ঢাকা: শীতের নরম রোদ । বান্দরবানের সবুজ পাহাড়ে লিকলিকে সাপের মত বয়ে চলা পথ।
ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্রপ্রেমি শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নিজের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি আমাদের বুকের মাঝেও স্থান করে নিয়েছিলেন। সেই সময়ের অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন এবং সে যাত্রায় মূলত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা পুনঃ বেগবান হয়েছিলো। মনে পড়ে, গত বিএনপি শাসনামলে শামসুন্নাহার হলের ভেতর ছাত্রীদের উপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে রাস্তায় বিক্ষোভ প্রকাশকালে পুলিশ তাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিলো।
এতো সেদিনের কথা। কিন্তু বাংলাদেশের উষালগ্নে মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীর সেনানী যার গোটা পরিবার, দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি যে পরিবারের কাছে ঋণী, স্বাধীনতার সোনালী স্বপন যার হৃদয়ে অঙ্কিত, যার ভ্রাতা বুক উঁচু করে মৃত্যুকে পরাজিত করেছেন। বলেছেন,‘নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে বড় কিছু নেই,’।
দেশ নিয়ে লড়বার জন্য যার স্বার্থচিন্তা কাজ করেনি, দেশকে গড়বার জন্য যার লাভালাভের বাসনা জাগেনি– তারই বিরুদ্ধে আজ মহা অভিযোগ, ‘আপনি সরুন’। তার অসততা রয়েছে,পক্ষপাত রয়েছে, তিনি প্রতিশ্রুতি রাখেন না’- যারা এ অভিযোগ এনেছেন পদাধিকার বলে তারা অনেক সম্মানিত, যোগ্য, জ্ঞানী এবং সম-সম্প্রদায়েরই কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
দীর্ঘদিন থেকে তারা তাই এই ব্যক্তির উপাচার্য পদকে বিপদে ফেলতে গোষ্ঠীগত ভাবে আত্ননিয়োগ করেছেন, ঘেরাও,অবস্হান ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁর দিনের রুটিন কাজ আর রাতের স্বাভাবিক ঘুম হারাম করে দিয়েছেন। কিন্তু যেখানকার কথা বলছি, সেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এর আগের উপাচার্যকেও একই অবস্হার মধ্যে পড়তে হয়েছিলো এবং সরে যেতে হয়েছিলো। তার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অভিযোগের কমতি ছিলো না। সারা বছর আন্দোলনের জন্য পরিচিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শীর্ষ এ পদ এবং অবস্থানের জন্য লাগসই ভেবে ড.শরীফ এনামুলের স্থলে প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনে এখানে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো। কিন্তু ড. শরীফ এনামুল কবীরের মত সুর্নিদ্দিষ্ট কোন অভিযোগ ব্যতিরেকে পুনরায় এখানে কিছু শিক্ষক কর্তৃক উপাচার্য খেদাও আন্দোলন শুরু হলো।
অধ্যাপক আনোয়ারের আত্নসম্মানবোধ অত্যন্ত প্রখর, তিনি একদিন হুট করে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে বসলেন। ব্যস,আর যায় কোথা! জাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরা তাকে দিনরাত আটকে রাখলো, ছাড়বে না। অভূতপূর্ব সে শিক্ষার্থীপ্রিয়তা ও অফিস অবরুদ্ধতা ।
সরকারের বিশেষ অনুরোধে অনেকক্ষণ গোঁ ধরে থাকবার পর অবশেষে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা থেকে সরে আসলেন, স্বচক্ষে দেখেছি।
অল্প কিছুদিন যেতেই আবার গতানুগতিক একই আন্দোলন,সম্মানিত শিক্ষকগণের। কিছু অভিযোগ আছে, তারা দাবি প্রকাশ করলেন। উপাচার্য অস্বীকার করলেন না, দেখবেন বলে কথা দিলেন, কিন্তু তারা সেটি মানতে নারাজ, মাননীয় উপাচার্যকে দেখে নেয়ার হুমকি দিলেন এই বলে যে, ‘উপাচার্য হটো’। উপাচার্যের বিপক্ষে অভিযোগসমূহ সত্য হতেও পারে এটা আমরা খালি চোখে ভাবছিলাম কিন্তু অভিযোগের প্রকৃতির সাথে উপাচার্যের পদত্যাগের অনমনীয় দাবি কেন যেন অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হলো এবং উপাচার্য মহোদয়ের একটা জাতীয় দৈনিকের কলাম তা আরও স্পষ্ট করলো যে ‘ডাল মে কুচ কালা হে!’
ওখানকার শিক্ষকগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন শিক্ষককে তাদের মাথার উপর চাইবেন না, এটা তাদের অহংবোধে লাগে যে, হয়তো তারা বাইরে অযোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছেন। লাগতে পারে, মেনে নিচ্ছি । কিন্তু সেটা তো অধ্যাপক আনোয়ারের সীমাবদ্ধতা বা দোষ নয়। সরকার তাকে একটি বিশেষ পরিস্থিতির বিষয় বিবেচনা করে সেখানে যেতে অনুরোধ করেছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের ধারাবাহিক ঐতিহ্যগত সংস্কৃতিকে সঙ্গ দেয়ার ক্ষমতাসমপন্ন প্রখর প্রগতিশীল এবং অত্যন্ত যোগ্য একজন সংবেদনশীল শিক্ষককে সেখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। ওখানকার শিক্ষকগণ অনেকেই উপাচার্য পদলোভী হবেন, এটা স্বাভাবিক। সে যোগ্যতা তাদের কারও কারও নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সৃজনশীলতাও থাকতে হবে তো, সেটা তাদের আন্দোলনে নেই, প্রকাশেও নেই; বড় একঘেয়ে মনে হচ্ছে। বরং উপাচার্য সেক্ষেত্রে অনেক সৃজনশীল, সস্ত্রীক মাদুর পেতে বসে গেছেন পাল্টা আন্দোলনে।
এর আগে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের লাগানো পদত্যাগের দাবি সম্বলিত ব্যানার বাতাসে ছিঁড়ে নিচে পড়ার পর তারা স্বামী-স্ত্রী নিজেরাই যথাস্থানে টানিয়ে দিয়েছেন, ভাবা যায়!
চলতি সংবাদ এই যে, উভয়পক্ষ মুখোমুখি বসে আছেন,সমাধান নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ পড়াশুনা, সেটি এখন বন্ধ। চলছে, শিক্ষকদের আন্দোলন। তারা শুধু পদত্যাগ চান, কোনও ক্লাস কিংবা পরীক্ষা নয়। কিন্তু অবাক বিষয় হলো আন্দোলন বলতে সেখানে যাদেরকে বোঝানো হয়, সেই আনু মুহাম্মদ, মানস চৌধুরী, নাসিম আকতার হোসাইন কেউই এ উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনে নেই। তারা এ আন্দোলনকে যৌক্তিক ভাবছেন না ,সম্পৃক্তও হচ্ছেন না !
আমি নিজে অধ্যাপক আনোয়ারের সাথে পরিচিত হই আশৈশব কৌতূহল বশে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার একবার এক্সটারনাল মেম্বার হিসেবে গেলেন। প্রাণ রসায়নের সেই সময়ের চেয়ারপার্সন জনাব মু. গোলাম কবীর আমাকে এ দুর্লভ ব্যক্তির সাথে পরিচয়ের সুযোগ করে দেন । বিজ্ঞানের শিক্ষক হলেও আমার দু’একটি কবিতা তার মনে ধরে এবং ক্রমে আমি তার পরিবারের আপনজন হয়ে উঠি। ভরা পূর্ণিমায় আমার ডাক পড়ে,একসাথে পূর্ণিমা দেখি,গান গাই,গান শুনি।
বিশেষ কোন ভালো লাগার দিনে বাঁশিওয়ালা আসে, বাঁশি বাজে। গোটা পরিবার একসাথে উপভোগ করে। তাদের পারিবারিক বন্ধন তো অন্য রকম। ভাইবোনদের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক ঈর্ষণীয় রকমের ভালো। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই তারা ভীষণ রোমান্টিক, অকল্পনীয়। বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়ে যার অগাধ দখল, তার মুখে কবিতা,গান, চিত্রকলার দারুণ সব অভিব্যক্তি। সুন্দর বাচনভঙ্গি, স্পষ্ট উচ্চারণ আর তার দৃঢ় বাক্যপ্রয়োগ শুনে মন্ত্রমোহিত হতে হয়। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে তার ভাষণ ছিলো অতুলনীয়, অত্যন্ত উদ্দীপক। সাদাসিধে জীবনে অভ্যস্ত সরল হাসিখুশি এ প্রাণবান মানুষ আজ সম্মানাক্রান্ত। একা লড়ছেন। বাংলার বীর কর্ণেল তাহেরকে যখন ফাঁসির দড়িতে ঝুলানো হয়, তখনও তিনি জেলের ভিতর একা দাঁড়িয়েছিলেন। আজও।
কিন্তু স্বাধীন দেশে এটা তো হওয়ার কথা নয়। শরীফ এনামূল কবীর, আনোয়ার…এর পরে কে? যারা আন্দোলন করছেন, তারা কি ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শী শিক্ষককে উপাচার্য হিসেবে চাচ্ছেন? যদি না চান তবে তাদের আন্দোলন কি দল নিরপেক্ষ উপাচার্য চেয়ে? তাদের দাবির সারাৎসার কিন্তু অস্পষ্ট। ইতিহাস তো বলে বাংলাদেশের সব সঙ্কটে অধ্যাপক আনোয়ার মিছিলের সর্বাগ্রে ছিলেন,কখনও পিছপা হননি। দেশের জন্য পারিবারিক আত্মত্যাগের দৃষ্টান্তেই বা তার মত আর কয়জনের আছে? উপাচার্য ভুল করতে পারেন না,করেননি বা করছেন না,এটা বলছি না। বলছি ত্যাগের ইতিহাস তো তার রক্তে, সেখানে যদি ছোট কোন ভুল থেকেও থাকে, প্রতিবাদ হবে না কেন ,অবশ্যই হবে। কিন্তু তাই বলে একবারে সরে যেতে হবে, এ দাবি খুব একটা জনগ্রহণযোগ্য হচ্ছে কি? কে আসবেন ওনার জায়গায়! ইতিহাসের আত্মত্যাগীকেই মেনে নিচ্ছেন না! কাকে মানবেন, কার আত্মত্যাগ তার সাথে তুলনীয়? যদি যোগ্যতার কথা আসে, অধ্যাপক আনোয়ারের সমান যোগ্য হয়তো কেউ থাকতে পারেন,আত্মত্যাগী কয়জন আছেন? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত উপাচার্যের বন্ধ্যাত্বের সংস্কৃতির অবসানও তো তারই অবদান! তিনিই তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সময়ের প্রথম নির্বাচিত উপাচার্য। আমরা কি সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিনের মত কাউকে চাচ্ছি, যিনি দেশ তো দূরের কথা, নিজের সমর্থিত দলের জন্যও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন? নাকি এটা নিখাদ মন খারাপের আন্দোলন,আমি কেন উপাচার্য হতে পারলাম না! উপাচার্য হিসেবে উনি থাকবেন অথবা থাকতে পারবেন কি না জানি না, কিন্তু পদত্যাগের দাবির বিরুদ্ধে ওনার অবিচল অবস্থান তার দীর্ঘ সংগ্রামী সত্যের কথাই শুধু জানান দেয়। পালিয়ে আসা কোন বিপ্লবীর কাজ হতে পারে না, উনি এটা করবেনও না- আমি নিশ্চিত। উপাচার্য পদ ছেড়ে দিলেই উনি সম্মানিত আর ধরে রাখলে এটা উনাকে ছোট করবে, উচ্চতার পরিধি এভাবে অনুধাবনযোগ্য নয়।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের দেশ,বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধার দেশ। অতএব, মুক্তিযোদ্ধা ড. আনোয়ার হোসেন আপনাকে বলছি, লড়াই করা আপনার ঐতিহাসিক দায়িত্ব, স্যার! দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সচেতন শিক্ষার্থী ও অগণিত মানুষের জন্য অতীতের মত এখনও সত্যের হাল ধরে রাখুন, ছাড়বেন না! প্লিজ।
লেখক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ২২২৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০১৩
আরআই/জিসিপি