ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

তরুণরা রুগ্ন রাজনীতি থেকে দেশকে মুক্ত করবেই

সাইফ উদ্দিন আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৩
তরুণরা রুগ্ন রাজনীতি থেকে দেশকে মুক্ত করবেই

এক সময়ের সাহায্য নির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্য নির্ভর দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে কেবল পোষাক রপ্তানি করেই বাংলাদেশ উপার্জন করেছে ১ লাখ ৭২ হাজার কোটি টাকা।

প্রবাসী আয়, কৃষি, শিক্ষা, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখ করার মতো।

এ অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে রুগ্ন ক্ষমতানীতির রাজনীতি তথা সহিংস এবং ধ্বংসাত্মক রাজনীতি।
গণতান্ত্রিক চর্চায় জনরায় মেনে নেয়া, নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়া কিংবা ক্ষমতার বাইরে থাকা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না আমাদের সম্মানিত রাজনীতিবিদরা।

প্রতি পাঁচ বছর অন্তর রাজনৈতিক দলগুলো কলহ বিবাদে জড়ায় নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে। যে দল নির্বাচিত হয় সে দল আজীবন ক্ষমতায় থাকার প্রত্যাশায় ক্ষমতায় গিয়ে বিরোধী দলের উপর দমন-পীড়ন চালায়। বিরোধী দল সংসদ বর্জন করে নামে রাজপথের আন্দোলনে।

ক্ষমতার রাজনীতির অশুভ প্রতিযোগিতা রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো হয়ে পড়েছে অনেকাংশে ব্যবসায়ীদের আশ্রয়স্থলে। নির্বাচন পরিণত হয়েছে টাকার খেলায়, শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মহড়ায়।

সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী ও কার্যকর করা না গেলে রুগ্ন ক্ষমতানীতির রাজনীতি থেকে আমরা মুক্তি পাবো না। সংসদ, আদালত, স্বায়ত্ত্বশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, দুদক, তথ্য কমিশন, মানবাধিকার কমিশন কতটা স্বচ্ছ, শক্তিশালী এবং কার্যকর তার উপর নির্ভর করছে আমাদের রাজনীতির ভবিষ্যত তথা বাংলাদেশের ভবিষ্যত। রাজনৈতিক দলগুলো এ সব প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণের উদ্যোগ না নিলে সেটা জনগণের জন্য চিন্তার বিষয়।

দেশে কার্যকর এবং দল নিরপেক্ষ নাগরিক সমাজ প্রয়োজন। নির্বাচনের দিনে ভোট দিয়ে ’এক দিনের গণতন্ত্র চর্চা’ করেই আমাদের কর্তব্য সম্পন্ন হয়েছে বলে ঘরে বসে থাকলে হবে না। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আমরা সাধারণ নাগরিকরা রাষ্ট্রের মালিক। নাগরিকরা শুধু নিজেকে মালিক ভেবে ঘরে বসে থাকলে হবে না।

প্রকৃত মালিক হলো সে - যে সক্রিয়, সোচ্চার, স্বাধীন, কর্তব্য পালন করে, দায়িত্ব নেয় এবং নির্লিপ্ত নয়। আমরা যারা নাগরিক তাদের নাগরিকত্ববোধ থাকতেই হবে। নাগরিক তথা দেশের মালিক হিসেবে আমাদের একটি অন্যতম দায়িত্ব হলো, ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত নেতৃত্ব নির্বাচন করা।

২০১৩ সালে এসে দশম সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বহুলাংশে ইতিহাসেরই যেন আবার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলছে। আমাদের দু’টি প্রধান দল-  আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার বর্তমান বিরোধ মূলত নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথাসময়ে হতে হবে, সবার অংশগ্রহণে হতে হবে এবং নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবেই হতে হবে। কিন্তু সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হলেই আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না। নির্বাচনের পরই পরাজিত দল নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলতে এবং ফলাফল মেনে নাও নিতে পারে। এমনকি হরতাল ও অবরোধসহ সহিংস আন্দোলনেরও আশ্রয় নিতে পারে।

রুগ্ন ক্ষমতানীতির এ রাজনীতিকে বছরের পর বছর চালিয়ে নেওয়ার এ পদ্ধতি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম সমর্থন করছে না। বিভিন্ন জরিপের মাধ্যমে, টেলিভিশন টক শো তে, পত্রিকায় তাদের লেখনীর মাধ্যমে তারা তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিকদের কাছে সাহায্য-সহায়তা চায় না। তারা চায় আইনের শাসন এবং সহায়ক পরিবেশ যেখানে নিজেদের চেষ্টায় তারা নিজেদের এবং দেশের উন্নয়ন করতে পারে।

জনহিতকর রাজনীতির চর্চা তথা বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, মিডিয়া সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে একটা সমাধানের লক্ষ্যে। সংবিধানকে বারবার কাটাছেঁড়া করা শুভ লক্ষণ নয়। নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ, শক্তিশালী, কার্যকর ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী ও কার্যকর করতে হবে। স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করে কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে হবে।

আমাদের সংবিধান বার বার সংশোধন করা হচ্ছে। মাত্র ৪২ বছরে ১৫ বার বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধিত হওয়া,পৃথিবীর যেসব দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চা হয় সেসব দেশের তুলনায় বেমানান। তাই সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কি হবে তার একটি স্থায়ী সমাধান বের করা প্রয়োজন।

রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা প্রয়োজন। সংবিধানের এতগুলো সংশোধন কি কারণে এবং কতটা জনস্বার্থে করা হয়েছে তা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরুপ, যুক্তরাষ্ট্রে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য  কর্তৃক পাশের পর তিন-চতুর্থাংশ অঙ্গরাজ্য কর্তৃক সেই সংশোধনী অনুমোদন করতে হয়। এ ধরনের বাধা নিষেধের কারণে ১৯৯২ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে কোনো পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। এমনকি সেই দেশে নারী-পুরুষের সমতা সম্পর্কিত ’ইকুয়েল রাইটস অ্যামেন্ডমেন্ট’ ও একাধিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পাশ হয়নি।

আমাদের নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। নাগরিকের স্বার্থ রক্ষার লক্ষে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা কমিশনের দায়িত্ব। এ লক্ষে কমিশনকে অগাধ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের অগাধ ক্ষমতা থাকলেও, কমিশন যেন তা প্রয়োগে অনিচ্ছুক বা অপারগ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্বাচন হয় জনগণের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে দু’টি দলের মধ্যে লড়াই চলছে তো চলছেই। এ লড়াইয়ে যথাযথ রেফারির ভূমিকাটা পালন করতে পারছে না নির্বাচন কমিশন। ফলে জনগণ নির্বাচন থেকে সরে যাচ্ছে।  

সংসদকে সমাজের সর্বক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বশীল সত্যিকারের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলে ও কার্যকর করে সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ রাজনৈতিক দল গড়ে উঠবে - এ প্রত্যাশাটা আমরা করতেই পারি সম্মানিত রাজনীতিবিদদের কাছে। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারালয় থাকলে সাধারণ মানুষ নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করতে পারে। দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনা করবে - এটা আমাদের চিরন্তন প্রত্যাশা। মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে দক্ষ ও দল নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে পুনর্গঠন ও কার্যকর করার দাবি বহুদিনের। পুলিশ বিভাগের সংস্কার কার্যক্রম কবে যে আলোর মুখ দেখবে কে জানে। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রচলিত ব্যবস্থার সংস্কার করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হওয়া প্রয়োজন।

সর্বস্তরে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের অনুপস্থিতি আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নাজুক করেছে। কারণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির খুঁটিস্বরুপ আর খুঁটিহীন গণতন্ত্র শূন্যে ঝুলস্ত ফানুসতুল্য এক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে, যার কারণে বিশাল সম্ভাবনাময় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে দ্রুত সম্পদে পরিণত করা যাচ্ছে না।

সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধিদের শাসন কায়েম না করেও শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়। যেগুলোতে নির্বাচন হয়েছে সেসব নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকেও ক্ষমতাহীন করে রাখা হয়েছে। ক্ষমতা দিন দিন কেন্দ্রীভূত হচ্ছে ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও সম্পদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থায় গবীব মানুষ চরমভাবে বঞ্চিত ও শহর-গ্রামে ব্যাপক বৈষম্য তৈরি হয়েছে।

শক্তিশালী এবং কার্যকর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা গেলে তৃণমূলে জনকল্যাণকামী নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। নারী নেতৃত্ব বিকশিত হবে। স্থানীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব হবে। স্থানীয় সমস্যার স্থানীয়ভাবে সমাধান হবে।
বিকেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। তাই একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে স্বায়ত্তশাসিত, শক্তিশালী ও কার্যকর এবং প্রয়োজনীয় সম্পদ (যেমন, জাতীয় বাজেটের ৪০ শতাংশ) ও ক্ষমতা এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করার উদ্যোগ নিতে হবে। সফল এবং সুষ্ঠু বিকেন্দ্রীকরণের জন্য স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন করা যেতে পারে।

ক্ষমতানীতি নিয়ে মত্ত অসম্ভব সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে সুষ্ঠু রাজনীতির ধারায় ফেরাতেই হবে। এ কঠিন কাজটা আমাদের করতেই হবে। আমরা আশাবাদী আমাদের তরুণ প্রজন্ম এ অবস্থা বেশিদিন চলতে দেবে না। তারা জাতিকে সুষ্ঠু রাজনীতির ধারায় ফেরাবেই। তারুণ্যের ধর্মই সামনে তাকানো, এগিয়ে যাওয়া, বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত অন্যায্যকে হটিয়ে দেয়া।

সাইফ উদ্দিন আহমেদ: প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর (গভর্ন্যান্স) দি হাঙ্গার প্রজেক্ট ও সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক

বাংলাদেশ সময়: ১২৫৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৩
জেডএম/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।