লেখার উপজীব্য হিসেবে নিজের জীবন অভিজ্ঞতা, আমার তেমন পছন্দ নয়। কিন্তু এমন এক জাতীয় ইস্যুর সাক্ষী যখন নিজেই, তখন আর কি করা! ২০০৭ সালের কথা, নভেম্বর ১৪।
কিন্তু সহসাই প্রকৃতি অশান্ত হয়ে ওঠে (রাত ১২টার পর তখন, নভেম্বর ১৫ হয়ে গেছে)। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে এমন ধারণা থাকলেও তার ভয়াবহতা যে এমন হতে পারে, তা কিন্তু কল্পণাতীত বৈ কি! ওই রাতে অবশ্য সারা দেশের খবর নেয়ার কথা মাথায় আসেনি। কারণ, বাসা থেকে সদ্য চলে যাওয়া আত্মীয় পরিজনের খবর নিতেই ব্যস্ত সময় কাটে কিছুক্ষণ। আর তারপরে, বিদ্যুতের সংকট।
সিডরের কবলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ পড়লেও লোডশেডিং এর ভাগিদার হয় সারাদেশের মানুষও। অনেক বছর পর সারা দেশের মানুষ একসাথে অন্ধকারে সময় কাটান সিডরের কারণে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ দেশকে কি দিতে পেরেছে বলতে পারব না তবে, সারা দেশকে সেদিন অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল! পরে যতদূর শুনেছি খোদ ন্যাশনাল গ্রিড নাকি ফেইল করেছিল, সেদিন!
সে রাতে আমি সৃষ্টিকর্তার মেহেরবানীতে দালানে ছিলাম বলে কিছুটা রক্ষা। তবে, ঠিক পাশের আধা পাকা দালানে আমার চাচা ছিলেন বলে, প্রতিটি মুহূর্তই অনুভব করতে পেরেছি। সময় –সময় যোগাযোগ রেখেছি। মাত্র ষাট (৬০) সেকেন্ডের পথ হেটে তারা, আমাদের বাসায় আশ্রয় নিতে আসতে পারছিলেন না। বিভৎস সে মুহূর্ততের অভিজ্ঞতা লিখে প্রকাশ্য যোগ্য নয়।
ঠিক সময় বলতে পারবনা, তবে সেই রাতেই শুনছিলাম, তারা রাতে ঘরের চাল দড়ি দিয়ে বেধে সবাই মিলে বসে আছে। ঊড়ে যাবার সম্ভাবনা প্রখর। পরে অবশ্য সকাল হতে না হতে বুঝে উঠতে পেরেছিলাম, সারা দেশের তুলনায়, তাদের বাসায়ও তেমন কিছু হয়নি। আমাদের বাড়িরও বেশ কয়েকটি গাছ তখন মাটিতে। আর অন্য কোন বাড়ির ঘরের চাল আমাদের আঙ্গিনায় এসে পড়ে আছে, কে জানে?
মূলত, সিডর (Sidr) বঙ্গোপসাগরে থেকে সৃষ্ট একটি ঘূর্ণিঝড়। উত্তর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ২০০৭ সালে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে এটি ছিল ৪র্থ। সিডর শ্রীলংকার একটি শব্দ যার অর্থ- চোখ। এ ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের বেগ ছিল ৩০৫ কিমি/ঘণ্টা। এটি ক্যাটেগরি-৫ মাত্রার ঘূর্ণিঝড়। সরকারি হিসেবেই বলতে গেলে এই প্রাকৃতিক দূর্যোগে প্রাণ হাড়ায় দু হাজারেও বেশি মানুষ। ঘর, সহায়-সম্পদ, মাল-সাওয়াল এগুলোর হিসেব কখইন মিলবে কিনা কে জানে? বাংলাদেশ সরকার এ ঘটনাকে জাতীয় দূর্যোগ বলে ঘোষণা করেছিল।
সিডরের জন্যই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ প্রায় সারা দেশেই কম-বেশি ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিপাত হয়েছিল। যার ফলাফল বহুদূর। রাজধানী সহ সাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেখা দিয়েছিল পানি সমস্যা। এই ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের প্রায় ‘৬ লাখ টন ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, যার বাস্তবতা হয়তো আরও সুদূর প্রসারী। আমরা সে খবরই রাখনি? ঝড়ের প্রভাবে প্রায় দশ লক্ষ ঘরবাড়ি কম ধ্বংস হয়নি, ফসল নষ্ট হয়েছে কম করে হলেও একুশ হাজার হেক্টর। এক হিসেব অনুযায়ী কেবল গবাদিপশু প্রাণ হারিয়েছে প্রায় তিন লাখের মত। হিসেব মিলিয়ে হয়তো দেখা যাবে ক্ষয়-ক্ষতির বাস্তব চিত্র আরও একটু করুণ।
স্থানীয়রাই সর্বপ্রথম নিজেদের উদ্ধারে নিজেরাই ঝাপিয়ে পড়ে। বেলা বাড়লে পরবর্তীতে যোগ হয়, আশপাশ এলাকার লোকজন। সারা দেশ দুর্যোগের প্রস্তুতি নিয়ে ছিল বলে সরকারি সহায়তা পেতেও সময় লাগেনি।
ঝড়ের পরেই বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর ৫টি জাহাজ ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকা সমূহে পৌঁছে যায়। সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল মিত্রদেশ গুলোও। ইউরোপীয় কমিশন, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড স্টেট নেভি, ওয়ার্ল্ড ভিশন, রেড ক্রস, ফিলিপাইন, ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, যুক্তরাজ্য, ইউএসএইড, ইসলামিক রিলিফ-ইউকে, স্পেন, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডাব্লএফপি) পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল সেদিন। তাদের জন্য জানাচ্ছি আরও একবার কৃতজ্ঞতা।
এতো দিনে এই ক্ষতচিহ্ন একে বারেই মুছে যায়নি। প্রমাণ মিলবে, দক্ষিণাঞ্চল অভিমুখে যাত্রা করলেই। চারদিকের প্রকৃতিই দাঁড়িয়ে আছে সেই নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হয়ে। গায়ে খাটা মানুষ এই ক্ষতি কি আজও পূরণ করতে পেরেছেন? হিসেব মিলাতে পারিনি আজও!
বাংলাদেশ সময়: ০৭০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৩
এনএস/জিসিপি