানতে চাই আদুরী নামক মেয়েটির শিক্ষার দায়িত্ব কি তার মন্ত্রণালয়ের নয়? আদুরী সুস্থ হয়ে যাতে স্কুলে যেতে পারে, তিনি কি তার নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারেন না?
 
পত্রিকা পড়ে জানতে পেরেছি আদুরীর পরিবার এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আদুরী ও তার পরিবারের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া কি স্বরাস্ট্রমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নয়? যদি হয়ে থাকে তবে মাননীয় মন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের কাছে জানতে চাই আদুরীদের উপর অত্যাচারের বিচার চেয়ে উল্টা অপরাধীদের ভয়ে থাকতে হবে কেন? কবে আদুরীরা নিশ্চিত হয়ে শ্বাস নিতে পারবে? অপরাধ করে শাস্তি পাওয়া তো দূরের কথা, অপরাধীরা উল্টা ভিকটিমকে হুমকি-ধামকি দেওয়ার এই কালচার বন্ধ হবে কবে?    
 
ঐশীর মতো বখাটে ইয়াবাখোর খুনির অধিকার রক্ষায় সোচ্চার বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশন। একই সঙ্গে কিছু মানবাধিকার সংস্থার সুশীল-গণ্যমান্যরাই বা এখন কোথায়? আদুরীরা কি মানুষ নয়? নাকি ওদের মতো মানুষের কোনো অধিকার নেই? আদুরীর অধিকার রক্ষায় কেন তারা নিশ্চুপ?
 Aduri-01
আর সবার কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। দেশের সবার অধিকার রক্ষায় শপথ নিয়েছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। জাতিসংঘে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য যখন তিনি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন ভাগাড়ে লাশের মতোই পড়ে ছিল আদুরী। মালালার মতো  কপালে যখন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্নেহের চুম্বন এঁকে দেন, তখন দেশে মালালার মতোই কিংবা তার থেকেও বেশি সম্ভাবনাময়ী আদুরীরা শিক্ষাবঞ্চিত হয়ে, শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়ে মৃত্যু পথযাত্রী হয়!
 
মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা হয়তো দেশোদ্ধারের গুরুতর কাজে ব্যস্ত; মানবাধিকার কমিশন হয়তো পত্রিকায় কলাম লেখা কিংবা টক-শোতে কি বলবেন এই নিয়ে ভাবনা-চিন্তায় আদুরীর দিকে তাকানোর সময় পাচ্ছে না। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি কি জাতিসংঘের সম্মেলন শেষে একটিবারের জন্য যাবেন হতভাগ্য মেয়েটির কাছে? আপনি কি দিতে পারেন না মালালার মতো আদুরীর কপালেও একটি স্নেহের চুম্বন?

zinia-zahid

জিনিয়া জাহিদ:
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

 

   বাংলাদেশ সময়: ১০১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৩/আপডেট ১২০০ ঘণ্টা
এএ/জেডএম/আরআইএস/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।