ঢাকা: দুই শ্রেণির লোক গভীর রাত অবধি জেগে থাকেন। এক. চোর ও দুই. টিভি টকশোর টকিস্ট।
গ্রামে মানুষ সিঁধেল চোরের যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারেন না। শহরের মানুষ- টকিস্টের যন্ত্রণায়। গভীর রাতে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো খুললেই তাদের দেখা যায়। এখানে গান হয় না, নাটক হয় না, বাদ্য-বাজনা হয় না।
যেন বাংলাদেশের মানুষের বিনোদন বলতে এই টকশো-ই। চ্যানেল ঘুরালে একই চেহারা, একই ব্যক্তি, একই কথা। গভীর রাতে তেলাপোকার মতো টকিস্টরা শহরের রাস্তায় এই চ্যানেল থেকে ওই চ্যানেলে দৌড়াদৌড়ি করেন। জামা পাল্টানোর সময়ও পান না। তবে এখানেও আশার আলো যে, আমাদের দেশে বাচাল লোক তথা টকিস্ট-এর সংখ্যা হাতে গোনা। তা না হলে ১৫ কোটি লোকের দেশে শুধু এই কুড়ি বিশেক লোককে টকশোতে দেখা যেত না।
এখানে আমার মনে হয়, টিভি চ্যানেলগুলো একটা সম্মিলিত উদ্যেগ নিতে পারেন। তারা যৌথ মালিকানায় একটি টকশো ভবন বানিয়ে তাতে টকিস্ট মার্কেট তৈরি করতে পারেন। সব চ্যানেলের স্টুডিও থাকবে ওই ভবনে। সেখানে রাজ্যের টকিস্টরা রাতে উপস্থিত হবেন। তারা হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে প্রতি রাতে নাম নিবন্ধন করবেন। যে চ্যানেলের যাকে দরকার তাৎক্ষণিক তাকে ডেকে নেবেন। এতে টকশোবিদদের দৌড়াদৌড়ির চাপ যেমন কমবে, তেমনি চ্যানেলগুলোর অতিথি সংকটও কমবে। উভয়পক্ষের লাভ।
টকশোর আসলেই কি চাহিদা আছে? চাহিদা না থাকলে এতো টকশো নির্মাণ হয়ই-বা কেন? এর কারণ, টকশো বানাতে টাকা কম লাগে। দু’জন অনিদ্রার রোগীকে ধরে এনে দুই দু’গুণে চার হাজার টাকা হাতে ধরিয়ে দিলেই অনুষ্ঠান শেষ। এতো কম খরচে অন্য কোন অনুষ্ঠান চিন্তাই করা যায় না।
টকশোর আলোচকরা জানেন না হেন কোন বস্তু নাই। বুধবার রাতে দেখলাম, একটি চ্যানেলে ছয় সাত জন আলোচক। আলোচনার মাঝে উঠে এলো হাসিনা-খালেদার কথোপকথন কিভাবে ফাঁস হলো।
একজন বললেন, মোবাইল অপারেটররা ফাঁস করতে পারেন। কেননা, তাদের কাছে সবার কল রেকর্ড তিন মাস পর্যন্ত থাকে! ছয় মাস পর্যন্ত ডাটা থাকে! ছয় মাস পর ডাটাও থাকে না(রেকর্ড আর ডাটার পার্থক্য কী? কেউ জানেন?)।
আরেকজন বললেন- ‘ ধুর! কী বলেন। এটা সম্ভব নাকি? পনের কোটি লোকের কল রেকর্ড করতে কত জায়গা লাগে, জানেন? এটা সম্ভব না। ইম্পশিবল!!’
আরেকজন বললেন- ‘আপনি জানেন না। আমাদের সব কল আমেরিকা ঘুরে যায়। ’
আরেকজন সমর্থন দিয়ে বললেন- ‘শুধু তাই নয়, আমাদের সব কল আমেরিকাতে রেকর্ড করা হয। সারা পৃথিবীর সব কল আমেরিকা সরকার রেকর্ড করে রাখে!!! চিন্তা করেন ব্যাপারটা!’
একেক জন তথ্য দিচ্ছেন। অন্যরা অবাক হচ্ছেন।
এই হচ্ছে একেকজনের জ্ঞানের নমুনা। আমি পুরো অনুষ্ঠান শুনলাম এবং দেখলাম। তারা একঘণ্টা যুদ্ধ করেও সমাধানে আসতে পারে নি, কে ফাঁস করেছেন রেকর্ডটি।
যদিও সকালে শেখ হাসিনা বলেছেন, কেন এটা সরকার প্রকাশ করেছে। টকিস্টদের কষ্ট দেখে ভাবলাম- আমি একটি ফোন দিয়ে তাদের তথ্যটা জানিয়ে দিই। তারা একেকজন যেভাবে চাপ নিচ্ছেন, তাতে যদি চাপটা কমে। টকশোর ফোনটি খালেদা জিয়ার ফোনের মতো রিঙ হয়, রিসিভ হয় না। ছোট্ট একটি তথ্য জ্ঞানের অভাবে তারা সারারাত বেহুদা চেঁচালেন- কে ফাঁস করেছে। কে ফাঁস করেছে।
তথ্য জ্ঞান খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস! আপডেট না থাকলে সমস্যা।
কেনেথ টাইলান বলেছিলেন- সমালোচক পথটা চেনেন, যদিও গাড়ি চালাতে পারেন না। আমাদের টকিস্ট বুদ্ধিজীবীদের দেখে আমার মনে হয় তারা পথটাও চেনেন না। বরং জাতিকে বিভ্রান্ত করে। টিভিতে সমঝোতার মিষ্টি মিষ্টি বিশ্লেষণ শোনান। কিন্তু পেশাজীবী সম্মেলনের নাম দিয়ে খালেদা জিয়াকে বলে আসেন- আপনি হাসিনার অধীনে নির্বাচন মানবেন না, আমরা আছি (ভয় নাই)। ইদানিং একজন গণতন্ত্রীপ্রেমী টকিস্টকে দেখলাম টিভি চ্যানেলে বোমা মারার জন্য আহ্ববান জানিয়েছেন। টিভি চ্যানেলগুলো শেষ হয়ে গেলে সেই টকিস্ট খোমা দেখাবেন কোথায় তা বোধহয় ভাবেন নি।
টকশো হতেই পারে। তা হোক সীমিত ও চিন্তিত। আমাদের দেশে হাতে গোণা আলোচকরা এতবেশি কথা বলেন, এদের চিন্তা করার সময় কই? চিন্তিত মতামত পাওয়া না গেলে টকশো করে লাভ কী? তার চেয়ে বরং গ্রামের চায়ের দোকানে ক্যামেরাগুলোক নিয়ে যান। সকালে হাল চাষে যাওয়ার আগে গ্রামের কৃষকরা চায়ের দোকানে বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দেন। তাদের কথাগুলো আমাদের শোনান। এতে টিভিতে যেমন বৈচিত্র আসবে, তেমনি গণমানুষের কথা আমাদের জানা হবে।
এরাই সরকারের পরিবর্তন করে। এদের কথা টকিস্টদের চেয়ে কম মূল্যবান না। তাদের ভেতর টকিস্টদের মতো না জেনেও সবজান্তা ভাব নেই, কিন্তু সারল্য আছে। গ্রামীণ প্রজ্ঞা আছে। কঠিন পরিশ্রম করে একটি ভূখণ্ডকে রাষ্ট্র করে তোলার মতো দৃঢ়তা আছে। যদি শোনাতেই হয়, চ্যানেলগুলো ওদের শোনাক।
চেহারা দেখানোর লোভে টিভি চ্যানেলের কাছে সস্তায় রাত বিক্রি করা টকেটিভদের কথা এখন আর কেউ শুনতে চায় না। মানুষ বিরক্ত। মানুষ বিনোদন চায়, বিরক্তি না।
মনোয়ার রুবেল: ব্যাংক কর্মকর্তা ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, monowarrubel@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৩
জেডএম/জিসিপি