বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্লজ্জ রাজনীতিক হিসেবে খ্যাতি আছে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের। নির্বাচন নিয়ে সম্প্রতি তিনি এতোটাই বিভ্রান্ত যে, কখন কি বলছেন সেটি মনে রাখার মতো বোধবুদ্ধিও শিকেয় উঠেছে!
আশি-ঊর্ধ্ব বয়সে প্রেসিডেন্ট হওয়ার খায়েশে মিনিটে মিনিটে কি বলছেন, কি করছেন তিনি যেখানে নিজেই ঠাওর করতে পারছেন না, সেখানে তার গুটিকয়েক সমর্থক যে রাজনীতির মাঠে তারই মতো পথ হারিয়ে ফেলেছেন তা বলা বাহুল্য।
শুধু এরশাদ কেন, ২৪ অক্টোবরের পর থেকে আমাদের প্রধান দু`দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, নির্বাচন নিয়ে দলের বড় নেতা থেকে শুরু করে আঁতি-পাতি সব নেতাই বিভ্রান্ত। কখন কে কি বলছেন, কি করছেন, কি করবেন কেউ কিছু জানেন না।
২.
হঠাৎ করেই আমরা জানতে পারি মন্ত্রিপরিষদের সব মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। মিডিয়া ফুটেজে পদত্যাগপত্র দিতে যাওয়া মন্ত্রীদের হাসিমুখের ছবি আমরা সবাই দেখেছি। ধারণা করতে কষ্ট হয় না যে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই অনুগত মন্ত্রীরা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।
পদত্যাগ নিয়ে যে সরকার দলের রাজনীতিকরা বিভ্রান্ত ছিলেন তা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে একেক জনের একেক রকম উত্তরেই স্পষ্ট প্রতীয়মান। অথচ পরে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, মন্ত্রীরাই নাকি সবাই পদত্যাগের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন এবং একযোগে পদত্যাগ করেছেন।
আমাদের মন্ত্রীদের পদত্যাগের ব্যাপারে এতোই যদি নৈতিক তাগিদ থাকতো তাহলে দেশের ৮০ ভাগ সমস্যা এমনিতেই সমাধান হয়ে যেত! মান যায় যাক, চেয়ার ছাড়ার কথা তারা দুঃস্বপ্নেও চিন্তা করেন না। সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে না জানিয়ে তারা পদত্যাগ করবেন, বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে এমন ভাবনা ভাবাটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধও বটে!
সংবিধান অনুযায়ী নাকি তারা পদত্যাগ করেছেন- এমন কথা শোনার পর সংবিধান বিশেষজ্ঞদের এ বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু হয়ে যায়। গবেষণার ফলাফল পত্র-পত্রিকায় আসা মাত্রই আমরা জানতে পারি, আমাদের মহান মন্ত্রীরা সবাই নাকি তারিখহীন পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন! কেউ কেউ তো এক কাঠি উপরে গিয়ে বলছেন, তারা নাকি স্বাক্ষরহীন পদত্যাগপত্র দিয়েছেন।
ঘটনা সত্যি হয়ে থাকলে, তারিখ এবং স্বাক্ষরহীন পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার নাটকের অবতারণা করার অর্থ কি? যেখানে তারা ভালোভাবেই জানেন যে প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে এই পদত্যাগপত্র দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির কাছে অনুমোদনের জন্য পৌঁছে যাবে, সেখানে এরকম অসম্পূর্ণ পদত্যাগপত্র জমা দেওয়া কি শৃঙ্খলাভঙ্গের আওতায় পড়ে না? এ কি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করার মতো ধৃষ্টতা নয়?
আচ্ছা ঠিক আছে তর্কের খাতিরেই মেনে নিলাম প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তারিখহীন এসব অসম্পূর্ণ পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর অনুমোদন দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী এক সম্মেলনে বলেছেন, তিনি এসব পদত্যাগপত্রের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে কিছু কিছু গ্রহণ করবেন এবং তা রাষ্ট্রপতির কাছে কার্যকর করার জন্য পাঠিয়ে দেবেন। অর্থ্যাৎ কিছু কিছু মন্ত্রীর নেক উদ্দেশ্য সফল হবে। তারা মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হবে। অন্যার্থে, কিছু কিছু মন্ত্রীর পদত্যাগপত্র গৃহীত হবে না। অর্থ্যাৎ তারা মন্ত্রিত্বের গুরুদায়িত্বে পুনরায় বহাল হবেন।
যেখানে প্রধানমন্ত্রীর উপর পদত্যাগ নাটকের যবনিকা নির্ভর করছে, সেখানে ‘সংবিধান’ নামক দুরূহ, অবোধ্য এই জিনিসের দোহাই দেওয়া হচ্ছে কেন বারবার? আর সেই পদত্যাগপত্রগুলো যিনি কার্যকর করবেন, সেই মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে যেতে তাহলে কত কার্যদিবস লাগবে?
পদত্যাগ নিয়ে নাটক, নির্বাচনে মনোনয়ন কেনা-বেচা নিয়ে নাটক, সব কিছু নিয়েই যেন আওয়ামী লীগ পুরোপুরি বিভ্রান্ত। একতরফা নির্বাচন যে পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের জন্য হিতে বিপরীত হবে, তা বোঝার মতো বোধ আওয়ামী লীগের যে নেই তা-ও কি আমাদের বিশ্বাস করতে হবে?
৩.
অন্যদিকে রাজনীতির ময়দানে চরম বিভ্রান্ত দল বিএনপি যেন পুরোপুরি পথের দিশা হারিয়েছে। সরকার পতনের লাগাতার আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে দেশে লাগাতার কিছুদিন অন্তর অন্তর কয়েকদিনের হরতাল দিয়েছে তারা। ফলাফল হলো বেশ কিছু নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষের শরীর পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া আর জনগণের পক্ষ থেকে দলটির উপর নিরেট ধিক্কার।
বাবার বুকের সঙ্গে লেপ্টে থাকা দগ্ধ ছোট্ট মুনির, অটোরিকশা চালক আসাদুল গাজীর ব্যান্ডেজবিহীন হাতের আঙুল, মন্টু পালের আর্তনাদ ছাড়া এই হরতাল বিএনপিকে কি দিয়েছে? সরকারকে নড়ানো তো দূরের কথা, নিজেদের নেতৃত্বের দেউলিয়াপনা প্রকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
‘হরতাল ছেড়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করব না’ এমন অহমিকা প্রকাশ করা বিএনপি এখন নির্বাচনের জন্য আলোচনায় যেতে উদগ্রীব হয়ে আছে। আপসহীন তকমা পাওয়া বিরোধীদলীয় নেতা আপস করার জন্য দেশি-বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে একের পর এক আলোচনা করে যাচ্ছেন।
যে সমস্যা ফোনালাপের দিনই হয়তো কিছুটা নমনীয় হয়ে করা যেত, তা না করে জিইয়ে রেখে এখন সমাধানের পথ হাতড়ে মরছে প্রধান বিরোধী এই দলটি। তার উপর ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে যুক্ত সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে না পারছে গিলতে, না পারছে ওগরাতে।
তারেক রহমানের বিচারের রায়, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য আলোচনা, কূটনীতিকদের চাপ, হরতালে গ্রেফতার হওয়ার আশংকার অজুহাতে প্রধান নেতাদের গা ঢাকা দেওয়া, পাতি নেতাদের রাজপথে না থাকা, শিবিরের নাশকতা-----সব মিলিয়ে বিএনপির যে লেজেগোবরে অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়।
৪.
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের দলের মধ্যেই সমন্বয়হীনতা, বিশৃঙ্খলা তৈরির ফলে তারা নিজেরা যেমন পথ হারিয়েছে, আমাদের জনগণকেও তেমনি করছে বিভ্রান্ত, ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারে, অনিশ্চয়তার পথে।
দেশের এই রাজনৈতিক সংকটে সুষ্ঠু সমাধানের পথে তাই রাজনৈতিক দলগুলি শুধু নয়, দল-মত নির্বিশেষে আমরা সবাই পথহারা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৩
এএ/জিসিপি/জেএম