গণমাধ্যমের রক্তচাপ মাপার কী কোনো যন্ত্র আছে? আমার জানা নেই। যদি তেমন কোনো যন্ত্রের কথা জানা থাকতো, তাহলে মেপে দেখতাম।
আমি নিশ্চিত এ মূহুর্তে গণমাধ্যমের রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রায় নেই। চাপটি গণমাধ্যম ভেদে দুই রকমই আছে। কোনো গণমাধ্যম নিম্নচাপে আছে। অবার কোনো গণমাধ্যম ভুগছে উচ্চচাপে। গণমাধ্যমের এ হাইপারটেনশন বাড়ছে। কারণ বর্তমান সরকারের মেয়াদ ‘কাউন্ট ডাউন’ পর্যায়ে চলে এসেছে। এ সময়ে গণমাধ্যম পড়েছে দ্বিমুখী চাপে।
পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগ অবধি টেলিভিশন চ্যানেল এবং অনলাইন ও কাগজের সংবাদপত্রে মহাজোট সরকারের এক রকম স্পষ্ট প্রতাপ ছিল। সরকারের মৃদু নির্দেশনাকেই পাথেয় হিসেবে নিতে বাধ্য হতো গণমাধ্যমগুলো।
গণমাধ্যমের ওপর সরকারি-বেসরকারি প্রভাব আঁচ করতে চাইলে নজর রাখতে হবে প্রতিদিনের টেলিভিশন চ্যানেলের পর্দায়। সেখানে তাৎক্ষণিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হয় (অবশ্য এখন দু একটি মূলধারার অনলাইনেও পাঠকেরা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
যে দর্শকেরা নিয়মিত নজর রাখেন তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন—চারদলীয় জোট সরকারের আমলে লাইসেন্স পাওয়া চ্যানেলগুলোও একটি পর্যায়ে মহাজোট সরকারের ভয়ে কাবু ছিল। আর যারা মহাজোট সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স প্রাপ্ত তারাতো সংগত কারণেই সমীহ দেখাবেন।
একটি বিষয় তো খোলামেলাভাবে সবারই জানা-সরকারের ক্ষমতা অফুরান। সেই অফুরান ক্ষমতা দিয়ে সরকার যেকোনো সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করতে পারে। সেই কথা স্মরণে রেখেই চারদলীয় সরকারের সময়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত টেলিভিশনগুলোও সরকারের বিরাগভাজন হতে চায়নি।
তারা একটি পর্যায় অবধি সরকারের তালেতালেই সময় অতিবাহিত করেছে। বলে রাখা ভাল দুটি চ্যানেলের সম্প্রচার সরকার বন্ধ রেখেছে। ওই দুটি চ্যানেলের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে বিতর্ক থাকার কারণে এমনটাই করা হয়েছে। তবে কোনো চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়াটা মোটেও সমর্থণযোগ্য নয়।
মোটামুটি গণমাধ্যমগুলো সরকারের সঙ্গে তাল রেখে, বিরোধীদলের যতটা সম্ভব কাভারেজ দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পাঁচটি সিটি করপোরেশনে বিএনপি জয়ী হওয়ার পর গণমাধ্যমগুলো নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে থাকে।
এরই মধ্যে সরকারও তার মেয়াদের শেষ মাইলফলকের দিকে এগোতে থাকে। এ অবস্থায় বেশিরভাগ গণমাধ্যম বিরোধীদলের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে থাকে। তাদের ধারণা ভোটের হাওয়া বিএনপি’র দিকে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯১ সালের পর থেকে যে রেওয়াজ চলছে তাতে জনগণ আগামীতে বিএনপিকেই ক্ষমতায় নিয়ে আসতে পারে। এ সমীকরণে তারা সরকারি দলের নির্দেশনে আগের মতো গাঢ়ভাবে আর আমলে নিচ্ছে না।
বিশেষ করে যারা অপেক্ষাকৃত পেশাদার সাংবাদিকতা করতে চায়, সেই গণমাধ্যমগুলো। লক্ষণটি বুঝতে পেরে বিরোধীদলের প্রত্যাশা যেমন বেড়েছে, তেমনি সরকারি দলও তাদের পাওনা বুঝে নিতে চায়। বিশেষ করে তাদের মাধ্যমে যে গণমাধ্যমগুলো আলো’র মুখ দেখেছে দাবি তাদের প্রতিই বেশি।
কেউ কেউ সেই দাবিও মেটাচ্ছে। কিন্তু যারা পাঠক, দর্শকের আস্থায় থাকতে চান এবং এ আস্থা থেকেই দু পক্ষের কাভারেজ দিতে চান তারা সেই দাবি মেটাতে মিতব্যয়িতা দেখাচ্ছে।
এ ছাড়া অতীত অভিজ্ঞতা থেকে গণমাধ্যমগুলো ভবিষ্যতে কারা মসনদে বসছেন, সেটিও বিবেচনায় রাখতে চায়। কাউকেই মনক্ষুণ্ন করতে চান না তারা। কারণ ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে কারো তোপের মুখে পড়তে চায় না পেশাদার গণমাধ্যমগুলো। তাই তারা এখন সমবন্টণে বিশ্বাসী।
এ সমবন্টন করতে গিয়েই চাপের মুখে পড়ছে গণমাধ্যম। বিরোধীদল আপাতত যা পাচ্ছে তাতেই সন্তুষ্ট। তবে বিবেচনায় রাখছে বা টুকে রাখছে কে কতটা দিচ্ছে। পরে ক্ষমতায় গেলে হয়তো আমলনামা প্রকাশ করা হবে। সেই অনুযায়ী ব্যবহার পাওয়া যাবে।
আর সরকারি দল বরাবরের মতোই, অর্থাৎ যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা শেষদিকে এসে তাদের বিদায়টা যেমন সহজে মেনে নিতে পারে না। তেমনি গণমাধ্যমের পাল্টে যাওয়াকেও মেনে নিতে চায় না। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিমান, রাগ প্রকাশ করতে থাকে। তার প্রভাবটিও হয় নেতিবাচক। যার দায় সরকারি দলকেই বহন করতে হয়।
এ বাস্তবতায় অক্টোবর যতো ফুরিয়ে আসছে। পঞ্জিকার পাতা যতোই ২৫ অক্টোবরের দিকে এগোচ্ছে ততোই দু্ পক্ষ গণমাধ্যমের ওপর চড়াও হচ্ছে। গত সাড়ে চার বছরে দেখা গেছে সরকার-বিরোধীদলের কর্মসূচিগুলো বারো আনাই ছিল গণমাধ্যম বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলনির্ভর।
আগামী নির্বাচন বা তার আগে যদি বিরোধী দল আন্দোলনে মাঠে নামে, তাহলে সেখানেও গণমাধ্যম বিশেষ ভূমিকা রাখবে। কে কতটা, কাকে কাভারেজ দিচ্ছে সেটা পাঠক, দর্শকের মতো দলগুলোও হিসেবে রাখবে। তাই অনাগত দিনগুলোতে রাজনৈতিক চাপ সামলে নিজেদের আমলনামার ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে গণমাধ্যমগুলো এখন হাইপারটেনশনে আক্রান্ত।
বাংলাদেশ সময়: ১২০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৩
এডিএ/এসএইচ/এডিবি