দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার গুরুদায়িত্ব প্রধানত পুলিশ বাহিনীর ওপর ন্যাস্ত। অনেক ভালো কাজ করলেও দুঃখজনকভাবে ঘুষ আর চাঁদাবাজির তকমার নিচে ঢাকা পড়ে যায় বাংলাদেশ পুলিশের কৃতিত্ব।
সম্প্রতি থানা-হাজতে আসামির মৃত্যু, ধর্ষণ কিংবা রিমান্ডের নামে অযাচিত নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। পুলিশকে ঘিরে মাঝে মধ্যেই ‘রক্ষক যখন ভক্ষক’ বা ‘সরষের ভেতরে ভূত’ টাইপের শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়।
পুলিশের ভালো কাজের প্রশংসার খবর যে একেবারে দেখা যায় না, এমনও নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে পুলিশের গৌরবময় অবদানের কথা আমরা কমবেশি জানি। জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তারপরও সার্বিকভাবে পুলিশের প্রতি অধিকাংশ মানুষের রয়েছে নেতিবাচক মনোভাব। বিপদের বন্ধুর কাছে গিয়ে আরও বিপদে পড়ার ভয় অনেকের মধ্যে।
পুলিশের বর্তমান এ অবস্থার পেছনে রয়েছে নানাবিধ কারণ। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে আমরা পুলিশকে বর্তমান অবস্থায় আসতে উৎসাহিত করেছি। অনেকটা বাধ্য করা হয়েছে বলা যায়। ব্যক্তি হিসেবে একজন পুলিশের দোষ যতটা নয় তার চেয়ে বহগুণ পদ্ধতিগত। রাজনৈতিক জটিলতা ও রাজনীতিবিদদের আদর্শিক দৈন্যের জন্যই প্রধানত এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
কথায় বলে- স্বভাব যায় না ধুলে। আমাদের দেশের পুলিশের অবস্থাও অনেকটা সেরকম। এদেশে পুলিশের সূচনা হয় বৃটিশদের মাধ্যমে। উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশদের স্বার্থ সংরক্ষণ। মূলত জমিদার, জমাদার, তালুকদার, সামন্ত প্রভৃতি ভূপতিদের পোষ্য লাঠিয়াল বাহিনীর উন্নত সংস্করণ হলো বর্তমান পুলিশ।
লাঠিয়াল বাহিনীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমরা কম-বেশি জানি। বিভিন্ন দেশে জনগণ বা প্রজাদের কল্যাণ চিন্তায় পুলিশের উৎপত্তি হলেও আমাদের দেশে ছিল তার উল্টো। প্রজা-শাসন, বিদ্রোহ-দমন বা নিষ্পেষণের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন ও রাষ্ট্র ক্ষমতা ধরে রাখাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।
ইংরেজদের কাছে ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের মাধ্যমে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতা সূর্য অস্তনমিত হয়। তার ৩৫ বছর পর ইংরেজরা এ অঞ্চলের জন্য পুলিশ রেগুলেশন জারি করে। যার মাধ্যমে জমিদাররা নিজস্ব পুলিশ বাহিনী রাখার অধিকার হারান।
১৮৫৭ সালে ঘটে যায় সিপাহী বিপ্লব। সিপাহী বিপ্লবের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে ইংরেজরা সাদা চামড়াধারী সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর পাশাপাশি এদেশীয় মানুষ নিয়ে অন্য একটা অস্ত্রধারী বাহিনী গঠন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সে ধারাবহিকতায় ১৮৬১ সালে প্রণীত হয় পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল। বন্যা, খরা, মড়ক, দুর্ভিক্ষ, মহামারী যাই ঘটুক জোর করে কৃষক দমনের মাধ্যমে খাজনা আদায় ছিল তাদের মূল কাজ। পাশাপাশি কৃষকদের স্বাধীকার আদায়ের আন্দোলন দমন করা হতো কঠোর হাতে।
পুলিশ বা লাঠিয়াল যাই হোক, প্রায় দুইশ’ বছর ধরে চলে একই ধরনের নির্যাতন। উৎপত্তি ও উদ্দেশ্যগত দুই ক্ষেত্রেই পুলিশ ছিল জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীত।
ধীরে ধীরে আমাদের অস্থি-মজ্জার সঙ্গে মিশে যায় রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে পুলিশকে দিয়ে বিরোধীমত দমনের প্রবণতা, পুলিশ হিসেবে অত্যাচার করার প্রবণতা বা জনগণ হিসেবে অত্যাচারিত হওয়ার ভয়। জনসাধারণের কাছে পুলিশ হয়ে ওঠে ভয় বা অত্যাচারের প্রতীক। আজো অনেক সময় বাচ্চাদের পুলিশের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানো, খাওয়ানো বা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্য কোনো কাজ করানো হয়।
আজকে বাংলাদেশে পুলিশকে যখন অস্ত্র হাতে সরকার বিরোধী মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালাতে দেখি, তখন কল্পনায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নির্যাতনের দৃশ্য ভেসে ওঠে। তবে তখন ছিলো বৃটিশ সরকার আর এখন জনগণের নির্বাচিত সরকার, পার্থক্য এতটুকুই।
পার্থক্য থাকলেও তিনটি বিষয়ে সব সময়ই দারুণ মিল রয়েছে। এক. আজকের মতো বৃটিশ আমলেও জনগণই গুলি খেত। দুই. কেবলমাত্র বৃটিশদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার জন্য ছিল সব আয়োজন আর এখন সরকারি দলের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। তিন. তখনকার মতো আজও পুলিশ হুকুমের দাস। তবে নির্যাতনের এ ক্ষেত্র আরও প্রশমিত হয়েছে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও ৠবের কারণে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় বৃটিশ সরকারের তুলনায় অত্যাচারের দিক থেকে আজকের বাংলাদেশ অনেক বেশি অগ্রগামী। প্রশ্ন জাগে, এ জন্যই কি বৃটিশ বা পাকিস্তান থেকে স্বাধীন দেশের উদ্ভব হয়েছিল? এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না!
পুলিশ জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে, কোনো দলের নয়। পুলিশ হবে জনগণ বা রাষ্ট্রের রক্ষক, সরকারের নয়। সেটাই কাম্য। পুলিশের পেশাদারিত্বের পরিচয় সেখানেই। বিজিবির প্রধান কাজ দেশের সীমান্ত পাহারা দেওয়া। সীমান্ত অরিক্ষত রেখে জনগণের ওপর গুলি চালানো তাদের জন্য শোভনীয় নয়। ফেলানিদের কাঁটাতারে ঝুলানো বা বাংলাদেশি বৃদ্ধকে মেরে সীমান্তে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা ছবি দেখতে সচেনত নাগরিক হিসেবে কার ভালো লাগে!
পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা তলানিতে ঠেকার কারণে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠিত এলিট ফোর্স ৠাবের ওপর মানুষের আস্থা ছিল আকাশচুম্বী। মুহূর্তেই তাদের অভিযোগ বক্স ভরে যেতো জনগণের অভিযোগে। তাদের রাজনৈতিক দলের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করতে দেখা গেছে। ৠাবের রয়েছে বিশ্বমানের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক। দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে তাদের ভূমিকা সবসময় প্রশংসনীয়। জননন্দিত সে বাহিনীকেও নির্লজ্জভাবে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমতাবস্থায়, জনগণের যাওয়ার জায়গা কোথায়?
বৃটিশ আমল থেকে শুরু করে ২০১৩ পর্যন্ত সব সময় দেখা গেছে সরকারের হুকুম তালিম করার জন্য পুলিশকে জনগণের ওপর কমবেশি স্টিম রুলার চালাতে হয়েছে। কথা ছিল পুলিশ ধীরে ধীরে সহনশীল, সভ্য বা নাগরিকবান্ধব হবে। আরো বেশি পেশাদারিত্বের পরিচয় দেবে। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে পুলিশের অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে আগামীতেও যদি বর্তমানের রেকর্ড ভাঙে সেক্ষেত্রে দেশের অবস্থা কি হবে তা ভেবে মাঝে মধ্যেই আতঙ্কিত হই।
হুকুম তালিম করলেও পুলিশের দোষ নেই সেটাও ঠিক নয়। অনেক সময় দেখা যায় সরকারি নির্দেশনার বাইরে আগ-বাড়িয়ে কয়েকগুণ বেশি করা হয়। গুলি করে বহু সংখ্যক মানুষ মারার ঘটনাও প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকাতে। তাই বলে ঢালাওভাবে সব পুলিশ একই কাজ করে তা আদৌ ঠিক নয়। সমাজের সুধীজনদের মতো আমিও বিশ্বাস করতে চাই সরকার জনগণকে পাখির মতো গুলি করে মারতে হয়ত বলেনি- এটাই গণতন্ত্রের ভাষা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
সরকার কর্তৃক তেমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়েছে। এমতাবস্থায়, কোনো সরকারকে জনগণের সরকার বলা কতোটা যুক্তিযুক্ত! বৃটিশ, পাকিস্তান, বাকশাল বা স্বৈরাচার যে কোনো নামে ডাকা যেতে পারে। অনেকে ইসরাইলের সঙ্গেও তুলনা করছেন।
ধরে নিলাম হাতে গোনা কিছু পুলিশ নিজ থেকেই গুলি চালায় বা চালিয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, তাদের এমন গর্হিত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টা পুরষ্কৃত করা হয়। পুলিশের সামনেই সরকার আশ্রিত সন্ত্রাসীদের বিরোধী দলের ওপর প্রকাশ্যে গুলি করতে দেখা যায়। পক্ষান্তরে, যারা গুলিবিদ্ধ বা আহত হয় তাদের জড়ানো হয় শতশত মামলায়। ময়লার গাড়িতে ঢিল মারার মামলাও দেওয়া হয়। থানা হাজতে ধরে এনে রিমান্ডের নামে করা হয় অকথ্য নির্যাতন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এমনকি স্কুল পড়ুয়া ছাত্রকেও দুর্ধর্ষ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মত ডাণ্ডবেরী পরাতে দেখা গেছে। যা নিতান্তুই অমানবিক। এমন অগ্রহণযোগ্য কর্মকাণ্ডকে সর্মথনের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে পুলিশের যাবতীয় কার্যক্রমকে উস্কে দেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে একই ধরনের বা আরও বেশি খারাপ কাজ করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। প্রতীয়মান যে, সরকারের প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন সমর্থনেই পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়।
লাইসেন্সধারী সরকারি পেটুয়া বাহিনীতে পরিণত হয় যা কোনো অবস্থায় কাম্য নয়। কাজেই পুলিশ নয় আগে সরকারকে ঠিক হতে হবে। দেশের রাজনীতির আকাশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যে ঘন-কালো ছায়া আজো বিদ্যমান তা সরিয়ে রোদ্রজ্জল করতে হবে।
বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশে নতুন এক ধারণা বা কনসেপ্ট প্রকট হয়েছে তা হলো- জনগণ বলতে সরকারি দলের নেতৃবৃন্দ ও তাদের সমর্থককে বোঝাবে। নাগরিক অধিকার, সুযোগ-সুবিধা মূলত তাদের মধ্যেই আবর্তিত হবে। সরকারি দলের বাইরে অন্য সবাইকে ক্রিমিনাল হিসাবে গণ্য করা হবে।
যতটুকু জেনেছি, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ দুর্ধর্ষ ক্রিমিনাল বা সন্ত্রাসীকে গুলি করতে পারে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার মিছিল মিটিং করা বা অন্যায়ের প্রতিবাদ বা মানববন্ধন করাকে যদি ক্রিমিনালদের কাজ হয় তাহলে গণতন্ত্রের কথা বলে মুখে ফেনা তুলে লাভ কি? সমীকরণ অনুযায়ী হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি যাদের মাধ্যমে সংগঠিত হয়, যাদের জন্য লাখ লাখ মানুষ রাতারাতি সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসে তাদের কি করা উচিৎ- ভাববার বিষয়। বুলেট ভর্তি একে-৪৭ হাতে কারো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কখনও বন্ধুত্ব হয় না। কাজেই প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের সত্যিকার পরিবর্তন।
দেশে অনেক মেধাবী ও দেশপ্রেমিক পুলিশ অফিসার রয়েছে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। জাতি বা জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার আলোকে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে চেষ্টা করেন। আমার মনে হয় তারা কখনোই চান না জনগণের ট্যাক্সের টাকা খেয়ে সেই জনগণের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে। জনগণের সঙ্গে এমন আচরণ করতে তাদের বিবেক হয়ত সায় দেয় না। বিজিবির সদস্যরাও নিশ্চয় সীমান্ত অরক্ষিত রেখে অস্ত্র হাতে নিজ দেশের মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চান না। কিন্তু সরকারের নির্দেশনার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক সময় তাদেরও গুলি চালাতে হয়। সুতরাং সমস্যা পদ্ধতিগত বা রাজনৈতিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়।
সব সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয় পুলিশকে। সারাদিন ছুটতে হয় সমাজের চোর, বাটপার, ক্রিমিনাল বা সন্ত্রাসীদের পেছনে। ২৪ ঘণ্টা অনডিউটিতে থাকতে হয় পুলিশকে। শুনেছি হরতালের সময় ভোর ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত জীবন হাতে নিয়ে ডিউটি করতে হয়। এভাবে কিছুদিন টানা ডিউটি করলে মন-মেজাজের বিশেষ পরিবর্তন হবে- এটাই স্বাভাবিক। এজন্য অনেক পুলিশের মনের অবস্থা এমন হয় যে, কাউকে মেরে বা অত্যাচার করে টাকা আয় করা বৈধ। তীব্র মানসিক চাঁপের মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করে সবার মন রক্ষা করা কষ্টকর। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও পুলিশ পায় না তাদের কাজের যথার্থ মূল্যায়ন।
একজন পুলিশ কনস্টেবল চাকরির শুরুতে সর্বসাকুল্যে ৭ হাজার টাকার মতো বেতন পান। দেশের দেড় লাখ পুলিশের সিংহভাগই কনস্টেবল পদের। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এ যুগে এত অল্প টাকায় কিভাবে একটা সংসার চলে- ভাবতে অবাক লাগে। উপরন্তু রয়েছে ব্যায়বহুল চিকিৎসা, সন্তানদের লেখাপড়া, বাবা-মা-ভাই-বোনের ভরণ-পোষণ বা বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার খরচ।
ঢাকা বা অন্য শহরে ভাড়া বাসায় থাকতে হলে অবস্থা কি হয়- সহজেই অনুমেয়। এমতাবস্থায়, সামাজিকভাবে আমরা পুলিশকে অসৎ হতে উৎসাহ দিচ্ছি বা বাধ্য করছি বলে মনে হয়। একজন সৎ পুলিশের বাসায় একরাত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আপ্যায়নের কমতি ছিলো না। তারপরও বুঝতে কষ্ট হয়নি স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে নিয়ে কি কঠিন জীবনযাপন করতে হয় তাদের।
সব পুলিশ এমন সৎ হবে তেমনটা আশা করা বাস্তবসম্মত নয়। পুলিশকে সত্যিকারভাবে মূল্যায়ন করতে পারলে সমাজের অপরাধ সিংহভাগ কমে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিলে পুলিশ অসৎ পথে টাকা উপার্জন ছেড়ে দেবে। জন্ম হবে না আর কোনো ঐশীর।
কাজেই পুলিশকে যথাযোগ্য মূল্যায়নের মাধ্যমে সম্মানিত করা গেলে সমাজ পরিচ্ছন্ন হওয়ার পাশাপাশি পুলিশকেও ২ টাকা, ৫ টাকা বা একটি সিগারেট ঘুষ নেওয়ার অপবাদ শুনতে হবে না।
দক্ষিণ কোরিয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা উচ্চ বেতন পান। পাশাপাশি একজন পুলিশকেও দেওয়া হয় ভারসাম্যপূর্ণ বেতন। যাতে করে উভয়েই একই জিনিস কিনতে পারেন। দুঃখজনক হলেও সত্য রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটা নিজেদের স্বার্থেই পুলিশকে বর্তমান অবস্থায় রাখতে বেশি আগ্রহী যাতে করে তাদের বিরোধীমত দমনের কাজে ইচ্ছেমত ব্যবহার করা যায়। কিন্তু দেশের স্থিতি, শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থায়ী গণতন্ত্রের স্বার্থে পুলিশকে তার প্রাপ্য মূল্যায়ন করা জরুরি।
সময় এসেছে বৃটিশ পদ্ধতিকে চূড়ান্তভাবে উৎপাটন করার। ভারত বা পাকিস্তানকেও আমরা অনুসরণ করতে পারি না। রসুনের সব কোয়ার একই গোঁড়া। জাপান, কোরিয়া বা অন্য কোনো দেশের পুলিশকে আমরা মডেল হিসেবে নিতে পারি। জাপানি পুলিশ গোটা পৃথিবীতে ভদ্র পুলিশ হিসেবে পরিচিত। চোরকেও তারা ‘দোরোবো সান’ বা ‘জনাব চোর’ বলে সম্মোধন করেন।
আমাদের দেশে পুলিশিং পদ্ধতি চালু করার আগে ১৮২৯ সালে বৃটিশরা তাদের নিজ বাসভূমে মেট্রোপলিটন পুলিশের মতো সুসজ্জিত আধুনিক পুলিশ বাহিনীর সূচনা করে। আশ্চর্যের বিষয়, সে পুলিশ বাহিনী ছিল জনগণের সেবার জন্য প্রতিষ্ঠিত। ব্রিটিশ সরকারের ভাল-মন্দ কাজ-কর্মের দায়ভার থেকে মুক্ত।
একথা পরিষ্কার যে, বৃটিশরা যে উদ্দেশ্যে আমাদের দেশে পুলিশ বাহিনী গঠন করেছিল তার সঙ্গে যে কোনো আধুনিক রাষ্ট্রের পুলিশের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। ১৯৪৭ সালে বৃটিশরা ফিরে গেলে শুরু হয় পাকিস্তান আমল। পাকিস্তান আমলও চলতে থাকে অনেকটা বৃটিশ স্টাইলে। বর্গীদের আমল শেষ হলেও বৃটিশদের সে ধারা থেকে আমরা পুরোপুরি বের হতে পারিনি। কাগজে কলমে অনেক পরিবর্তন বা আধুনিকায়নের কথা, জনসেবা বা জনগণের বন্ধু হওয়ার কথা থাকলেও কেন জানি তার বহিঃপ্রকাশ তেমন দেখা যায় না।
জানা গেছে প্রধানত পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার লক্ষ্যে একটি খসড়া আইন বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা আছে। আইনটি সম্পর্কে বিস্তারিত না জানলেও পুলিশের নিয়ন্ত্রণগত পদ্ধতির পরিবর্তন আনার চেষ্টা হচ্ছে বোঝা যায়। বিষয়টা ইতিবাচক।
পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা সংগতকারণেই সমর্থনযোগ্য। কিন্তু পুরোপুরি বাঁধনহারা করার আগে অত্যাবশ্যকীয় পূর্বশর্ত হিসেবে প্রয়োজন দেশের রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা ও শক্তিশালী গণতন্ত্র চর্চার।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চা কোন পর্যায়ে আছে তা কারোর অজানা নয়। এমতাবস্থায়, নিরপেক্ষ কারো কাছে জবাবদিহিতার বিধান রেখে পুলিশকে স্বাধীনতা দেওয়া যেতে পারে। সর্বোপরি গণতন্ত্র, শান্তি, উন্নয়ন বা পরিচ্ছন্ন সমাজ গঠনের স্বার্থে পুলিশকে তার প্রাপ্য মূল্যায়ন করা হোক- এটাই সবার কাম্য। আ
ধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও তার জনকল্যাণমুখী চর্চা অতীব জরুরি। সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের অনুভূতি জাগানোর মাধ্যমে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ ও জবাবদিহিমূলক জনসেবা নিশ্চিত করা গেলে পুলিশের ওপর জনগণের কাঙ্খিত আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
লেখক পরিচিতি: ড. কেএইচএম নাজমুল হুসাইন নাজির
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
গবেষক: ইয়াংনাম ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া
ই-মেইল: nazirbau@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৩
এসএটি/জিসিপি