এমনভাবে এসে আতিথ্য নেয় আমাদের মাঝে টেরই পাওয়া যায় না। শিশিরের শব্দের মত নীরবে আবির্ভাব।
কার্তিকের সঙ্গে অবশ্য আশ্বিনের ভালোমন্দের বেশ বোঝাপড়া রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে একসময় ‘গাষ্মি’ হতো জাঁকজমক আয়োজনে। ফরিদপুর, খুলনা অঞ্চলে বেশি দেখা যেত। আশ্বিনের শেষ দিনের সঙ্গে কার্তিকের প্রথম দিনের একটা অলিখিত বন্ধন তৈরি করা। আশ্বিনের শেষ দিনের শেষ রাতে রান্নাবান্না হতো, কার্তিকের প্রথম প্রহরে চলতো খানাপিনা। মেয়েরা কার্তিকের ভোরে উঠে দল বেঁধে নাইতে যেত নদীতে। চোখে মোটা করে কাজল দেওয়ার রেওয়াজ ছিল সে সকালে। শাপলা দিয়ে চুল ঝাড়ার প্রথাটা ছিল সবচেয়ে মজার।
তারপর একসঙ্গে গত মাস আশ্বিনে রান্না করা খাবারের স্বাদ ভক্ষণ। ভাদ্রে জমানো তালের আটি থেকে যে শাঁসের সৃষ্টি হতো কার্তিকের প্রথম সকালে তার যে স্বাদ কে কবে সেই বর্ণনা দিতে পেরেছে। এর প্রতিটির রয়েছে আলাদা মাজেজা।
সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা ছিল কাক জেগে ওঠার আগেই। শাপলা দিয়ে চুল ঝাড়লে মেয়েদের চুল শাপলার মতই লম্বা হবে, চোখে কাজল দিলে সারাবছর চোখদু’টি থাকবে কৃষ্ণবর্ণের। মজার একটা কোরাসও প্রচলিত ছিল। ‘আশ্বিনে রান্দে/ কার্তিতে খায়/ যে বর মাঙ্গে/ সেই বর পায়। ’ সময়টা কেমন ধোঁয়াটে রহস্যময়। না শীত না গরম। তবে শীত যে আসি আসি করছে এটা স্পষ্ট বুঝতে কষ্ট হয় না। অবশ্য আশ্বিনের প্রথমার্ধে গায়ে শীতের কাঁটা বসানোর কথা থাকলেও সে রেওয়াজ বোধহয় প্রকৃতি ভুলতে বসেছে। বলা হতো, ‘আশ্বিন, গা করে শীণ শীণ। ’
কার্তিকের আকাশ উপোভোগ্য। পরিচ্ছন্ন গগণে মাঝে মধ্যে শাদা মেঘও থাকতে পারে। শরতের রেশ বলা যেতে পারে। কার্তিকের জোছনা দেখলে যে কারোরই মনে হতে পারে, কেউ একজন দুধের পেয়ালা উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে যেন। রাত নেমে এলে গভীরে, জোছনা পাগল করে নদীরে। ধবল জোছনার হাতছানিতে কার্তিকের শান্ত নদীও নর্তকী হয়। ক্ষেতের ধান পাকে এই কার্তিকেই। নবান্নের আয়োজন সম্পন্ন করার সময় এখন। কবিকুল আকুল থাকেন সৃষ্টিশীল মাসের মহিমা দেখে। জসীম উদ্দীন নকশী কাঁথার মাঠে দারুণ বর্ণনা দিয়েছেন কার্তিকের। ‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান/ সারামাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হল্দি কোটার গান। /ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়/ কলমী লতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায়। ’
মাটি তার গর্ভের সম্পদরাজি উগরে দেবার জন্য কার্তিককেই মোক্ষম সময় হিসেবে নেয়। সবজি আর নাম না জানা হাজারো ফুল ফসলের পসরা বসে। খেসারি আর কলাই ফুলে বাড়ির পাশের মাঠকে পূর্ণ যৌবনবতী ললনার মত আন্দাজ হয়। রাতের শিশির সশরীরে নেমে এসে তাতে পূর্ণ করে ষোলকলা। জলাশয়, পুকুরের পানি কমতে শুরু করায় দেশি নানা প্রজাতির মাছে রসনার লিপ্সা খানিকটা মেটানো সম্ভব হয় কার্তিকেই। বাংলাদেশের সৌন্দর্য অথবা রূপের মহিমায় কার্তিক অনন্য। গুছিয়ে নিজেকে পরিপাটি করে রাখা সদ্য যৌবনোদ্বেল তরুণীর সঙ্গে যার তুলনা চলে সে আমাদের কার্তিক।
আহমেদ সজল: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ahmedsojol.ju@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৭১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৩
জেডএম/জিসিপি