একটি দেশের গণতন্ত্র শুধুমাত্র তার নীতি, প্রতিষ্ঠান এবং পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে না। নীতি যারা প্রণয়ন বা রূপায়ণ করেন, প্রতিষ্ঠান যারা পরিচালনা করেন এবং পদ্ধতি যারা অনুসরণ করেন, তাদের আচরণের ওপরেও নির্ভর করে।
আমাদের দেশে আমরা অহরহই রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মুখে শুনে আসছি গণতন্ত্রের কথা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা, মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা, স্বাধীনতার কথা, শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থার কথা, বাক-স্বাধীনতার কথা, অর্থনৈতিক মুক্তির কথা, সামাজিক ন্যায়-বিচারের কথা ইত্যাদি, ইত্যাদি...
কিন্তু আসলেই কি আমাদের তথাকথিত রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা এ কথাগুলোর অর্থ বোঝেন! কিংবা এ কথাগুলো বিশ্বাস করেন!! আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কর্মকাণ্ডে কোনো ভাবেই প্রমাণ হয় না যে তারা নিজেরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন এবং গণতন্ত্র মানেন।
প্রথমেই বিএনপির কথায় আসা যাক, খালেদা জিয়াকে নেতৃতে নিয়ে আসা হয় জিয়া নিহত হওয়ার পরে ১৯৮২ সনে দলকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। সেই থেকে আজ অব্দি তিনিই দলের নেতৃতে আসীন। যদিও এই সময়ের মধ্যে অনেকবার দলের কাউন্সিল হয়েছে, কিন্তু দলের সফলতা ব্যর্থতা যাই থাক না কেন নেতৃতে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এমন নয় যে দলের ভেতরে ত্যাগী, সৎ, দেশপ্রেমিক, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পন্ন, একনিষ্ঠ নেতার অভাব রয়েছে, আসলে দলের ভেতরে চাটুকাররা এমনভাবে শিকড় গেড়ে বসে আছেন যে, এর বাইরে যাওয়ার উপায়ই রাখেননি তারা।
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দলের জন্ম জিয়াউর রহমান দিয়েছেন, তাই দলটির মালিকানা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন খালেদা জিয়া। এখানে অন্য কারো নেতৃত্ব দেওয়ার অধিকার নেই।
দলের ভেতরেও নেই কোনো গণতান্ত্রিক চর্চা। দলের কমিটি করেন খালেদা জিয়া তার পছন্দমত। এই ক্ষমতাটিও তাকে দিয়েছেন দলের ভেতরে থাকা চাটুকারেরা। ফলে দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা কোনো ভাবেই আর সম্ভব নয়।
একই অবস্থা আওয়ামী লীগ এর মধ্যেও বিরাজমান। ১৯৮১ সনে যখন নিজে দলের প্রধান হতে পারবেন না দেখলেন, তখন ড. কামাল হোসেন কলকাতার পুলিশ’র মহাপরিচালক দেবব্রত ব্যনার্জির তত্ত্বাবধানে থাকা শেখ হাসিনাকে এনে দলের নেতৃত্ব তার হাতে তুলে দেন। সেই থেকে তিনিও দলের একচ্ছত্র নেতা হয়ে জগদ্দল পাথরের মতো বসে আছেন। লোক দেখানো কাউন্সিল যতবারই হোক না কেন, নেতৃতে কোনো পরিবর্তনই হয় না। এটা যেন তার পৈতৃক সম্পত্তি। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। আ. লীগের নেতৃতে কারো কোনো অধিকারই নেই। তিনিও কমিটি করেন তার পছন্দ মতো। তৃণমূলের কর্মীদের কিংবা নেতাদের মতামতের কোনো মূল্যই নেই এইসব উত্তরাধিকারীদের কাছে।
যেই দল তার কর্মীদের, নেতাদের গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে চায় না কিংবা দিতে ইচ্ছুক নয় সেই দল এবং সেই দলের নেতা-কর্মীদের কাছে কোনো ভাবেই দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার পাওয়ার কোনো সুযোগই নেই, এটা দিবালোকের মতোই পরিষ্কার।
গণতন্ত্রের একটি নজির পাঠকের জন্য তুলে ধরছি। অস্ট্রেলিয়ায় সদ্য সমাপ্ত ফেডারেল নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা শুরু হওয়ার পরেই বোঝা যাচ্ছিলো ক্ষমতাসীন লেবার পার্টি পরাজিত হচ্ছে। তাই সম্পূর্ণ ফলাফল ঘোষণার পূর্বেই ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির প্রধান কেভিন রাড দলীয় এক কর্মীসভায় তার দলের পরাজয়কে মেনে নিয়ে বিজয়ের পথে এগিয়ে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বী টনি এবটকে শুভেচ্ছা জানান এবং সরকার পরিচালনায় তাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। পাশাপাশি দলের পরাজয়ের দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়ে দলের নেতৃত্ব থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ান।
অন্যদিকে আমাদের দেশে নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের পক্ষে না এলেই কারচুপির অভিযোগ করেন পরাজিত দল। আমাদের দেশে কখনোই কোনো দলের নেতা-কর্মী দলের পরাজয়ের জন্য নিজেদের কিংবা দলের দুর্নীতিবাজ নেতাদের দায়ী করেন না। ফলে দুর্নীতি এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। দলের নেতা-কর্মী নির্বাচিত হয় দলীয় প্রধানের ইচ্ছার ওপর। তাই দলের ভেতরে রাজনৈতিক চর্চার বদলে চাটুকারিতার চর্চাই হয়।
তখন আমি স্কুলে পড়ি। সদ্য ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’ নামক ৫০ নম্বর এর একটি বিষয়কে বাতিলের আন্দোলনের মাধ্যমে। সেই সময় দেখেছি দলের নেতা-কর্মীরা নির্বাচিত হতেন কাউন্সিলে আগত কাউন্সিলরদের ভোটের মাধ্যমে। তখন দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা হতো। দলীয় অফিসে হতো রাজনৈতিক আলোচনা।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম। আমি তখন স্কুলে পড়ি, স্বপ্ন ছিল দেশ স্বাধীন হলে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটবে, আমরা গড়ে তুলবো একটি শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা। কিন্তু তার বদলে আজ আমরা যা দেখছি, এই জন্যই কি আমরা সেদিন অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পরেছিলাম পাক-হানাদারদের ওপর! আমাদের লড়াই কি দু’টি পরিবারের কাছে দেশ ও দেশের মানুষকে জিম্মি হওয়ার জন্য ছিল!! অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় দেশ ও দেশের আপামর জনসাধারণ দুইটি পরিবারের কাছে জিম্মি হয়ে পরেছে। এই অসহনীয় অবস্থা থেকে আমাদের দেশকে এবং দেশের মানুষকে অবশ্যই মুক্ত করতে হবে। দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা, যা দেশকে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আজকাল প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায় কোথাও না কোথাও রাজনৈতিক হানাহানির খবর। কেন এতো হিংসা, কেন এতো বিদ্বেষ, কেন এতো অস্থিরতা রাজনৈতিক অঙ্গনে? যারা রাজনীতি করেন তারা কি কখনো বিষয়টি ভেবেছেন? তাদের আচরণ দেখে কখনোই মনে হয় না যে, রাজনৈতিক নেতারা কখনো দেশ, জাতি, জনগণের কথা ভেবেছেন। যদি ভাবতেন তাহলে তারা এমন অস্থিরতার মধ্যে দেশকে দেশের আপামর জনসাধারণকে ফেলতে পারতেন না। আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের দেশের নেতারা শুধু তাদের নিজেদের কথা, তাদের দলের কথাই ভাবেন, দেশের জনগণ তাদের কাছে ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার মাত্র, আর কিছুই নয়।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গন এখন একটি বিস্ফোরণ উন্মুখ আগ্নেয়গিরির মতো অবস্থায় আছে। যে কোনো সময়ে সেই আগ্নেয়গিরি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে যা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য হবে ভয়াবহ। দেশের বিবেকবান দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ (যদি কেউ থেকে থাকেন), বুদ্ধিজীবী, সুধীসমাজ, সাধারণ মানুষ তা কখনোই চায় না, চাইতে পারে না।
দেশের বর্তমান এই অপ-রাজনীতির বেড়াজাল থেকে আমাদের এখুনি বের হয়ে আসতে হবে। বাঁচাতে হবে দেশকে। দেশের মানুষকে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে নেই। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন নিয়ন্ত্রণ করে দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা, কালো টাকার মালিক, পেশী শক্তির মালিক, দুর্নীতিবাজ, অস্ত্রবাজ, গুন্ডা-মাস্তান, কালোবাজারি, ঘুষখোর আমলা শ্রেণির লোকেরা। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন পঙ্কিলতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত। তাই সর্ব প্রথম আমাদের জানতে হবে রাজনীতির নামে দেশ কেন এমন হানাহানির পর্যায়ে গেছে। এর মূল কারণ আমাদের সন্ধান করতে হবে। তা হলেই আমরা এর সমাধান বের করতে পারবো।
সাইদুল ইসলাম মন্টু: পিএইচডি গবেষক, কার্টীন বিশ্ববিদ্যালয়, পার্থ, অস্ট্রেলিয়া, s.montu@postgrad.curtin.edu.au
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৩
এসএটি/জিসিপি