পূজা হয় হৃদ-মন্দিরে। দেহ-বীণার তন্ত্রীতে বাজে মঙ্গলঘণ্টা।
অন্তর্জগতের পূজার সাথে বর্হিজগতের পূজার বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। আড়ম্বরহীন মনোরথে যিনি নিত্য অনাহুত ধ্বনি করে চলেছেন তা উপলব্ধি করে কেবল সাধক নিজেই। মধুময় প্রেমসুধা সিঞ্চিত হয় দেহাভ্যন্তরে। জাগ্রত হয়ে ওঠে কূলকুণ্ডলিনী শক্তি। ঠিক তখনই ঘটে ভাবের বহিঃপ্রকাশ। এই সময়কালের অভিব্যক্তির বর্ণন সত্যিই দুষ্কর হয়ে ওঠে। বিপরীত ধারায় বর্হিজগতের পূজা সহজেই দৃষ্টিগোচর হয় চর্মচক্ষে। মৃন্ময়ী প্রতিমায় চিন্ময়ী রূপ সৃষ্টিতে চলে প্রাণান্ত চেষ্টা। এতে কেউ হয় সার্থক, আর কারো আয়োজন থেকে যায় শুধু আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্যেই।
সনাতন ধর্মে প্রতিমাপূজার বিধান রয়েছে। এটি একটি ঋষি-শিল্প। এই শিল্পের তাৎপর্যও অনেক। যারা প্রতিমা পূজাকে পুতুলপূজা কিংবা এই পথের আরাধনাকারীদের পৌত্তলিক নামে অভিহিত করতে চায়, তাদের ধারণা নিতান্তই অমূলক এবং মূর্খতার পরিচায়ক বটে। শিবকল্প মহাযোগী শ্রীৎ স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজের ভাষায় :
“প্রতিমা রহস্য মিথ্যা বা রূপক নহে, উহা সত্য। প্রতিমার সাহায্যে আরাধনা করা মানেই চিত্ত সংযত করার একটি সহজ প্রণালী। শুধু অন্তরের অন্তঃস্থলের দিব্য আত্মানুভূতির অবিকল ও কৃত্রিম সংবেদন প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে তাঁরই অনুবেদনবাহী প্রতীক আমাদের মতো স্বল্পবুদ্ধির মানবের হিতার্থে গ্রহণ করেছেন জ্ঞানরত্নাকর ঋষিগণ। একবার যাদের অসীম ব্রহ্মে ধ্যান-ধারণাজনিত অনুভব জন্মেছে, তাদের কাছে স্থূল বিগ্রহের পূজা নিতান্তই গৌণ। কিন্তু যাঁদের সেই ধারণা জন্মে নি, তাদের এই স্থূল রূপের ভিতর দিয়ে সূক্ষ্ণে পৌঁছানোর জন্য ঋষিরা মূর্তিপূজা নামক এক অনবদ্য শিল্প সৃজনের প্রয়াস পেয়েছেন। প্রতীকের আশ্রয় নিয়েই আমরা সেই নিরাকার, নির্গুণ, সর্বব্যাপী চৈতন্যময় ব্রহ্মসত্তার স্বরূপ অবধারণ করতে সমর্থ হই। ঋষিরা এভাবেই প্রতীকতত্ত্ব আবিষ্কার করে আত্মবিদ্যা প্রকাশ ও প্রচার করে গিয়েছেন। ”
স্বামী বিবেকানন্দ সাকার রূপের উপলব্ধি করে বলেছেন:
“পুতুল পূজা করে না হিন্দু
কাঠ-মাটি দিয়ে গড়া
মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে
হয়ে যায় আত্মহারা। ”
দুর্গারূপ ঋষিশিল্প অন্যতম অর্চনার বস্তু। মাতৃশক্তিকে বাদ দিয়ে সৃষ্টির অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। জগৎ-জননী দুর্গা তাই আরাধ্যার দেবী ভক্তজনমানসে। দুর্গা নামের অর্থ বিশ্লেষণে দেখা যায় : ‘দ’ শব্দটি দৈন্যনাশক, ‘উ’-কার বিঘ্ননাশক, রেফ-রোগ সংহারী, ‘গ’-পাপ বিনাশী এবং ‘আ’-কার ভয় ও শত্রুবিনাশী হিসাবে চিহ্নিত। দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ, ভয় ও শত্রু থেকে যিনি আমাদের রক্ষা করেন তিনি দুর্গা, তিনিই দুর্গতিনাশিনী।
দেবী সর্বমঙ্গলা, সর্বাভীষ্ট প্রদায়িনী, চামুণ্ডা, জগদ্ধাত্রী, শরণাগত-পালিকা, করালবদনা। দানবশক্তি সংহারের জন্য দেবী ভূমা থেকে ভূমিতে অবতীর্ণ হন। ভ্রামরী, নন্দা, উমা, ভীমা, অম্বিকা, রক্তদন্তিকা প্রভৃতি বিভিন্ন নাম ও রূপে মর্ত্যে দেবীর আগমন ঘটে। কলিহত জীবের কলুষনাশিনী দুঃখহারিণী মা জীবের ক্রোধরূপী মহিষাসুর, শতকামনারূপী রক্তবীজ আর অহংকার ও মোহরূপী শুম্ভ-নিশুম্ভকে বিনাশ করে সুর অর্থাৎ সত্যকে উদ্ধার করেন। তাঁরই কৃপায় জীবের অন্তরের অন্ধ ‘তম’নাশ হয়ে শুভ সমুজ্জ্বল জ্ঞান সূর্যের উদয় হয়। তিনি আমাদের অশুভ, অন্যায় ধ্বংস করে শুভশক্তি প্রদান করেন। মায়ের কৃপায় আমরা সর্বমোহ, অন্ধকার ও অসুরের প্রভাবমুক্ত হয়ে শাশ্বত সত্যের সন্ধান লাভ করতে পারি। আর এজন্যই মা দুর্গা দেবীর আরাধনা, মাতৃবন্দনা।
মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রী শ্রী চণ্ডীতে দেবী বলেছেন :
‘এই জগতে আমার দ্বিতীয় আর কেহই নাই। ’ পূরাণতন্ত্রে এই অদ্বৈততত্ত্ব দেবীতত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্যরূপে বর্ণিত। নানাভাবে প্রকাশ একই মহাদেবীর ভিন্নরূপ মাত্র। দশভূজা দেবী দশদিগন্ত আবৃত করে আছেন মহাশক্তিরূপে। তাঁর জ্ঞানচক্ষুতে দৃশ্যমান ত্রিভুবন। কবির ভাষায়ও প্রকাশিত সেই রূপ :
বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমারই প্রতিমা গড়ি
মন্দিরে মন্দিরে।
মা দুর্গার নবরূপের মধ্যে প্রথম রূপটি শৈলপুত্রী নামে প্রসিদ্ধ। পর্বতরাজ হিমালয়ের কন্যারূপে জন্ম নেয়ায় তিনি এই নামে পরিচিতা। মাতৃদেবীর দ্বিতীয় রূপ ব্রহ্মচারিণী। দেবী ব্রহ্মচারিণী রূপ জ্যোতিতে পূর্ণ শক্তিরূপে বিরাজিতা। তাঁর তৃতীয় শক্তির নাম চন্দ্রঘণ্টা। এই রূপে দেবী পরম শান্তিদায়িনী ও কল্যাণকারী। সূর্যমণ্ডলের অন্তর্লোকে বাস করেন বিধায় দেবীর চতুর্থ রূপের নাম কুষ্মাণ্ডা। তিনিই জগতের আদিস্বরূপা, আদিশক্তি। চতুর্ভূজা হয়ে দেবী সাজেন স্কন্ধমাতা। কখনো কাত্যায়নী, কালরাত্রি আবার কখনো মহাগৌরী কিংবা সিদ্ধিদাত্রীরূপে মায়ের আগমন ঘটে সপরিবারে। শিয়রে উচ্চ মঙ্গলময় শিব, সঙ্গে সিদ্ধিদাতা গণেশ, সেনাপতি কার্ত্তিক, বিদ্যাদেবী সরস্বতী, ধনদাত্রী লক্ষ্মীকে নিয়ে জননীর আগমন-এ যেন ভূমিতে ভূমার সন্দেশ। দনুজদলনী দশভুজা দুর্গার আগমনী বার্তা তাই হৃদয়ে জাগায় শিহরণ।
দেবীর আশীর্বাদে ত্রেতাযুগে লঙ্কারাজ রাবণ হয়েছে পরাক্রমশালী। আবার অবতার শ্রী রামচন্দ্রের আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে জানকী দেবীর উদ্ধার প্রক্রিয়ায় পাপাচারী রাবণ বধে দেবী জুগিয়েছেন শক্তি। এসবই মায়ের লীলা। শরতের শিউলী ছড়ানো চাদরে চরণ রেখে যেমনি দেবী আসেন, তেমনি আগমন ঘটে হেমন্তের কাশফুলের মৃদু সমীরণে কিংবা বসন্তের কোকিল ডাকা প্রহরে। শরতে দেবীর আবাহনকে বলা হয় অকালবোধন।
চট্টলতীর্থ বোয়ালখালীতে মেধস মুনির আশ্রমে দুর্গা মায়ের আরাধানায় মগ্ন রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি’র স্মৃতিচিহ্ন আজ অমর কাব্যের একটি অংশ। প্রতিটি পূজার মণ্ডপে ষষ্ঠী, সপ্তমী, মহাষ্টমী এবং মহানবমীতে বসে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের মহামিলন-উৎসব। ব্রাহ্মণের পূজা, হোম ও মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ধ্বনিত হয় সুমঙ্গল শঙ্খ ও ঘণ্টা। অপার্থিব আনন্দ আর ভক্তিতে উদ্বেলিত নর-নারী সমস্ত মন প্রাণ ঢেলে দেয় মায়ের চরণে। দেবী আরাধনার হোমানলে পরিশুদ্ধ হয়ে ভক্তকুল সকল বাধা-বিঘ্ন ভেদাভেদ ভুলে মাতৃমন্ত্রে জাগ্রত হয়ে ওঠে। ভক্তি অর্ঘ্য দিয়ে সাজায় হৃদয়। ঢাকের তালে ধূপ-দীপের আরতিতে বরণ করে নেয়া হয় জননীকে। সকল আত্মা একই সুরে সুর মেলায়। আসুরিক প্রবৃত্তি ভুলে অন্তর পরিশুদ্ধ করার নিরন্তর চেষ্টা চলে পুষ্পশোভিত চরণযুগলে নিজেকে উৎসর্গ করে দিতে।
লেখক : অধিপতি-ঋষিধাম, বাঁশখালী, মোহন্ত মহারাজ-তুলসীধাম, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম
বাংলাদেশ সময়: ২২০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৩
জেএম/আরআইএস