কবিতা লেখার কারণে কবি বেলাল চৌধুরীর সাথে সাহিত্যের পরিমণ্ডলে প্রকাশ্য একটা সম্পর্ক রয়েছে। আর ব্যক্তিগতভাবে তাঁর ভাই গিয়াস কামাল চৌধুরীর সাথে অন্যরকম একটি আন্তরিক সম্পর্ক ছিলো।
প্রয়াত সাংবাদিক আতাউস সামাদ সম্পর্কে এক লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, ‘ডানপন্থী অনেক সাংবাদিকদের সাথে আমার মতের মিল নেই, কিন্তু মনের মিল আছে। তাঁদের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক চমৎকার। তাঁরা হলেন- গিয়াস কামাল চৌধুরী, শফিক রেহমান, আসাফ উদ দৌলা, আল মুজাহিদী থেকে শুরু করে আব্দুল হাই শিকদার পর্যন্ত’। (কাছের মানুষ দূরের মানুষ, প্রকাশক: বাংলা প্রকাশ, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৩, ঢাকা, পৃষ্ঠা/ ৭০)
তবে, এরশাদের শাসনামলে তার পাঠানো একটি ভূয়া নিউজের প্রেক্ষিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধেছিলো। সেটা নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু কোনোদিন করা হয়নি।
এসব রাজনৈতিক মতাদার্শের কারণেই বেলাল ভাই আর গিয়াস ভাইয়ের মধ্যে ‘দূরত্ব’ ছিলো। কিন্তু দুই ভাই-ই ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। প্রাবন্ধিক মোতাহার হোসেন চৌধুরী ছিলেন তাদের চাচা। ‘চির সুমধুর’ কাব্য গ্রন্থের রচয়িতা মুনীর আখতার খাতুন চৌধুরাণী ছিলেন তাঁদের মা। আরেক চাচা ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খশরু।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে ছিলো তাঁদের পারিবারিক সম্পর্ক। ফলে তাঁদের মধ্যে ছিলো পারিবারিক এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। যদিও গিয়াস কামাল চৌধুরী সাহিত্যিক ছিলেন না। তবে সাংবাদিক হিসেবে তিনি ছিলেন একজন স্বার্থক এবং সৎ সাংবাদিক। ব্যক্তি জীবনেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত সহজ সরল, নিরহঙ্কার, সাদামাটা, সাধারণ মানুষ। যা এ যুগে খুঁজে পাওয়া কঠিন।
একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরীর সাংবাদিকতা করেন ১৯৬৪ সালে ইত্তেফাক গ্রুপ থেকে প্রকাশিত ‘ঢাকা টাইমস’ পত্রিকার মাধ্যমে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় যোগদান করেন। পেশাজীবীদের অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। সাংবাদিক জীবনে গিয়াস ভাই বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ও ভয়েস অব আমেরিকাসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থায় কাজ করেছেন। লন্ডনের হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার ছিলেন। একাধিকবার ডিইউজে, বিএফইউজে ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতি ছিলেন। তবে জীবনের শেষ সময়ে এসে অবহেলা আর অনাদরে ছিলেন। কেউ তাঁর খোজ খবর রাখেননি, কেউ তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়নি। অনেকটা অভিমান আর কষ্ট নিয়ে চলে গেছেন গিয়াস কামাল চৌধুরী।
ছোটখাটো মানুষটির উদারতা আর আন্তরিকতা ছিলো হিমালয়তুল্য। তিনি সব সময় মানুষের উপকার করার চেষ্টা করতেন। আমি ব্যক্তিগতভাবেও উপকৃত হয়েছি। তার ২/১ টা উদাহরণ দিচ্ছি। ১৯৮৫ সালে আমরা ‘সুন্দর’ সংগঠন থেকে সুন্দরী প্রতিযোগিতার ঘোষণা দেই। সেই সংগঠনের অন্যতম উপদেষ্টা দিলেন গিয়াস ভাই। খবরটি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের সাথে সাথেই মৌলবাদীরা ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়াস ভাইয়ে কাছে গিয়েছেন এবং তারা আন্দোওলনের কর্মসূচি দিয়েছেন। পরে গিয়াস ভাই বললেন, কবি, তাদের সাথে আমরা পারবো না। সুন্দরীদের চিন্তা-ভাবনা বাদ দেন।
১৯৯৬ সাথে মেজর জেনারেল আনোয়ারুল কবীর তালুকদার আমাকে চাকরিচ্যুত করলে তার প্রতিবাদ করে আমাকে মানসিকভাবে খুব সাহায্য করেছিলো। আরেকবার আমার প্রকাশনীর একটি বই নিয়ে মৌলবাদীরা আন্দোলনে নামলে, তা নিয়ে দৈনিক ইনকিলাবে প্রতিদিন প্রথম বা দ্বিতীয় পাতায় উস্কানিমূলক এবং প্রতিহিংসা পরায়ন মিথ্যে খরব ছাপা হচ্ছিলো। তা কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছিলো না। তাতে আমার জীবন প্রায় বিপন্ন হচ্ছিলো। তখন গিয়াস কামাল চৌধুরী উদ্যোগ নিয়ে সম্পাদককে ফোন করে আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।
কিন্তু কোনোদিনই সরাসরি সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়নি। আজ তাঁকে হারিয়ে খুব কষ্ট হচ্ছে, একা একা লাগছে। মনে হচ্ছে, গিয়াস কামাল চৌধুরী মারা যাননি। তিনি বেঁচে আছেন আমার বুকের মাঝখানে। ঝাপসা চোখে ভাবছি, আবার দেখা হলেই হয়ত বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলবেন, বেয়াই সাহেব, কবি সাহেব, কেমন আছেন? কিন্ত বাস্তবে সেই সান্নিধ্য আর কোনো দিনই পাবো না।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৩
এমজেএফ/জেসিকে