গত ১৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের পাঁচ দিন ব্যাপী এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জনসংখ্যা বিষয়ক ষষ্ঠ সম্মেলনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশের উপর জাতিসংঘ থেকে সমকামী অধিকার নিশ্চিত করার জন্য চাপ দেয়া হয়। এই জাতিসংঘকে এর আগেও দেখেছি মায়ানমারকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চাপ না দিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবার জন্য অন্যায়ভাবে বাংলাদেশকে চাপ দিয়েছিল।
কথা হল, বাংলাদেশ একটি ইসলামী রাষ্ট্র, যেখানে ধর্মে স্পষ্টভাবে সমকামিতা নিষিদ্ধ, সে দেশকে সমকামীদের বৈধতা দেবার জন্য চাপ দেয়ার হেতু কি? যে দেশের মানুষ মৌলিক অধিকার অর্জনে যোজন যোজন পিছিয়ে, যেখানে প্রকৃতঅর্থে মানবাধিকার কনসেপ্টটাই অনেকের কাছে এখনো অজ্ঞাত, যে দেশের মেথর, বেদে সম্প্রদায়ের লোকেরা এখনো চেয়ার থাকতে দূরে মাটিতে বসে থাকে, সেখানে সেসব খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে চাপ না দিয়ে হঠাৎ করে সমকামীদের যৌন অধিকার আদায়ে চাপ দেয়ার অর্থ কি?
জাতিসংঘের মত সংগঠনের কি জানা নেই যে, ইসলামে সমকামিতা নিষিদ্ধ? এই দেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ? তাহলে জেনেবুঝে চাপ দেয়ার মানে কি? পেছন থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং কিছু মানবাধিকার সংস্থা কলকাঠি নাড়ালেই কি এরকম একটি বিষয়ে জাতিসংঘ চাপ দেয়ার অধিকার রাখে?
এর আগে ২০১১ সালে সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের এক বিশেষ অধিবেশনে উভয়কামীসহ সব সমকামী নারী ও পুরুষের সমানাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রস্তাব পেশ করা হয়। ৪৭ সদস্য দেশের সমন্বয়ে গঠিত কাউন্সিলে সেই প্রস্তাবের প্রতি ২৩ সদস্য পক্ষে, ১৯ সদস্য বিপক্ষে ও ৩ সদস্য ভোট দানে বিরত থাকে। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো পক্ষে ভোট দিয়ে এ প্রস্তাবকে ঐতিহাসিক উল্লেখ করলেও পাকিস্তান, সৌদি আরব, কাতার ও বংলাদেশের মতো ইসলামি রাষ্ট্র এ প্রস্তাব কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সেসময় জাতিসংঘ থেকে ঘোষণা করা হয় যে, `যৌন-অবস্থানের কারণে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে বৈষম্য বা সহিংস আচরণ করা যাবে না। `
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে কি সমকামীদের উপর কোনো বৈষম্য ও সহিংস আচরণ করা হয়? এই তো দু’দিন আগে পটুয়াখালীর সমকামী দু’জন নারীর প্রেম, বিয়ে নিয়ে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হল। কোথাও শুনিনি যে তাদের উপর সহিংস কোনো আচরণ করা হয়েছে। তার মানে দেশে সমকামীর অস্তিত্ব থাকলেও তাদের উপর সহিংস আচরণ করা হয় না।
এ দেশে বাংলাদেশ লিবারেল ফোরাম ও বয়েস অব বাংলাদেশের মতো কিছু সংগঠন আছে যারা সমকামীদের জন্য কাজ করে। শোনা যায়, এখানে অনেক সমকামী সদস্য আছে। আমার জানা নেই এই সংগঠনগুলো এদেশে নিষিদ্ধ কোনো সংগঠন কিনা। যদি না হয়ে থাকে তার মানে তারা এদেশে সহিংসতা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে না। হলে অন্তত এ বিষয়ে পত্র পত্রিকায় খবর আসতো। আসেনি যখন, তখন ধরে নিতেই পারি তারা নির্বিঘ্নেই এ দেশে বেঁচেবর্তে আছে। আমরা জানিনা এই সংগঠনের সদস্যরা সবাই হাই-সোসাইটি থেকে এসেছে কি-না। জানিনা এই বয়েস অব বাংলাদেশে নিম্নবিত্তের ও অশিক্ষিত কোনো সমকামী সদস্য আছে কি-না, থাকলে কত পার্সেন্ট। যদি না থেকে থাকে তাহলে কি ধারণা করে নিতে পারি যে, উচ্চ ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শিক্ষিতগোষ্ঠীর যৌন অধিকার রক্ষায় এরা কাজ করছে?
সমকামীদের অধিকার বলতে আসলে কি বোঝায়? তাদের অবাধে পার্টনারকে ভালবাসতে দিতে হবে? এখানে কি ভালবাসা বলতে শারীরিক নাকি মানসিক? “কামের” কথা যখন আসে, তখন অবধারিতভাবে সেক্স এর কথা আসে। তো তারা বাংলাদেশে কি অবাধে যৌনকর্মের অধিকার চাইছে? তারা কি চাইছে কোনো কাজী তাদের বিয়ে পড়িয়ে দেবে? কিছুদিন পর, বাচ্চা পয়দা না করেই কি তারা বিপরীতকামী দম্পতির কাছ থেকে বাচ্চা এডাপ্ট করার অধিকার চাইছে?
যেহেতু সমকামিতা ধর্মীয় মূল্যবোধ পরিপন্থি, সেক্ষেত্রে এখানে ধর্মীয় রীতিনীতি, আচার আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে সমকামিতাকে দূরে রাখাটাই কাম্য হতে পারে। তাহলে সমকামীরা কেন বিয়ে নামক একটি ধর্মীয় আচারের অধিকারে সোচ্চার হয়ে ওঠে সে বিষয়টি আসলেই বোধগম্য নয়।
এটা যেমন সত্যি যে, কেউ ইচ্ছে করে সমকামী হয়না, তাই কেউ সমকামী জানলে তাকে যেমন সমাজে বয়কট করা সমীচীন নয়, ঠিক তেমনি মুসলিম দেশে সমকামিতাকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য চাপ দেয়াও সমীচীন নয়। পাশ্চাত্যে নগ্নতাকে শিল্প হিসেবে গণ্য করা হয়, তার মানে এই নয় যে, আমরাও নগ্নতাকে অনুমোদন করব। পাশ্চাত্যে বাসে-ট্রামে, হাটে-বাজারে প্রকাশ্যে চুম্বনসহ অনেক কিছুই মানবাধিকারের নাম অনুমোদিত, তার মানে এই নয় যে, তাদের মত সব প্রণয়ীর প্রকাশ্যে চুম্বনের অধিকার দিতে হবে, না দিলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে।
অনেকেই সমকামিতাকে স্বাস্হ্যকর বলে দাবি করে এর পক্ষে জনমত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কথা বলছেন। "ন্যাশনাল এলজিবিটিআই হেলথ এলিয়ানস অস্ট্রেলিয়া” এর ওয়েবসাইটে দেখা যায়, অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ অয়েলেস (সিডনি অন্তর্ভুক্ত) ও ভিক্টোরিয়া (মেলবোর্ন অন্তর্ভুক্ত) স্টেটে সাম্প্রতিককালে সিফিলিস, গনোরিয়ার মত যৌনরোগ গে` দের মাঝে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষনায় দেখা গেছে যে, তরুণ অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে যৌনবাহিত রোগ বিপরীতকমীদের তুলনায় সমকামীদের মধ্যে পাঁচগুণ বেশি। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়াতে এইডস রোগ ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশই গে` এবং সমকামী।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, মানবাধিকারের নামে অবাধে যৌনাচার করার জন্য যেসব দেশ নমনীয়, সেসব দেশেই এখন যৌনবাহিত রোগ মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ছে।
সমকামী হবার গ্লানিতে অনেকে আত্ম্যহত্যা করে শুনেছি। কিন্তু সে আত্মহত্যা কি রাষ্ট্র প্রণোদিত? নাকি আত্মগ্লানি থেকে? নাকি যার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে সেই ব্যক্তি বিপরীতকামী হওয়ায় তার সঙ্গে যৌন সম্পর্কের কোনো সম্ভাবনা নেই জেনে? যারা জীবনের সব লক্ষ্যের মূল লক্ষ্য যৌনসম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেয়, যৌন অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মাঠে নামে, যৌনসম্পর্কে কাঙ্ক্ষিত পার্টনারের সঙ্গে না জড়াতে পেরে আত্মহত্যা করার সিধান্ত নেয়, তাদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে, তাদেরকে অবাধে যৌনাচার করার স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আমাদের নোবেলজয়ী থেকে শুরু করে মানবাধিকার কর্মীরা আজ সোচ্চার!
আধুনিকতার নামে ধর্মীয় মূল্যবোধ মেনে চলাকে পশ্চাদগামী বলে যারা প্রচার করে থাকেন তারা সমকামীদের অধিকার রক্ষার নামে সমাজকে কোথায় নিয়ে যায় সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে জেনে-শুনে-বুঝে বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশে সেই অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন করার থেকে গৃহকর্মী আদুরিদের অধিকার আদায়ে সেই মেধা ও সময় ব্যয় করাই কি শ্রেয়তর নয়?
জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৩
জেডএম/জিসিপি