বাংলাদেশ গার্মেন্ট শিল্পে রাহুর দশা কাটছেই না। গত এপ্রিলে সাভারের রানাপ্লাজায় ভবনধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের নির্মম মৃত্যু এবং গত বছর তাজরীন ফ্যাশনসে দেশের স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বাংলাদেশের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোকে শ্রমিকদের মৃত্যুকূপ হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি দিয়েছে।
পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার এবং বিশ্ব মিডিয়ায় এসবের ফলাও প্রচার কয়েক দশকে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এরই মধ্যে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ, এবং শতশত কারখানা বন্ধ থাকার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি দেশের গার্মেন্টস শিল্পের ইমেজসংকটকে তীব্রতর করেছে।
গার্মেন্ট কারখানায় ভবনধস/অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিকের মৃত্যু, শ্রমিক অসন্তোষের জের ধরে ভাংচুর, শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ, শ্রমিক নেতা গুম বাংলাদেশে এমন গতানুগতিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে যে, এর পরবর্তী ছঁকবাধা পদক্ষেপগুলো আমাদের সকলেরই জানা - নাশকতার ষড়যন্ত্র খোঁজা, সংশ্লিষ্ট কারখানাকে বিজিএমইর রেজিস্ট্রেশনের বহির্ভূত হিসেবে প্রমাণিত করার চেষ্টা এবং তদন্ত সাপেক্ষে দায়ীদের যথাযথ শাস্তির মুখোমুখি করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া।
দুর্ঘটনাগুলো ঘটার পরপর পত্রিকাগুলোতে অনেক সম্পাদকীয়ও লেখা হয়, যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উঠে আসে, দায়ীদের কঠোর শাস্তি দাবি করা হয় এবং বিভিন্ন নীতিমালা তৈরির সুপারিশ করা হয়, তবে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর থামে না। সুপারিশগুলো যৌক্তিক হলেও গার্মেন্ট শিল্পের স্বকীয় অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয় না, নীতিমালা তৈরি করলেও তার প্রতিপালন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।
গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিকদের কর্ম-পরিবেশের উন্নতি, নায্য বেতন প্রতিষ্ঠা করা, ফায়ার কোড ও অন্যান্য নিরাপত্তা বিষয়ক নীতিমালা অনুসরণ নিশ্চিত করতে হলে গার্মেন্টস মালিক ও সরকারী নীতিনির্ধারকদের সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত পরিকল্পনা (strategic plan) নিতে হবে। এ পরিকল্পনা হতে হবে অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে – আবেগ বা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নেয়া সুপারিশ/পদক্ষেপ ফ্যাক্টরি মালিকদের অর্থনৈতিক স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক হলে সেসবের বাস্তবায়নের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।
দেশের বর্তমান রপ্তানি আয়ের শতকরা ৮০ ভাগই আসে তৈরি পোশাক শিল্পখাত থেকে। গত কয়েক দশকে গার্মেন্ট শিল্পের এ অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে আমাদের দেশের সস্তা শ্রম। বাস্তবতা হচ্ছে সস্তা শ্রম একটি নিছক ‘তুলনামূলক সুবিধা’ (comparative advantage) যা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তৈরি পোশাকের ইতিহাস থেকে আমরা জানি, যে দেশেই যখন শ্রম সস্তা ছিল, সেখানেই তৈরি পোশাক শিল্প গিয়েছে।
যুক্তরাজ্য থেকে শুরু করে, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মত দেশগুলো একসময়ে এ শিল্পের উপরে নির্ভরশীল ছিল। সময়ের সাথে সাথে যখন শ্রমের মূল্য বেড়ে যায়, পোশাক শিল্প তার পরবর্তী গন্তব্য খোঁজে।
তাই তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বাংলাদেশ বর্তমানে বেশ আকর্ষণীয় হলেও যথাযথ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা না নিলে বিশ্ববাজারে এই অবস্থা ভবিষ্যতে ধরে রাখা যাবে না। গত কয়েক দশকে আমাদের জিডিপি যেভাবে ৬-৭% হারে বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এই হার অব্যাহত থাকলে সেই দিনটি খুব বেশি দূরে নেই যেদিন আমাদের দেশের শ্রমের মূল্য গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। তাই এই শিল্পে বিশ্বে আমাদের অবস্থান ধরে রাখতে হলে এখন থেকেই শুধু সস্তা শ্রমের প্রতি নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিকল্প প্রতিদ্বন্ধিতামূলক সুবিধা (competitive advantage) তৈরি করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নিতে হবে।
তৈরি পোশাক শিল্পের স্বকীয় কিছু অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার কারণে মুনাফা বৃদ্ধির জন্য কারখানার মালিকদের খুব বেশি বিকল্প থাকে না। প্রথমত, এই শিল্পের ক্রেতারা অত্যন্ত দাপুটে – পণ্যের ডেভলপমেন্ট থেকে শুরু করে, এতে কি ধরনের কাপড়/বোতাম/জিপার/সুতা, এমনকি কি ধরনের প্যাকেজিং উপকরণ ব্যবহার করা হবে সেটিও নির্ধারণ করে দেয় ক্রেতারাই। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের শতাধিক দেশের হাজার হাজার কারখানা আছে যাদের মধ্যে গুণগত মানের খুব বেশি পার্থক্য নেই। তাই যে কারখানা সবচেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করতে পারে ক্রেতারা তাদেরকেই বেছে নেয়। তৃতীয়ত, যদিও গার্মেন্টস ব্যবসায় নতুন প্রতিযোগীর আগমন কঠিন কারণ এতে অনেক এককালীন মূলধনের দরকার হয়, তবে একবার যারা উচ্চ মূলধন নিয়োগ করে এই ব্যবসায় আসে তাদের জন্য এর থেকে বের হওয়া অত্যন্ত কঠিন। কারণ, সেলাই মেশিন, ওয়াশ প্লান্ট ইত্যাদির গার্মেন্ট ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসায় তেমন কোনো ব্যবহার নেই। ফলে, এই ব্যবসায় প্রতিযোগিতা অত্যন্ত তীব্র।
এছাড়াও রিয়েল এস্টেটের এককালীন উচ্চ মূল্য এবং বিদ্যুত/গ্যাস সংক্রান্ত মাসিক নির্দিষ্ট ওভারহেড খরচের পুষিয়ে নেয়ার জন্য পোশাক মালিকরা পূর্ণ ক্যাপাসিটিতে কারখানা চালানোর জন্য অত্যন্ত কম মার্জিনে অর্ডার নিতে বাধ্য হয়। তৈরি পোশাকের ক্রেতারা কারখানা মালিকদের এই সীমাবদ্ধতাগুলো সমন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল এবং গার্মেন্ট মালিকদের নামমাত্র মূল্য দিয়ে এ সুযোগের পূর্ণ ব্যবহার করেন ক্রেতাগণ। অর্থনীতির ভাষায় উৎপাদনকারী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের এই অবস্থাকে বলা হয়, প্রাইস টেইকার (Price taker)। অর্থাৎ তারা তাদের কারখানায় তৈরিকৃত পণ্যের মূল্য নির্ধারণকে প্রভাবিত করতে পারে না।
যে শিল্পে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের তৈরিকৃত পণ্যের মূল্য নির্ধারণকে প্রভাবিত করতে পারে না, মুনাফা লাভের জন্য তাদের প্রধানত অপারেশনাল কার্যদক্ষতার উপরেই নির্ভর করতে হয়। তাই ফ্যাক্টরি পরিচালনার ক্ষেত্রে শক্তভাবে খরচ কমানোর চেষ্টা করাই হচ্ছে মুনাফাবৃদ্ধির একমাত্র পথ। পোশাক তৈরির খরচের একটি সিংহভাগই ব্যয় হয় কাপড় (ফ্যাব্রিক্স) ও আনুষঙ্গিক উপকরণ (যেমন বোতাম, জিপার, সুতা ইত্যাদি) কিনতে।
এক্ষেত্রেও ফ্যাক্টরিগুলোর তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের জন্য তৈরি পণ্যে কোন কোম্পানির কাপড় ও আনুসঙ্গিক উপকরণ ব্যবহার করতে হবে সেটিই শুধু নির্দিষ্ট করে দেয়না বরং এসব উপকরণের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি মূল্য কষাকষি করে গার্মেন্টস তৈরিকারক প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে, এইসব উপাদান সংযোজনের মাধ্যমে অতিরিক্ত মুনাফা লাভের সুযোগ গার্মেন্টস তৈরিকারক প্রতিষ্ঠানের থাকে না।
গার্মেন্টস তৈরি করার ক্ষেত্রে কাপড় ও আনুষাঙ্গিক প্রয়োজনীয় কাঁচামালের পরবর্তী প্রধান খরচের উৎসই হচ্ছে শ্রমিকদের বেতন। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিকরা যেহেতু তাদের তৈরিকৃত পণ্যের দাম অথবা সংশ্লিষ্ট কাঁচামালের মূল্য নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করতে পারে না, তাই তারা যেটি তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে (শ্রমিকদের বেতন) সেটিকে সর্বোচ্চভাবে নিয়ন্ত্রণ/নিষ্পেষণ করার চেষ্টা করে। ফায়ার/বিল্ডিং কোডসহ অন্যান্য নীতিমালা ভঙ্গ করে অনিরাপদ কারখানা নির্মাণ করে খরচ কমানোও একই সূত্রে গাঁথা, কারণ এক্ষেত্রেও ভূক্তভোগী হচ্ছে শ্রমিকরা। শ্রমের ক্রেতা হিসেবে এই সমীকরণে মালিকরাই শক্তিশালী পক্ষ। তাদের এই অগাধ ক্ষমতার মূলেও সেই অর্থনীতি।
কারণ গার্মেন্টস শিল্পে মেশিন চালাতে তেমন কোনো দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে না। অল্প কিছুদিনের প্রশিক্ষণে যে কেউই এধরনের মেশিন চালাতে পারে। ফলে এ শিল্পের শ্রমিকরা সহজেই প্রতিস্থাপনযোগ্য (substitutable), আর তাই ফ্যাক্টরির মালিকদের বিপক্ষে শ্রমিকদের তেমন দর-কষাকষির ক্ষমতা থাকে না।
মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, সপ্তাহে ৬০-৮০ ঘন্টা কাজ করা একজন শ্রমিকের অবশ্যই তার পরিবারের নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর সামর্থ্য থাকা উচিত। তাছাড়া, অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সাথে তাদের পদোন্নতি হওয়া উচিত এবং বেতন বৃদ্ধিও হওয়া উচিত যা তাদের জীবনযাত্রার মান আরও বৃদ্ধি করবে। নিদেনপক্ষে, মুদ্রাস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেতন বৃদ্ধি হওয়া উচিত যাতে তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি না হলেও, বছর বছর বাড়িভাড়া সহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। বর্তমান বাজারে (শ্রমিকদের সর্বশেষ দাবী) মাসিক ন্যূনতম আট হাজার টাকা দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করা যে কত অসাধ্য সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি নি:সন্দেহে যৌক্তিক দাবী; তবে এ ব্যাপারে ফ্যাক্টরি মালিকদেরও রয়েছে পাল্টা যুক্তি।
পোশাক কারখানার মালিকরা উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে (বাৎসরিক প্রায় ১০%) নানাবিধ অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হন। প্রতিনিয়ত বিদ্যুত ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং স্থানীয় বাজার থেকে কেনা অন্যান্য উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি তাদের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয়। পক্ষান্তরে, বিদেশি ক্রেতারা কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির সাথে তাল মিলিয়ে পোশাকের দাম বাড়িয়ে দিতে চান না।
এছাড়াও ম্যাক্রো অর্থনীতিক বিভিন্ন বিষয় - যেমন, রাজনৈতিক অস্থিরতা (হরতাল/ধর্মঘট), অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ, পরিবহন ব্যবস্থার ঘাটতি এবং সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম ও তৈরি পোশাকের খরচ অনেক বাড়িয়ে দেয়। কারখানার পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা ও শ্রমিকদের নায্য বেতনের নিশ্চয়তা দিতে হলে যে অতিরিক্ত খরচ হবে সেটি গার্মেন্টস মালিকদের অন্য কোনো ক্ষেত্র থেকে পুষিয়ে নিতে হবে। তাই গার্মেন্টস মালিকদের পক্ষে অর্থনৈতিক বিবেচনা আগ্রাহ্য করে শুধু মানবিক দিক বিবেচনা করে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর দাবি মেনে নেয়া সম্ভব হয় না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যদি শ্রমিকদের দাবী যৌক্তিক হয় এবং গার্মেন্টস মালিকদের পাল্টা যুক্তিও যথাযথ হয়, তাহলে সমাধান কী? সমাধান খোঁজার আগেই আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, শ্রমিকদের নায্য বেতন এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবি আপোসযোগ্য নয়। পক্ষান্তরে, এরই মধ্যেই এটিও উল্লেখ করা হয়েছে যে, গার্মেন্ট মালিকদের হাতে মুনাফা বৃদ্ধি/নিয়ন্ত্রণের পর্যাপ্ত কৌশল না থাকাই শ্রমিকদের নায্য দাবি মানতে না পারার অন্যতম কারণ। অতএব গার্মেন্টস মালিকদের মুনাফাবৃদ্ধির বিকল্প উপায়ের মধ্যেই আমাদের সমাধান খুঁজে নিতে হবে।
মুনাফাবৃদ্ধির একটি মূল উপায় হচ্ছে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, যেটি গার্মেন্ট শিল্পে ক্রেতাদের অগাধ ক্ষমতার কারণে অত্যন্ত কঠিন। তবে অতিরিক্ত ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস প্রদানের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করা সম্ভব। তুলনামূলক কম সময়ে পণ্য ডেলিভারি দেয়া (lead time কমানো), ধারাবাহিকভাবে নির্ভরযোগ্য পণ্যের সরবরাহ করার মাধ্যমে বিশ্বস্ত পার্টনারে পরিণত হওয়া, এবং ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে প্রিমিয়াম চার্জ করা সম্ভব।
ফ্যাক্টরিতে সর্বোচ্চমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা অথবা পরিবেশ দূষণ কমানোর মত ব্যবস্থাকে শুধু খরচ হিসেবে না দেখে, এটিকে পয়েন্ট অব ডিফারেন্সিয়েশন হিসেবে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। বিদেশি ক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ‘Made in Green Certified Factory of Bangladesh’ অথবা ‘Made in Factory with Fair Labor Practice’ জাতীয় লেবেল লাগিয়ে যথাযথ ব্র্যান্ডিং করা যেতে পারে। বিজিএমই এর মত প্রতিষ্ঠান এই ধরনের উদ্যোগ নিয়ে বিদেশি ক্রেতাদের সাথে যৌথভাবে কনজ্যুমার মার্কেটিং করতে পারে। ইন্টারনেটের এই যুগে অত্যন্ত কম খরচেই এ ধরনের অনলাইন মার্কেটিং করা যেতে পারে।
যেসব গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট নিয়মনীতি অনুসরণ করবে, শুধু তারাই এই লেবেল ব্যবহার করতে পারবে এবং এর সুবাদে তাদের প্রতিটি পণ্যের জন্য অতিরিক্ত ১০ সেন্ট অথবা যথাযথ পরিমাণের প্রিমিয়াম চার্জ করতে সক্ষম হবে।
আগেই উল্লেখ করেছি, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে টিকে থাকার জন্য শুধু স্বল্প মূল্যের শ্রমের উপর নির্ভর করার অবকাশ নেই। বরং বিকল্প উপায়ে খরচ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। গার্মেন্টের সহযোগী শিল্প (যেমন: সুতা উৎপাদন, ফ্যাব্রিক্স, বোতাম ইত্যাদি) বিকাশে সরকার এবং ব্যবসায়ীদের সম্মিলিত উদ্যোগে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে।
এই শিল্পগুলোকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে অনেক সুবিধা – দেশেই গুণগত মান সম্পন্ন এইসব কাঁচামাল পাওয়া গেলে এসব সংগ্রহে চীন, সিঙ্গাপুর বা হংকং থেকে আমদানি করার তুলনায় অত্যন্ত কম সময় দরকার হবে (যা lead time কমাতে সাহায্য করবে), পরিবহন খরচ কম হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। এছাড়াও এইসব শিল্পে প্রচুর কর্ম সংস্থান হওয়ার পাশাপাশি কাঁচামালের জন্য আমদানি নির্ভরতা কমার কারণে গার্মেন্ট শিল্পের জাতীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে।
গার্মেন্ট শিল্পের প্রবৃদ্ধির একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মেধার অভাব। দেশের গার্মেন্টসগুলোতে উৎপাদনকর্মের সাথে জড়িত বেশিরভাগ কর্মচারী-কর্মকর্তারই তেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বা অনেকের সার্টিফিকেট থাকলেও শিক্ষার গুণগত মান তেমন ভাল নয়। ফলে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে প্রচুর অকার্যকরতা (operational inefficiency) রয়েছে, যা পোশাক তৈরির খরচকে অকারণে বাড়িয়ে দেয়। মার্চেন্ডাইজিং পেশায় নিয়োজিতদের শিক্ষাগত যোগ্যতা তুলনামূলক ভালো হলেও, দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেধাবী শিক্ষার্থীরা গার্মেন্টে কাজ করতে আগ্রহী হয় না। ফলে বিদেশি ক্রেতাদের নতুন নতুন ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস প্রদানের মাধ্যমে অথবা ক্রস সেলিংএর মাধ্যমে আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় দেশীয় গার্মেন্টগুলো।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মেধাবী তরুণদের গার্মেন্টস শিল্পে ক্যারিয়ার গঠনে আগ্রহী করে তোলার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে। শুধু মার্চেন্ডাইজিংয়েই নয়, বরং প্রোডাকশন সহ সকল ধরনের ম্যানেজমেন্ট পদগুলোতেই মেধাবী ও শিক্ষিতদের আকৃষ্ট করতে হবে।
এছাড়াও ম্যাক্রো অর্থনৈতিক অনেকগুলো বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সুবিধা বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে, যা শ্রমিকদের নায্য বেতন এবং নিরাপদ কারখানা নিশ্চিতকরণে সহায়ক হবে।
পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহের নিশ্চয়তা, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের পাশাপাশি মংলা সমুদ্রবন্দরের উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার হাত থেকে গার্মেন্ট শিল্পকে রক্ষা করা গেলে বিশ্ববাজারে আমাদের গার্মেন্ট কোম্পানিগুলোর গ্রহণযোগ্যতা যেমন বাড়বে, তেমনি মুনাফা বৃদ্ধিরও সুযোগ তৈরি হবে যা শ্রমিকদের নায্য বেতন ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। অধিকন্তু গার্মেন্ট শিল্পে সরকারের অবদানের কারণে শ্রমিকদের পক্ষে মালিকদের সঙ্গে বেতন নির্ধারণ বা অন্যান্য আলোচনায়ও সরকার জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান প্রশ্নাতীত। গত কয়েক দশকে এ শিল্পের অসামান্য অগ্রগতি বিশ্বের দরবারে ‘বাংলাদেশ’ এবং ‘গার্মেন্ট’ শব্দ দুটোকে অনেকটা সমার্থক করে তুলেছে। তাই এ শিল্পের কোনো নেতিবাচক সংবাদ আমাদের সমগ্র দেশেরই ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে। আর বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার যে স্বপ্ন আমরা দেখি, সেটি বাস্তবায়নের জন্য এই শিল্পের যথাযথ পরিচর্যা করার বিকল্প নেই।
গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সরকার ও বিরোধীদলের সম্মিলিত প্রয়াসে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিক বিশ্লেষণ করে দীর্ঘমেয়াদী ভিশন ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে মাধ্যমে এ শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
এইচ এম মহসীন: কনজ্যুমার প্রোডাক্ট কোম্পানির কর্মকর্তা, mithuh@wustl.edu>
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৬, ২০১৩
জেএম/জিসিপি