প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিশ্বশান্তি প্যাগোডা। পাহাড় পর্বত টিলা বেষ্টিত পাহাড়ের পাশে সবুজ ঘন বীথিকার মাঝে কৃত্রিম ভাবে গড়ে তোলা এ নৈসর্গিক ভিত্তি ।
বিশ্বশান্তি প্যাগোডাকে সামনে রেখে যে কথাগুলো না বললে নয়, চন্দ্রনাথ শৈল শ্রেণীর পাদদেশে বর্তমানে যে স্থানে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিক্ষার বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত। সেই স্থানে ছিল প্রাচীন গুরুত্ববহ ঐতিহ্যমণ্ডিত রাজবাজ্ব্যা বা রাজবাড়ী। এই রাজবাজ্ব্যা বা রাজবাড়ীর নানা বিচিত্র কাহিনী লোকমুখে শোনা যেত । এই স্থানে কোনো এক সময় আরাকান বৌদ্ধ রাজা ও রাজপ্রতিনিধিগণ আগমণ করে তাদের রাজত্ব কায়েম করেছিলো । এক সময়ে তাদের শাসনকার্য গুটিয়ে চলেও গিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। এই এলাকা জুড়ে আরাকান রাজসভার প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল তা নিশ্চিত। যা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে ।
চট্টগ্রাম বিদ্যালয়ের উত্তর ক্যাম্পাসের পাশে ছোট একটি টিলা, যার নাম ক্যাংটিলা। স্থানীয় লোকেরা কাউটিলাও বলে থাকে । আরাকানী ভাষায় বৌদ্ধ মন্দিরকে ক্যাং বলে থাকে । এই কাউটিলায় আরাকানী বৌদ্ধ ও সমতলবাসী স্থায়ীয় লোকদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন হত বলে অনেকের ধারণা । যে কয়কন গুণী ব্যক্তি জম্মগ্রহণ করে এতদ অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করেছে তারা হলেন - বৌদ্ধ সাধক গোবিন্দ ঠাকুর, বৌদ্ধ ধর্মের পুনজ্জীবনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকার জন্য প্রশংসিত গুণালংকার মহাথের, আজীবন শিক্ষবিদ বসুন্ধরা লাল বড়ুয়া ( প্রয়াত ) প্রমুখ।
কালের বিবর্তনে আরাকানীদের অন্যত্র অপসারণ ও স্থানীয় লোকেরা অন্যত্র সরে যাওয়ায় এই ক্যাংটিলা বৌদ্ধদের শ্মশান ভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যা বিশ্বশান্তি প্যাগোডোর কাছাকাছি কয়েকটি পুকুর দেখে সহজে অনুমান করা যায় । শ্মশান ভূমির পরিচিতির জন্য তা বিশ্ববিদ্যালয়ের হুকুম দখল থেকে রক্ষা পায় ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অবস্থিত হওয়ায় এ জায়গাগুলো একসময় মূল্যবান হয়ে পড়ে। ফলে ৬৮ শত মি. অধ্যুষিতু এই শ্মশান ভূমির প্রতি অনেকের দৃষ্টি নিবন্ধ হ্য় । আঞ্চলিক সংগঠন সংঘরাজ ভিক্ষু মহামন্ডল ও বুড্ডিষ্ট ফাউন্ডেশন যুগপোযোগী কর্মসূচি নিয়ে এই কাউটিলার স্বত্ব হস্তান্তরের প্রস্তাব করেন । ১৯৮১ সালের দিকে সংঘরাজ ভিক্ষু মহামন্ডলকে কাউটিলার স্বত্ব হস্তান্তর করা হয় । প্রয়োজন পড়লো একজন যোগ্য ভিক্ষুর । সৌভাগ্যা জোবরাবাসীর, সৌভাগ্য সংঘরাজ ভিক্ষু মহান্ডলের ।
বাংলাদেশের বৌদ্ধদের দৃষ্টি নিবন্ধ করে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পন্ডিত, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, এশিয়া শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত দশম সংঘরাজ জ্যোতিঃপাল মহাথের অবস্থান গ্রহণ করতে সম্মত হলেন । শুরু হলো টিনের চালা ঘরে মহাপুরুষের অবস্থান । কাউটিলার গুরুত্ব ও সম্ভাবনার নিরিখে অনেক ঝড়া, ঝঞ্জা, অশুভ শক্তির পতনের মধ্য দিয়ে নাম করণ করা হল বিশ্বশান্তির প্যাগোডা । বিশ্বশান্তির আবাসস্থল হিসেবে বিশ্বশান্তি প্যাগোডা নন্দিত অবস্থানের কারণে দিনে দিনে পরিচিতি লাভ করেছে। ফলে বিশ্বশান্তি প্যাগোডায় একটি সুন্দর নন্দনীয় ছোট মূলগন্ধ কুটির প্রাথমিকভাবে নিমার্ণ করা হল ।
দূর দৃষ্টি সম্পন্ন শ্রীমৎ জ্যোতিঃপাল মহাথেরের একক প্রচেষ্টার ফসল প্যাগোডা স্থাপনা ও ব্যবস্থাপনা। তিনি সেখানে ভিক্ষু নিবাস ও অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাভোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধ ছাত্রদের জন্য গড়ে তুললেন ছাত্রাবাস । এভাবে দিন অতিক্রম হচ্ছে । দিন গড়াতেই এক সময় নজর পড়ল তৎকালীন সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার মহাসচিব ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ থের, আন্তর্জাতিক মানব হিতৈষী ফাদার পিয়াট্টো লুইজ লুপি মহোদয়ের দৃষ্টি নিবন্ধ করালেন এই অবহেলিত তীর্থধাম সম বৌদ্ধ চত্বরে । ফাদার লুপি জায়গা পছন্দ করলেন । সিদ্ধান্ত হলো বৌদ্ধ ছাত্রাবাস নির্মাণের । মহামণ্ডল কর্তৃপক্ষ ও সম্মতি প্রকাশ করলেন । শুলো হলো নির্মাণ কাজ । কোনো শুভ কাজ সহজেই সুসম্পন্ন হয় না । এতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে সকল বিঘ্ন বিদূরীত করে যাতে প্রকল্প সম্পন্ন করা যায়। এই কর্মকাণ্ড সফল করার লক্ষ্যে একনিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন জোবরা গ্রামবাসী । শুরু হল আধুনিক বিশ্বের উপযোগী ছাত্রাবাস নির্মাণ । পুরাতন ছাত্রাবাস ভেঙ্গে নতুন ছাত্রাবাস তৈরি হলো ।
দুইজন ক্ষণ জম্মা প্রাণ পুরুষের নামে এই অত্যাধুনিক ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হলো গৌবিন্দ গুণালংকার বৌদ্ধ ছাত্রাবাস । ইটালিয়ান রেডক্রস কর্মকর্তারা আবারো পরিদর্শন করলেন । পরিদর্শনকালে আরেকটি ছাত্রাবাস নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উপলন্ধি করলেন । নতুন ছাত্রাবাসের উদ্বোধন হল। আধুনিক বিশ্বে থাকা ও শিক্ষার উপযোগী যেসব উপাদান থাকার দরকার সবই তার বিদ্যমান । ছাত্রাবাসের বর্তমানের মোট ৭৪ জন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র অবস্থান করছে । কম্পিউটার কক্ষ, লাইব্রেরী, হলরুম, টিভি কক্ষ সবই মিলিয়ে অনুপম সৃষ্টি ভিক্ষুদের জন্য কক্ষ বরাদ্ধ হল । সবই হল, কিন্তু গড়ে উঠল না মূল প্যাগোডার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা করা হয়েছে ইতিমধ্যে, বিশ্ব শান্তি প্যাগোডা নামকরণের এতোটা বছর পেরিয়ে গেল শুধু নামে। বিশ্ব শান্তি প্যাগেডা সময়ের সঙ্গে তার নিজেকে জানান দিয়ে পূর্ণতা পাক । তার নিজস্ব কাঠামো মহামণ্ডল তার বাস্তবায়ন করুক এই ভিত্তি প্রস্তর র্কীতি সৌধে পরিণত হোক- এটাই আমাদের মর্মগামী প্রত্যাশা ।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০,২০১৩
বিএসডি/জিসিপি