আমাদের দেশে সংবিধান নিয়ে যতো আলোচনা হয়, বোধ করি পৃথিবীর আর কোনো দেশেই এমনটি হয় না। ক্রমাগত এ আলোচনা হওয়াতে দেশের সংবিধান সমুন্নত হোক বা না হোক, আমরা পেয়েছি অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ।
এক সময় সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলতে আমরা জানতাম ড. কামাল হোসেনকে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবিধান নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে সেই কাতারে আরো যুক্ত হলো ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম, ড. এম জহির প্রমুখসহ আরো অনেক নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবিধানের শিক্ষক ছিলেন ড. এম. এরশাদুল বারী। গত রোববার রাতে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। তিনিও দেশের একজন বিশিষ্ট সাংবিধানিক আইনজ্ঞ ছিলেন।
সংবিধান নিয়ে এ আলোচনা হওয়ার একটি ইতিবাচক দিক হলো যে, আমরা ক্রমান্বয়ে দেশের আইন, নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হচ্ছি। কিন্তু এতো কিছুর পরও প্রতি পদে পদে দেখি সংবিধানের লঙ্ঘন।
স্বাধীনতার পর এমন কোনো রাজনৈতিক সরকার আসেনি যারা সংবিধান সংশোধন করেনি। পাশাপাশি এমন কোনো রাজনৈতিক সরকারও আমরা পাইনি যারা সংবিধানের লঙ্ঘন করেনি। দেশে সংবিধানের লঙ্ঘন আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে। কিন্তু বৈচিত্র হচ্ছে, বর্তমানে সংবিধান লঙ্ঘনজনিত যেকোনো ঘটনার ক্ষেত্রে নতুন নতুন সংবিধানের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। এই ব্যাখ্যা দেয়ার ক্ষেত্রেও আছে বৈচিত্র। একেকজন বিশেষজ্ঞ একেক রকম ব্যাখ্যা দেন। আবার সরকারের একেক মন্ত্রীও একেক রকম ব্যাখ্যা দেন। ফলে, মাঝে মধ্যে প্রশ্ন জাগে সংবিধান তুমি কার? সংবিধান তুমি কি?
আগের মেয়াদে বিএনপি সংবিধানের দোহাই দিয়ে দেশে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়েছে। বর্তমানেও আমরা লঙ্কাযাত্রায় আছি।
অতীত বাদ দিয়ে যদি কেবল বর্তমান সময়ের কথাও বলি, আমরা অন্তত স্পস্টতই তিনটি সংবিধান লঙ্ঘনের মধ্যে আছি। আমি কেবল সর্বশেষটির কথা এখানে উল্লেখ করছি।
গত সোমবার সব মন্ত্রীরা একযোগে পদ ত্যাগ করেছেন। গণমাধ্যমেই এরকমই আমরা দেখেছি। তারা সহাস্যেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের এ পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। আর প্রধানমন্ত্রীও সহাস্যে তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। যদিও প্রধানমন্ত্রীর এ পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা বা না করার কোনো এখতিয়ার নেই। কারণ, মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র প্রদান করা হয় রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে। প্রধানমন্ত্রী এগুলো গ্রহণ (সংগ্রহ) করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রদান করবেন মাত্র। এটিই তার সাংবিধানিক এখতিয়ার।
কিন্ত পদত্যাগপত্র দিয়েও মন্ত্রীরা এখনো স্বপদে বহাল আছেন। তারা রীতিমতো অফিস করছেন। ফাইলে স্বাক্ষর করছেন। শুধু তাই নয়, একেক মন্ত্রী একেক রকম ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন। খাদ্যমন্ত্রী বলছেন, তার পদত্যাগপত্রে কোনো তারিখ ছিলনা। তাই এটি কার্যকর হয়নি।
আইনমন্ত্রী সকালে বলছেন এটা একটা আনুষ্ঠানিকতামাত্র। আবার বিকালে বলছেন, সাংবিধানিক ত্রুটি হয়েছে। তিনি আরো স্পস্ট করে বলেন যে এটি সাংবিধানিকভাবে করা হয়নি। আবার বলছেন, পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে জমা দেয়া হয়নি। আইনমন্ত্রীর বক্তব্য একটির সাথে আরেকটি স্ববিরোধী। তবে, বিষয়টি যে সাংবিধানিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ সেটিই মূল কথা।
আর তথ্য মন্ত্রীতো বাঙালিকে হাইকোর্ট দেখিয়ে ছেড়েছেন। পদত্যাগ নিয়ে যদি কারো কোনো দ্বিধা থাকে তবে তিনি আদালতে যেতে বলেছেন।
সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদ বলছে, প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন। এখানে অন্যকোনো শর্তপ্রয়োগ করা হয়নি। কাজেই পদত্যাগপত্র জমাদানমাত্রই তাঁর পদ শূন্য হয়ে যাবে। এটাই সংবিধানের রীতি। পৃথীবীর অধিকাংশ দেশেই পদত্যাগের রীতি এমনই-অন্তত যেখানে সংবিধানের বিধানটি আমাদের মতো।
শুধু তাই নয় মন্ত্রিপরিষদ সচীব ঘোষণা দিলেন, এটাই ক্যাবিনেটের শেষ বৈঠক ইত্যাদি। পুরো ক্যাবিনেটই একসাথে পদত্যাগ করলো।
কিন্তু তারপরও তারা নিজ নিজ পদে এখনো বহাল আছেন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও গ্রহণ করছেন। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে, আর মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়ে। সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকে গুরুত্ব দিয়েই তাকে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার এ দায়িত্বটি দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব কেবল রাষ্ট্রপতির কাছে এ পদত্যাগপত্র পৌছে দেয়া। গ্রহণ করা বা না করা তার এখতিয়ারভুক্ত বিষয় নয়।
এর আগেও আমরা সোহেল তাজের বেলায় একই ঘটনা অবলোকন করেছি। তারপর দ্বিতীয়বার সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত’র ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। আর এবার তো পুরো ক্যাবিনেটই পদত্যাগ করলো। এটিই স্বাভাবিক, কোনো একটি ত্রুটি প্রথমবার সংশোধন না করা হলে দ্বিতীয়বার সেটি করার জন্য উস্কে দেয়া হয় ও তৃতীয়াবার সেটি প্রকট আকার ধারণ করে। তাই এবার পুরো মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করেছে। এবং যথারীতি একেক মন্ত্রী একেক ধরনের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। সংবিধান থাকলো বা গেলো তাতে কারো রা নেই। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাইই এখানো মূখ্য।
তাই এখনো মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেও পতাকাবাহী গাড়িতে অফিসে যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারের এখন কিছু করারও নেই। কারণ, পুরো মন্ত্রিসভা এভাবে পদত্যাগ করার ফলে বর্তমান সময়ে প্রধানমন্ত্রী তার করণীয় নির্ধারণ করতে পারেননি। ফলে মন্ত্রীদেরও তাই অফিসে যেতে হচ্ছে।
এ সাংবিধানিক অচলাবস্থা সামলানোর জন্যই একেক মন্ত্রী একেক ব্যাখ্যা দেন। এসব ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যদি কোনো মন্ত্রী বলে বসেন, আমরাতো পদত্যাগ করেছি, পদ ত্যাগ করিনি। তাতে আমাদের আর কিই বা বলার থাকবে।
তাই, নতুন নতুন সংবিধানের ব্যাখ্যা দিয়ে রাজা-উজির না মেরে সংবিধানকে সবক্ষেত্রেই সমুন্নত রাখা প্রয়োজন। আর বিরোধীদলেরও ঘোলাপানিতে মাছ শিকার না করাই ভালো।
বাংলাদেশ সময় ০১৫৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৩
এমএমকে/জিসিপি