ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

এয়ারপোর্ট বিড়ম্বনা, যেখানে মুখের কথাই আইন

আমির হোসেন, নয়াদিল্লি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৩
এয়ারপোর্ট বিড়ম্বনা, যেখানে মুখের কথাই আইন

এই লেখাটা লিখছি এমন এক সময়ে যখন হরতাল আর জাতীয় নির্বাচনের হুমকি ধমকি নিয়ে সারা দেশ উত্তাল।   ভালোভাবেই বুঝতে পারছি ‘ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়ার’ মত একটা ব্যাপার দিয়ে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করা দুরূহ হবে,  তারপরও লিখছি কারণ নিজের গায়ের চামড়া কামড়ে আর থাকাতে পারছিনা।

  ঘটনাটি বলে যদি কিছুটা হলেও গায়ের জ্বালা কমানো যায় তাই...

ঘটনাটি এরকম-
সেদিন ৬ই নভেম্বর, ২০১৩।   এয়ার ইন্ডিয়ার (এআই ২৩২)বিমানে করে ঢাকা থেকে দিল্লি আসবো। হরতাল থাকায় ভোর ৫টায় বাসা থেকে রওয়ানা দিয়ে ৫টা ২০মিনিটেই  বিমান বন্দরে পোঁছাই।   বিমান ছাড়বে ৯টা ৪৫ মিনিটে। কিছুই করার নেই তাই চেক ইন কাউন্টারের চারপাশে ঘুরঘুর করে কাটিয়ে দিলাম ৭টা ৪৫মিনিট পর্যন্ত। যথাসময়ে চেক ইন হলো, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পূরণ করে ইমিগ্রেশন কাউন্টার ঝামেলা ছাড়াই পার হলাম।   ইমিগ্রেশন জোনে ঢুকে প্রিমিয়াম লাউঞ্জে আরও ঘন্টা খানেক কাটলো। ডাইনারস ক্লাব ইন্টারন্যাশনালস এর ক্রেডিট কার্ডধারী হওয়াতে বলা যায় ভালোই কাটলো সম্পূর্ণ বিনা পয়সায়।   সময় মতো স্পিকার থেকে অ্যানাউন্সমেন্ট শুনলাম ডাক পড়েছে বোর্ডিং গেইটে যাওয়ার। দেরি না করে এয়ার ইন্ডিয়ার বোর্ডিং গেইটে হাজির হই। যথানিয়মে হাতব্যাগ চেক হোল, বডি চেক করে নিলো সিকিউরিটি। আদেশ এলো ম্যানিব্যাগ দেখানোর। মনে মনে ভাবলাম ভালই তো, আমেরিকায় নেম কার্ড হোল্ডার পর্যন্ত যেমন করে চেক করে নেয় বিমানের নিরাপত্তার জন্য, আমার বাংলাদেশেও তা শুরু হয়েছে। ভাবতে ভাবতে খুশি মনেই ম্যানিব্যাগটি বের করে দিলাম। আর তখন থেকেই শুরু হলো হুলফোটানো উৎপাত।

প্রথম প্রশ্ন পকেটে বাংলাদেশের টাকা কেন? বললাম, বিদেশে চাকরি করি ভাই,  দেশে এসে পাঁচ দিন থেকে ফিরে যাচ্ছি, কিছু টাকা (৬০০০ টাকা ) রয়ে গেছে তাই পকেটে আছে। পরের বার দেশে আসলে বিমান বন্দর থেকে বাসায় যাওয়ার জন্য সবসময়  কিছু টাকা সাথে রাখতেই হয়, তাই আছে।   সোজা হুকুম, না এই টাকা নিয়ে বিদেশে যাওয়া যাবে না, এটা বেআইনি।  

বিদেশে যারা যাতায়ত করে তাদের পকেটে দেশি কিছু টাকা সবসময়ই থাকে। যাতে ফিরে ‌আসলে তাৎক্ষণিক খরচগুলো করা যায়। আমারও ছিলো। অল্প কিছু টাকার জন্য আইনের এমন প্রয়োগ আর দেখিনি।

গেলো ৩২ বছরে কম করে হলেও ৪০ বার দেশে এসেছি, কখনোই এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি যেমনটা এই দিন হলাম। বিরক্তি ও বিষ্ময়ে মৃদু প্রতিবাদ করে আইনটা কি জানতে চাইলাম। এতেই হলো মহাদোষ। ভদ্রলোক (!) আমার পাসপোর্টটি ছুঁড়ে মারলেন টেবিলের উপর। ‘আইন আছে, কিন্তু আপনারে দেখাতে হবেনা। ’

এখানে বলে রাখা দরকার, যিনি আমার সঙ্গে এতটা বাহাস করলেন তিনি কিন্তু কাস্টমসের কেউ নন, তারপরেও তিনি আমাকে কাস্টমসের আইন কপচাচ্ছিলেন। পাসপোর্ট  ছোঁড়া দেখে আমারও রাগ হোল, বললাম আইনটি ঠিক কি তা আমাকে দেখাতে হবে। গতান্তর না দেখে কাস্টমসের লোক ডাকলেন। কাস্টমসের পরিপাটি ড্রেস পরা একজন এগিয়ে এলেন। দেখতে অফিসার অফিসারই লাগছিলো।   ওই লোকের কথা শুনেই আমাকে একটা কড়া ধমক ঝাড়লেন। আইনে নিষেধ আছে। জানতে চাইলাম, আইনটা কি একটু দেখাতে পারবেন?

এতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন অফিসার। বেশ খানিকটা শাসিয়ে বললেন, “আমার মুখের কথাই আইন। ” ধমক দিয়ে জানালেন, এই আইন জানতে চাওয়ার অপরাধে তিনি আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারেন। বাদানুবাধ চললো আরো ৫/৬ মিনিট। প্লেন ছাড়ার সময়ও ঘনিয়ে আসছে...

একটু অসহায় অসহায় বোধ হচ্ছিলো। শেষমেষ এয়ার ইন্ডিয়ার কাউন্টারের লোকেরা এগিয়ে এলেন, চিনতে পেরেছেন বলেই হয়তো। তাদের মধ্যস্থতায় কোনভাবে পার পেয়ে বিমানে উঠে নিজের কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারি।

হায়রে কপাল, মনে বড় কষ্ট হলো, ৬০০০ টাকা, তাও আবার নিজের সৎ পথে উপার্জন করা, তার  জন্যই আমাকে জেলে যাবার উপক্রম হতে হোল। এই জ্বালা কোথায় লুকাই।

মনে মনে ভাবি, ছয় হাজার টাকা এমন কিই। যা বিদেশে নিয়ে আমি দেশের বড় ক্ষতি করে ফেলবো। সামান্য টাকা আবার ফিরলে কাজে লাগবে ভেবেই পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু এই বিমানবন্দর দিয়েই বস্তায় বস্তায় টাকা পাচার হয়। আমাদের এই আইন প্রয়োগকারীরা, ‘যাদের মুখের কথাই আইন’ তারা তখন কি করেন।
 
গত ৩২ বছর দেশের বাইরে আছি, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি করে বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করছি আজ ২৬ বছর। দেশমাতাকে দুই মিলিয়ন ইউএস ডলারেরও বেশি দিয়েছি এই ৩২ বছরে। আমরা তো দেশের টাকা পাচার করি না। নিজের প্রয়োজনেই ৬০০০ হাজার টাকার ( ৭৫ ডলার) পকেটে রেখে এমন বিড়ম্বনা!!   

আরও ভাবছি, বাংলাদেশের লাখ লাখ কর্মী দেশের বাইরে যাচ্ছে আসছে এই এয়ারপোর্ট দিয়ে, যাদের পাঠনো রেমিট্যান্স যোগ হয়েই আজ বাংলাদেশের বিদেশি কারেন্সি ভাণ্ডার  ১৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সরকার উঠতে বসতে তার গর্বও করে। তাদের মাঝে কতজন এই কাস্টমস বাবুদের হাতে নাস্তানাবুদ হচ্ছেন প্রতিদিন। তাদের  সবাই কি পেরে ওঠেন এই কাস্টমস বাবুদের অত্যাচারের হাত থকে রেহাই পেতে;  আর কতজনই বা এয়ার লাইন্স কাউন্টারের লোকদের সাহায্যের হাত দিয়ে পার পেতে পারেন! ভেবেই মনটা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
 
বাংলাদেশ কাস্টম কারেন্সি রুল নিয়ে আমার জ্ঞানের দৌড় হল,  “৫০০০ হাজার ডলারের নিচে হলে,  যে কেউ অনুমতি ছাড়াই বাংলাদেশ থেকে ওই পরিমান সমান টাকা  নিতে  এবং আনতে পারবেন” এই পর্যন্তই।   তাই কর্মস্থলে ফিরে এসে, সাধ্য মতো ইন্টারনেটে খোঁজ করলাম,  সেই কাস্টমস বাবুর আইনের ব্যাপারটা (বাংলাদেশি কারেন্সি কেউ নিতে পারবেন না) ।   কোথাও পাইনি তার খোঁজ। এমন কি এয়ারপোর্ট কাস্টমস অফিসেও ফোন (নং+৮৮০-২-৮৯৪৫৭৯/ ৮৯৪২৪১)-এ কল করলাম। দুর্ভাগ্য আমার, কেউই ফোন ধরেননি। এই আইনটা আসলে কি, কেউ কি আমাকে জানাবেন!

তবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে আমার (আমাদের!) অনুরোধ, প্রয়োজনীয় কাস্টমস আইনগুলো নোটিশ আকারে দেয়ালে টাঙ্গিয়ে দিন। অথবা দৃষ্টিগোচর হয় এমন একটি স্থানে বড় বোর্ডে বড় বড় করে লিখে দিন। তাতে আমার মতো যাত্রীরা রেহাই পেতে পারেন।

আমরা আর কাস্টমস কর্মকর্তার ‘মুখের কথাই আইন’  এমন ধমক শুনে মুখ বুজে হজম করতে চাই না।

পুনশ্চঃ যদি আইনে বাংলাদেশি কারেন্সি একেবারেই নেওয়া যাবে না এমনটি থেকে থাকে তাহলে ৩২ বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি অনুরোধ করতে চাই- অল্প কিছু কারেন্সি পকেটে থাকার অনুমতি দিয়ে আইনটি সংশোধন করা যেতে পারে।

আমির হোসেন, বিদেশে চাকুরিরত, একজন সাধারণ নাগরিক।

বাংলাদেশ সময় ২১২৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৩
এমএমকে/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।