ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

নারী, পুরুষ ও হিজড়া

আমিনুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৩
নারী, পুরুষ ও হিজড়া

আচ্ছা আপনি একজন পুরুষকে কি ‘পুরুষ’ হিসেবে সম্বোধন করেন? কিংবা নারীকে ‘নারী’? নাকি যার যার নাম ধরে সম্বোধন করেন বা বয়েস ভেদে শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী বা এরকম বিভিন্ন উপায়ে সম্বোধন? একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ধরুন আপনি একটি শিশুকে হত্যা করলেন, তো খবরের শিরোনাম ঠিক কোন রকম হবে? ‘পুরুষের বিরুদ্ধে শিশু হত্যার অভিযোগ’ কিংবা ‘নারীর বিরদ্ধে শিশু হত্যার অভিযোগ’? নিশ্চয়ই ভাবছেন এইসব আজেবাজে প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কেন? আসলে পত্রিকায় একটি খবরের শিরোনাম দেখে চোখ আঁটকে গেলো তাই এইসব প্রশ্নের অবতারণা।



শিরনামটি অনেকটা এই রকম ‘হিজড়ার বিরুদ্ধে শিশু হত্যার অভিযোগ’। খবরে বলা হচ্ছে, টাকা নিয়ে ঝামেলার কারণে চুরির অভিযোগে ওই শিশুকে হত্যা করা হয়। আমি ভাবছিলাম ধরুন ওই শিশুটি যদি কোনো এক পুরুষ ব্যক্তির হাতে খুন হতো তাহলে কি খবরের শিরোনাম হতো ‘পুরুষের হাতে শিশু হত্যা’? আজকাল যে হত্যাকারীকে লিঙ্গ ভেদে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে তা আমার জানা ছিলো না।

এই খবরটি এমন একটা সময়ে পেলাম যার ঠিক কিছু দিন আগে দেশে একটি নতুন আইন হয়েছে যেখানে নতুন করে তৃতীয় একটি লিঙ্গকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে আর তাঁদের আমরা বলছি ‘হিজরা’। যতটুকু জানতে পেরেছি এই শব্দটির ইংরেজিও সেই একই হবে অর্থাৎ ‘হিজরা’। এটি অবশ্য করা হয়েছে কোনো ধরনের মিস ইন্টারপ্রিটেশন বা ভুল ব্যাখ্যা যেন না হয়। যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে মনে হয়েছে এখন থেকে আমাদের পরিচয় প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যে দুটো অপশন, পুরুষ ও মহিলা চালু ছিলো তার সাথে হিজরা আরেকটি অপশন হিসেবে বিবেচিত হবে।

এই উদ্যোগকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। এর ফলে হয়তো সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁরা যে অসমতা পেয়ে আসছে তার কিছুটা হলেও যদি লাঘব হয়। শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকুরি থেকে শুরু করে অন্য সকল ক্ষেত্রে তাঁদেরও অন্যান্যদের মতো সুযোগ দিতে হবে এবং এই ক্ষেত্রে কোনো রকম বৈষম্য হয়তো আইনের বরখেলাপ হিসেবে দেখা হবে।

তবে সমাজে এমন অনেক বিষয় আছে যা আসলে শুধু আইন করে যেমন বন্ধ করা যায় না ঠিক তেমনি আইন করে অনেক কিছুর প্রচলনও করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন সমাজের মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এই যেমন হিজড়াদের সম্পর্কে আমাদের রয়েছে এক ধরনের নেতিবাচক ধ্যান ধারণা, যেমন এরা বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে  অনেকটা জোর করে টাকা সংগ্রহ করে, কিংবা নানান অসামাজিক কার্যকলাপের সাথে যুক্ত ইত্যাদি।

এদের অনেকে হয়তো এই সব কর্মের সাথে যুক্ত। কিন্তু কেউ কি খোঁজ নিয়ে জেনেছে তাঁরা ঠিক কি কারণে এইসব করে? আপনি যদি তাঁদের সব ধরনের মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত করেন তাহলে তাঁদের যাবার জায়গা কোথায়? স্কুলে গেলে যদি স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়, কাজ খুঁজলে যদি না দেওয়া হয়, চিকিৎসার জন্য গেলে যদি দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন তাহলে তাঁরা বাঁচবে কি করে? এরা তো মানুষ। আর বেঁচে থাকার জন্য আমার আপনার যা প্রয়োজন তাঁর সবই তাঁদেরও প্রয়োজন। যেকোনো প্রাণী তাঁর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ নিজেরাই সংগ্রহ করে থাকে। ধরুন, একটি ক্ষুধার্ত বাঘ যখন বনে খাদ্য পায় না তখন কিন্তু সে লোকালয়ে এসে গৃহপালিত গরু, ছাগল ধরে নিয়ে যায়। এমনকি মানুষের উপরও আক্রমণ করে। শুধু বাঘ কেন অন্যান্য প্রাণী যাদের জীবন আছে তাঁরা সবাই বেঁচে থাকার তাগিদে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে থাকে।

মানুষ হিসেবে আমাদের সমাজে মানুষের যে মৌলিক চাহিদা সেগুলো কি কখনো এই হিজড়ারা পেয়েছে? যদি না পেয়ে থাকে তাহলে বেঁচে থাকার জন্য তাঁদের তো কিছু করতে হবে। আমারতো মনে হয় এই জনগোষ্ঠী সেই অর্থে কোনো রকম অধিকার এবং সমতা না পাওয়া সত্ত্বেও সমাজের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ হয়নি বরং সবার সাথে মিলে মিশে চলার আপ্রাণ চেষ্টাই তাঁরা করে। বিভিন্ন সামাজিক ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় কিন্তু এটি উঠে এসেছে। আমরা বরং স্বাভাবিক জীবন থেকে তাঁদের বার বার দূরে ঠেলে দিয়েছে।

সরকার এই জনগোষ্ঠীকে আলাদা একটি লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তাঁরা এখন থেকে নারী-পুরুষের মতো আলাদা একটি লিঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত হবে। এটি অবশ্যই একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এর মাধ্যমেই যে সমাজের সকলের হিজড়া সম্পর্কে ধ্যান ধারণার পরিবর্তন ঘটে যাবে কিংবা তাঁরা কোনো রকম বৈষম্যের শিকার হবে না এটি কিন্তু বলা যায় না। কারণ অনেক সময় সমাজের অনেক কিছুই শুধু আইন দিয়ে করা সম্ভব নয়। তাই এর জন্য দরকার জনসচেতনা। আর এই সচেতনার ক্ষেত্রে দুটো দিক এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের দেশের গণমাধ্যম অনেক এগিয়ে গেছে। ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো এখন অনেক দ্রুত খবর পরিবেশন করে থাকে। একটা সময় ছিলো যখন আমাদের আকাশবাণীর উপর নির্ভর করতে হতো কিংবা বিবিসি রেডিওর খবর শোনার জন্য আমারা অপেক্ষায় থাকতাম। এখন আর সে অবস্থা নেই। আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলো এখন যথেষ্ট ভালো একটি অবস্থায় পৌঁছে গেছে। আর আমাদেরও সেই অর্থে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের উপর নির্ভর করতে হয় না। পত্রিকারগুলোর মাঝে রয়েছে সুস্থ একটি প্রতিযোগিতা, কে কার আগে সংবাদ পৌঁছে দিতে পারবে। অনলাইন নিউজগুলো তো রীতিমত এখন অনেক ক্ষেত্রেই শীর্ষে অবস্থান করছে। আর পাঠক হিসেবে আমরাও নিজেদের সংবাদ মাধ্যমগুলোকেই বেছে নেই।

সংবাদ যেহেতু একটি শক্তিশালী মাধ্যম, তাই তাঁদের একটা ভ‍ূমিকা রয়েছে জনসচেতনতা তৈরি করার ক্ষেত্রে। সবগুলো সংবাদ মাধ্যমে যদি হিজড়াদের আর বাদ বাকি সবার মতো উপস্থাপন করা হয় এবং এদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যাদি প্রকাশ করা হয় তাহলে একটা সময় হয়তো সাধারণ মানুষের মাঝেও এদের সম্পর্কে পজিটিভ একটি ধারণা জন্মাবে আর এর মাধ্যমে হয়তো স্বাভাবিক একটি জীবন এই জনগোষ্ঠী পেতে পারে।

এছার বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রয়েছে, ফেইসবুক যার মধ্যে অন্যতম এবং আমাদের দেশে তরুণ সমাজের কাছে ভীষণভাবে জনপ্রিয়। ফেইসবুকে নিজেরাই জনসচেতনা সৃষ্টি করতে পারি। অন্তত সমাজের একটি অংশ এখান থেকে এই জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সচেতন হলো। প্রত্যেকেই যদি প্রত্যেকের অবস্থান থেকে এই ভুলগুলো ধরিয়ে দেই তাহলেও কিন্তু কম কিছু করা হয় না।
 
বলছি না সরকারের এই ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা নেই। সরকারের তো অবশ্যই ভূমিকা রয়েছে। ধরে নিচ্ছি, সরকার যে উপায়ে এবং পদ্ধতিতে জনসচেতনা তৈরি করে সেটাতো তাঁরা করবেই। তাঁর সাথে শক্তিশালী সংবাদ মাধ্যম যদি এগিয়ে আসে তাহলে হয়তো এই মানুষ গুলো সম্পর্কে আমাদের সবার ভুল ধারণাগুলো আস্তে আস্তে ভেঙে যেতো।

পত্রিকায় খবরের একটি শিরোনাম দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম। শিরোনাটি ছিলো ‘হিজড়ার বিরুদ্ধে শিশু হত্যার অভিযোগ’। খবরের বিবরণে দেওয়া আছে টাকা চুরিজনিত কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। যেকোনো হত্যাকাণ্ড অতি নিন্দনীয়। তবে এই খবরটির শিরোনাম দেখে মনে হয়েছে হত্যাকারীর লিঙ্গ পরিচয়টিকে কেন যেন বড় করে দেখা হয়েছে। আমি অনেক খুঁজে পেতে এমন কোনো খবরের শিরোনাম পাইনি যার শিরোনাম ‘পুরুষের বিরদ্ধে শিশু হত্যার অভিযোগ’। অর্থাৎ ওই খবরের শিরোনাম দেখে মনে হলো সমাজের সেই যে একটা ধারণা হিজড়াদের সম্পর্কে সেটি থেকে বেরিয়ে এসে হয়তো রিপোর্টটি করা সম্ভব হয়নি।

আমাদের সমাজ এখন তাদের অধিকার দিতে যাচ্ছে, হ্যাঁ মানবাধিকার। রাষ্ট্র বা সমাজের মানুষ হিসেবে তারা যদি অন্যায় করে তাহলে অন্যান্যদের যে শাস্তি হওয়ার কথা সেটি যেমন তাদের প্রাপ্য ঠিক তেমনি মানুষ হিসেবে অন্যান্যদের মতো যে সুযোগ সুবিধা তাদের প্রাপ্য সেটি কিন্তু তাদের দিতে হবে।

লেখক: আমিনুল ইসলাম, শিক্ষক সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৩
এমজেএফ/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।