ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের মানদণ্ড

খালিদুজ্জামান এলিন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৩
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের মানদণ্ড

সব অসঙ্গতিই যেন আজ সঙ্গতি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে আমাদের সমাজ তথা দেশে। বিশেষ করে ৯০ দশকের পর থেকে।

আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো আমরা তা মেনেও নিয়েছি সহজেই।    

বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের মাপকাঠি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কয়েকটি প্রশ্ন স্বভাবতই সামনে এসে যায়। তা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের মানদণ্ড কী হওয়া উচিৎ? বর্তমানে মানদণ্ড কী এবং এর গুরুত্বই বা কী?

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে একাডেমিক রেজাল্ট, হোস্ট ইউনিভার্সিটির গুণগত মান, প্রার্থীর বাচনভঙ্গি, নৈতিকতা, একাডেমিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং, কমিউনিকেশন স্কিল, গবেষণা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। এসব বিবেচনা এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ যে চাকরি জীবনে তার অবস্থানকে সুনাম অর্জনের মাধ্যমে যেমন সুদৃঢ় করবে, ঠিক তেমনি দক্ষ জনশক্তি বা গ্রাজুয়েট তৈরি করতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করবে। ফলস্বরূপ নিজ প্রতিষ্ঠান কিংবা দেশকে বর্হিবিশ্বে সুপরিচিত করবে।

পক্ষান্তরে, যখন চারপাশে দেখতে পাই নিয়োগে মানদণ্ড হিসেবে দলীয়করণ (কে কত বেশি সক্রিয়), সুপারিশ হিসেবে নম্বর অব পারসন বা ফোন কল, ভিসি-ভাজন, রিজিওন, ধর্ম, পরোক্ষ আর্থিক লেনদেন ইত্যাদি তখন হৃদয় ব্যথিত হয়ে ওঠে। এসব বিবেচনা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোর অবস্থা যে নাজুক হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ পোষণ করার অবকাশ নেই।

কেননা কম বেশি প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এসবের চর্চা হয়ে থাকে। ফলে দৈনন্দিন অবনতি আমাদের চোখে পরিলক্ষিত না হলেও কয়েক বছরের ব্যবধানে তা ঠিকই অনুধাবন করা যায়।

আমাদের দেশের নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান অবস্থার দিকে তাকালে দেখতে পাবো যে তাদের অতীত শৌর্যবীর্য প্রায় হারাতে বসেছে। বিশ্বের নামকরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান নেই বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়েরও। উপরন্তু আমাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ নোংরা ও অস্থির পরিবেশ বিরাজ করছে।

শিক্ষক হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরুদণ্ডস্বরূপ। আর দলীয়করণ নানাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মেরুদণ্ড দুর্বল করে দিচ্ছে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যত বেশি ওয়েল কোয়ালিফাইড (গবেষণা ও একাডেমিক বিবেচনায়) সে বিশ্ববিদ্যালয় তত বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে। কিন্তু সেখানে যদি গর্মা কাঠের অনুপ্রবেশ ঘটে তাহলে তার অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

যখন দলীয়করণ নিয়োগে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়, তখন স্বভাবতই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধে জয়ী মেধাবী মুখগুলো আর মেধার চর্চা না করে দলীয় লেজুরবৃত্তির দিকেই আকৃষ্ট হবে। এটাই স্বাভাবিক। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি আরও সহজবোধ্য করা যেতে পারে। যখন কোনো পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীরা পরস্পরেরটা দেখে লেখার অবাধ সুযোগ পায় তখন ভালো শিক্ষার্থীদের কী ঘটে? লেখার ছন্দপতন ঘটে। তাছাড়া দলীয়করণের ফলে নিয়োগ পাওয়া বেশির ভাগ শিক্ষকই পরবর্তীতে একই চর্চায় লিপ্ত থাকে তাদের অবস্থান দৃঢ় করার জন্য। কেননা তারা সত্যিকারের মান দিয়ে টিকে থাকতে পারবে না।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের আরেকটি যোগ্যতা হচ্ছে ভিসিভাজন হওয়া কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রভাবশালী শিক্ষকের লেজুরবৃত্তি করা। আর এ সুযোগ অর্জন করতে শিক্ষক-ছাত্রের বাইরে ভিসি কিংবা ওই শিক্ষকের সঙ্গে বাড়তি যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে।

আর এরাই যখন শিক্ষক হবেন তখন তাদের ক্লাস পারফরমেন্স কেমন হবে তা বলাই বাহুল্য। ধিক তাদের প্রতি যারা তাদের পক্ষে সাফাই গান! এটা কি শিক্ষক নিয়োগের মানদণ্ড হতে পারে?

যেখানে বিবেচনা করা উচিত ছিলো প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা সেখানে বিবেচনা করা হয় ‘নাম্বার অব সুপারিশ কল’।

বিগত ও বর্তমান মন্ত্রী, এমপি এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে অনুরোধ বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ে গোটা দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করবেন না। দয়া করে বিশ্ববিদ্যালয়কে সুপারিশের বাইরে রাখুন। আর সুপারিশ যদি করতেই হয় সবচেয়ে ভাল প্রার্থীর জন্য করুন। কেননা একটি দেশ কত উন্নত তা নির্ভর করবে ওই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান এবং গবেষণায় কত উন্নত তার ওপর। আর এসব নির্ভর করে শিক্ষকদের গুণগত মানের ওপর।

নিয়োগের  আরেকটি মানদণ্ড হচ্ছে প্রার্থী কোন অঞ্চলের তা বিবেচনা। এর ওপর প্রার্থীর সফলতার কিংবা  ব্যর্থতার হার অনেকটাই নির্ভর করে। কোনো কোনো অঞ্চলের প্রার্থীদের জন্য মন্ত্রী এমপিদের সুপারিশ প্রয়োজন হয় না, ‘লোকাল’ শক্তিই তাদের জন্য যথেষ্ট। ফলে কিছু কিছু অঞ্চলের প্রার্থী ‘রিজিওনাল ইমব্যালেন্স’র দুষ্টচক্রে পতিত হচ্ছে।

বিগত সময়ে দলীয়করণের ফলে যেমন অনেকের জীবনে ছন্দনতন ঘটেছে ঠিক তেমনি ‘রিজিওনাল ইমব্যালেন্স’র কারণেও ঘটেছে একই ছন্দপতন। আর তাই হয়তো ওইসব মেধাবী মুখগুলো পাড়ি জমিয়েছে বিদেশে। তাদের বর্তমান অবস্থান দ্বারা প্রমাণ করতে পেরেছেন, তারা যর্থাথই যোগ্য ছিলেন এ পেশার জন্য। কিন্তু তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে।

সম্প্রতি কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীকে নাকি সমাবর্তন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সমাবর্তনের অধিকার ঠিক কোনো শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর তার জন্মগত অধিকারের মতোই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সঙ্গে সঙ্গেই  সমাবর্তন পাওয়ার অধিকার প্রাপ্ত হতে শুরু করেন একজন শিক্ষার্থী।

যারা যৌবনের গান গান, নতুন প্রজম্ম নতুন ভাবে দেশকে পরিচালনা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করেন, যাদের মাঝে আলো দেখতে পান তাদের অনেকেরই মাঝে আমি অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি। কেননা তাদের বলতে শুনেছি, তারা চাকরি না পেলে কারা পাবে। এতোদিন হলের বাইরে জীবন যাপন করতে হয়েছে, দলের জন্য এতো কিছু করেছেন।

যেখানে জাপান, সিংগাপুর, হংকংসহ  ‍অনেক দেশের  বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব অবস্থান পঞ্চশের মধ্যে সেখানে বাংলাদেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আমরা যদি নিয়োগের এসব দুষ্টু মাপকাঠি থেকে বেরিয়ে না আসতে পারি তাহলে আমাদের জন্য  আরও শোচনীয় অবস্থা অপেক্ষা করছে। যা আমাদের জন্য আরও বেশি আত্মঘাতী হতে পারে।

লেখক: খালিদুজ্জামান এলিন
শিক্ষক, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৩
এসএটি/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।