ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সংখ্যালঘু হামলা অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিপন্থি

সাইফ উদ্দিন আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৩
সংখ্যালঘু হামলা অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিপন্থি

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। বিগত কয়েক বছর নির্বাচন পূর্ব, নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এ সময়কালে চরম উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটায়। নির্বাচন সামনে রেখে অনাকাঙ্ক্ষিত এ আশঙ্কা দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্যে পরিণত হতে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই।

রামুর মতোই গুজব ছড়িয়ে ২ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়ায় সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা চালায় একদল দুর্বৃত্ত। নিরক্ষর একটি পরিবারের সন্তান ফেসবুকে মহানবী সম্পর্কে কটূক্তি করেছে-  এরকম মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ২০-২৫টি বাড়ি, দুটি মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় আক্রান্তদের অনেকেই আত্মগোপন করেছেন। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক। নাগরিক সংগঠন ‘সুজন’ ন্যাক্কারজনক এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন।     

হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভোট মানেই একটা বিশেষ জনগোষ্ঠীর ভোট- এরকম একটা ধারণা আছে। এ ধারণার উপর ভিত্তি করে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার জনগোষ্ঠী নির্বাচনের সময় অহেতুক হুমকি-ধামকির সম্মুখীন হন। তাদের ভোট পাওয়া যাবে না ধারণা করে ভোটের আগেই তাদের বাড়ি ছাড়া করার পাঁয়তারা করা হয়। ভোটে হেরে গেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি।

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের সকল শ্রেণী-পেশা-সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল শোষণ-নির্যাতনের বিপক্ষে এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে।   অসাম্প্রদায়িক চেতনায় তৈরি হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান।

আমাদের সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে ’প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতা কারা কীভাবে প্রয়োগ করবে তা সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে। অনুচ্ছেদ ২৩ (ক), রাষ্ট্রকে বলে দিয়েছে বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে তৈরি সংবিধান বাংলাদেশের নাগরিকদের মাঝে কোনো বিভাজন রাখেনি। আমরা সেই জাতি যারা অতীতে সকল লড়াই সংগ্রামে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছি। আমাদের  এ ঐক্য ধরে রাখতে হবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে আমাদের সমুন্নত রাখতেই হবে।

আমরা দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নারী-পুরুষ সবাই বাংলাদেশের সম্মানিত নাগরিক। কৃষক, শ্রমিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, বাঙালি, আদিবাসীসহ সব শ্রেনী-পেশা-গোষ্ঠী-ধর্মের নারী পুরুষই স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক।  

নাগরিকরা শুধু নিজেকে স্বাধীন কিংবা মালিক ভেবে ঘরে বসে থাকলে হবে না। প্রকৃত মালিক হলেন তিনি- যিনি সক্রিয়, সোচ্চার, স্বাধীন, কর্তব্য পালন করে, দায়িত্ব নেয় ও নির্লিপ্ত নয়। আমরা যারা নাগরিক তাদের নাগরিকত্ববোধ থাকতেই হবে। নাগরিকত্ববোধ মানে দেশের মাটি, মানুষ, সম্পদ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে আপন মনে করা এবং এগুলোর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ প্রদর্শন করা।

নাগরিক হিসেবে সংবিধান আমাদের কতগুলো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেছে। যেমন, সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা; বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, কাজকর্ম করা ও বসতি স্থাপন, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার, স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের অধিকার, সংগঠন ও সমাবেশ করার অধিকার।

নাগরিক তথা দেশের মালিক হিসেবে আমাদের একটি অন্যতম দায়িত্ব হলো, ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত নেতৃত্ব নির্বাচন করা। নাগরিকদের মধ্য থেকে কেউ যদি আমাদের জীবনযাত্রা ও ভোটাধিকার প্রয়োগে বাধা দেন এবং দেশ ত্যাগ করার হুমকি দেন কিংবা দেশ ত্যাগ করার পরিস্থিতি তৈরি করে তবে তা সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। এটি আমাদের সবার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। কিছু মানুষের জন্য এ দেশ পরবাস হবে, এমন অবস্থা অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ মেনে নিতে পারে না।

ভোট দিয়ে একদিনের গনতন্ত্র চর্চা করেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আমাদের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ঠিকমতো তার দায়িত্ব পালন করছে কি না, তাও আমাদের দেখতে হবে। সব ধর্ম-বর্ণের, গোষ্ঠীর মানুষের নিরাপত্তা বিধানে তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে। জনকল্যাণে কাজ করলে তাকে উৎসাহিত করতে হবে এবং মন্দ কাজ করলে তার প্রতিবাদ করতে হবে। প্রয়োজনে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। কারণ সচেতন, সংগঠিত ও সোচ্চার জনগোষ্ঠীই গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ। অতীতে আমরা যখনই ঐক্যবদ্ধ হয়েছি এবং ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করেছি তখনই আমরা জয়লাভ করেছি।

আমরা যদি সচেতন ও সক্রিয় নাগরিক না হই তাহলে সুবিধাভোগীরা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য আমাদের উপর নির্যাতন করবে কিংবা আমাদের প্রজা বানিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিল করবে। কিছু সাহায্য, টাকা পয়সা দিয়ে আমার আপনার অধিকার কিনে নেবে। আমরা নিশ্চয়ই চাই না পরাধীন হয়ে বেঁচে থাকতে। প্রজা হয়ে বেঁচে থাকতে না চাইলে, মাথা উঁচু করে নিজের সিদ্ধান্তমতো জীবন চালাতে চাইলে আমাদের সক্রিয় এবং সোচ্চার নাগরিক হতে হবে। বাঁচতে হলে সক্রিয় নাগরিক হয়েই বেঁচে থাকতে হবে। সক্রিয় নাগরিক রাষ্ট্র ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারে সবসময় সচেতন থেকে পরিবর্তনের দায়িত্ব নেন।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। নির্বাচন এলেই নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে শুরু হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস, দন্দ্ব, হানাহানি ও মারামারি। দেশের মানুষ দিন অতিবাহিত করে অনিশ্চয়তায়। আমাদের সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে এক ধরনের চরম আতঙ্ক তৈরি হয়। তাদের জীবনে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। পরিবারগুলো ভিটামাটি এবং স্বজন হারানোর ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। অনেককে দেশত্যাগের ভয় পেয়ে বসে।

২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার কথা আমাদের হয়তো অনেকেরই মনে আছে। Election Observation Report of VOTE (Vote Observation for Transparency and Empowerment), Bangladesh Nari Progati Sangha (BNPS) এর তথ্য মতে,

বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার চাঁদপাই ইউনিয়নের কালিকাবাড়ী, রামপাল উপজেলার হারকা ইউনিয়নের বাটকাবাড়ী, বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার চাঁদসী ইউনিয়নের উত্তর চাঁদসী, আগৈলঝরা উপজেলার রাজিয়াহারি ইউনিয়নের বাহাদুরপুর, ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলার লর্ড হার্ডিন্স ইউনিয়নের অন্নদা প্রসাদ, চর উমিদ ইউনিয়নের মালো বাড়ী, ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার ধানতালা ইউনিয়নের চৌডাঙ্গি, ঠাকুরগাও উপজেলার আকেহা ইউনিয়নের বামন পাড়া ও ধনগ্রাম, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার দুলাই ইউনিয়নের জোড় পুকুরিয়া, সাথিয়া উপজেলার খেতুপাড়া ইউনিয়নের পাগলা হালদার পাড়া; সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার বারাহার ইউনিয়নের পুর্বাদেলুয়া, নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার নাগরা ইউনিয়নের তাজনগর, গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার রামশীল ইউনিয়নের রামশীল এলাকায় নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
 
এ অপরাজনীতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের। এ জন্য আমাদের হতে হবে সংগঠিত। নিজেদের রক্ষা করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। প্রগতিশীল যে সব শক্তি আছে তাদের সহায়তা নিতে হবে। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাগুলো কাজে লাগাতে হবে। যারা প্রশাসনে আছেন সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষায় তাদের উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে।

মানুষের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, পুলিশ প্রশাসনের। যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ ইত্যাদি প্রতিহত করতে প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা জনগণ সবসময় আশা করে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী পুলিশ প্রশাসনকে তাদের রক্ষাকবচ মনে করে, পুলিশ প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের রক্ষা করার জন্য। সমাজের সব জাতিগোষ্ঠী মিলেমিশে বসবাস করবে, দেশ গড়ার কাজে যার যার অবস্থান থেকে উদ্যোগী ভূমিকা নেবে- এটাই একটা শিক্ষিত, সচেতন এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করা সভ্য জাতির সৌন্দর্য।

সাইফ উদ্দিন আহমেদ
সিনিয়র প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর (গভর্ন্যান্স)
দি হাঙ্গার প্রজেক্ট, বাংলাদেশ ও সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
ই মেইল: saifahmed71@yahoo.com

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০১৩
এএ/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।