তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র একটি দেশ বাংলাদেশ। জনসংখ্যার চাপ আর সেই সঙ্গে অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত এ দেশটিতে ক্ষুধাই হল প্রধান সমস্যা।
১৯৯০-এ স্বৈরশাসনামলের অবসানকালে এদেশে ক্ষুধার হার ছিল ব্যাপক। ‘বৈশ্বিক ক্ষুধাসূচক বা গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’র জরিপে সেসময় ক্ষুধাসূচকে বাংলাদেশ অ্যালার্মিং বা আশঙ্কাজনক দেশ হিসেবে চিহ্নিত ছিল।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ও ওয়েলথাংগারহিলফ নামের তিনটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যৌথ উদ্যোগে প্রতি বছর বৈশ্বিক ক্ষুধাসূচক নিরূপণ করে। তবে, শুধু ‘পেট ভরে ভাত খাওয়া’ মানেই ক্ষুধা থেকে মুক্ত হওয়া নয়। মূলত পুষ্টিহীনতা (undernourishment – অর্থাৎ জনসংখ্যার কত শতাংশ প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত ক্যালরি ইনটেক করে), শিশুদের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হওয়া (child underweight- অর্থাৎ ৫ বছরের নিচে কত শতাংশ শিশু স্ট্যান্ডার্ড ওজনের তুলনায় কম ওজনের হয়) ও শিশু মৃত্যুর হারের (child mortality- অর্থাৎ ৫ বছরের নিচে কত শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে মারা যায়) ওপর ভিত্তি করে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের ক্ষুধাসূচক ৠাংকিং করে এ তিনটি প্রতিষ্ঠান।
মোট ১০০ পয়েন্টের মধ্যে যে দেশের পয়েন্ট যত কম সে দেশ ক্ষুধাসূচকে তত ভালো অবস্থানে থাকে। পয়েন্টের ওপর নির্ভর করে লো, মডারেট, সিরিয়াস, অ্যালার্মিং, এক্সট্রিমলি অ্যালার্মিং ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন দেশকে র্যাংকিং করা হয়।
ক্ষুধাসূচকে পয়েন্ট ১০ থেকে ১৯.৯ এর মধ্যে হলে সে দেশকে সিরিয়াস ও ২০ থেকে ২৯.৯ এর মধ্যে হলে সে দেশকে অ্যালার্মিং ক্যাটাগরিভুক্ত করা হয়। আর পয়েন্ট যদি ৩০ এর ওপরে হয় তবে সেটাকে এক্সট্রিমলি অ্যালার্মিং ক্যাটাগরিভুক্ত করা হয়।
বৈশ্বিকম্যাপে কোন দেশ কী ক্যাটাগরিভুক্ত তা বোঝানোর জন্য ক্ষুধাসূচকে ‘লো’ ক্যাটাগরির দেশকে গাঢ় সবুজ, ‘মডারেট’ হালকা সবুজ, ‘সিরিয়াস’ হালকা কমলা, ‘অ্যালার্মিং’ গাঢ় কমলা, ও ‘অ্যাক্সট্রিমলি অ্যালার্মিং’ দেশগুলোকে লাল বর্ণে রঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হয়।
ক্ষুধাসূচকে বাংলাদেশের উন্নয়নের ওঠানামা ও সেই সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দু’টি দেশ ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের তুলনামূলক অবস্থান এক ঝলকে এ রকম-
ক্ষুধাসূচকে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের পয়েন্ট ছিল ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় অনেক বেশি। ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই অ্যাক্সট্রিম অ্যালার্মিং দেশ হিসেবে ক্যাটাগরিভুক্ত ছিল।
এদেশে গণতান্ত্রিক সরকারের আগমনের পর ধীরে ধীরে ক্ষুধাসূচকে আমরা উল্লেখযোগ্য হারে উন্নতি করতে সক্ষম হই। দেশের মানুষকে ক্ষুধামুক্ত করার লক্ষ্যে আমাদের অগ্রগতি ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় উৎসাহব্যঞ্জক। এই পথে গত এক বছরে আমরা ১০ ধাপ এগিয়েছি। ২০১২ সালে যেখানে বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে আমাদের অবস্থান ছিল ৬৮, সেখানে ২০১৩ সালে ক্ষুধাসূচকের পয়েন্ট কমে আমাদের অবস্থান এসে দাঁড়িয়েছে ৫৮তে। দশমিক এক পয়েন্ট নিয়ে পাকিস্তান আমাদের এক ধাপ সামনে থাকলেও পয়েন্টের দিক থেকে তেমন অগ্রগামী তারা নয়। অন্যদিকে ভারতও আমাদের থেকে অনেক পিছিয়ে ৬৩ নম্বরে রয়েছে।
তবে একথা সত্য যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের প্রায় পুরো সময় ২০১০ থেকে ২০১২ পর্যন্ত আমাদের র্যাংকিং ছিল ৬৮তে। পয়েন্টের তেমন নিম্নগতি হয়নি। অর্থাৎ ক্ষুধাসূচকে আমাদের তেমন উন্নতি লক্ষ্য করা যায় নি।
আশার কথা, গত এক বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই এ দেশ ক্ষুধাসূচকে উল্লেখযোগ্য হারে উন্নয়ন করেছে। তবে আমরা এখনও ‘সিরিয়াস’ ক্যাটাগরিভুক্ত। কারণ, যে তিনটি সূচকের ভিত্তিতে ক্ষুধাসূচক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়, সেগুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনো নাজুক। শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও এদেশে এখনো জনগণের পুষ্টিহীনতা ও শিশুদের স্বল্প ওজনের হার অনেক বেশি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কথা প্রায়ই বলে থাকেন বলে পত্র-পত্রিকা মারপত জেনেছি। ক্ষমতার শেষ বছরে অবশ্যই তার সরকারকে এক্ষেত্রে সফল বলা যায়। তবে এই সূচকের হার আগামীতে আরও কমিয়ে আনার ধারাবাহিকতা নিঃসন্দেহে নির্ভর করবে আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ফসলের উত্পাদনশীলতা, ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগহীনতাসহ অন্যান্য ফ্যাক্টরের ওপর।
১৯৯০ থেকে ২০১৩। ২৩ বছরে ক্ষুধাসূচকে অ্যালার্মিং থেকে সিরিয়াস- গাঢ় কমলা বর্ণ থেকে হালকা কমলা বর্ণে পৌঁছাতে আমরা সক্ষম হয়েছি। আমরা এখন অবশ্যই স্বপ্ন দেখতে পারি হালকা কমলা বর্ণ থেকে গাঢ় সবুজ বর্ণের। কারণ ক্ষুধাসূচকে গাঢ় সবুজ হল সব থেকে কম ক্ষুধার ক্যাটাগরিভুক্ত দেশের প্রতীক, যেখানে পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে একটি শিশুও পুষ্টিহীনতা কিংবা অকালমৃত্যুর শিকার হবে না।
সেইদিন হয়ত বেশি দূরে নেই, যেদিন আমাদের ক্ষুধার রং পাল্টে যাবে। ক্ষুধার রং হবে সবুজ, গাঢ় সবুজ - ঠিক আমাদের মানচিত্রের মতই।
জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৩
এসএটি/জিসিপি/জেএম