আমরা কেউ এর আগে নির্বাচনকালীন নির্বাচিত সরকার দেখিনি। আমাদের কাছে নির্বাচনকালীন সরকার মানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটা কিছু।
এরপর যেটা করতে হবে তা হলো সদ্য বিদায়ী সরকারের বেশ ক’ জন মন্ত্রী-এমপিকে গ্রেফতার, মামলা হামলা করতে হবে। আর সেটা যদ্দিন না হয় ততদিন আমরা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হিসেবে ধরে নিই না।
এটা ভাসমান তত্ত্বাবধায়কের কাজ হয়তো হতে পারে, কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকারের কাজ এটা নয়। পৃথিবীর কোন দেশে এটা হয় না। আমরা যেমন নির্বাচনকালীন সরকার চিন্তা করি সেটা কিন্তু উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নেই। আমরা সেই পদ্ধতিটি দেখিনি বলেই এমনটা চিন্তা করছি। আমরা যা কিছু দেখেছি, শুধু সেটার অনুকরণে ভাবতে পারি। তাই আমাদের স্মৃতিতে তত্বাবধায়কের কর্মকাণ্ড ভাসে। তাই আমরা সেটাকেই বিশুদ্ধ নির্বাচনকালীন সরকারের কাজ জ্ঞান করি।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নামে মূলত সদ্যবিদায়ী সরকারকে বিপদে ফেলা হয়। পদ্ধিতিটি এমন সাজানো হয়, সদ্য বিদায়ী সরকার যত ভালো কাজই করুক তারা ক্ষমতায় আসবে না। ১৯৯৬ সালে আমরা দেখেছি। ২০০১ সালে আমরা হাজারী ও শামীম ওসমানের উপর পরোয়ানা জারি করে বিদায়ী আওয়ামী লীগকে কোনঠাসা করতে দেখেছি। হাজারীর কথা বলাতে অনেকে এতে নাক সিটকাতে পারে। তবে সত্য হলো হাজারীকে যে ডিসি সোলায়মান চৌধুরী বিতাড়িত করেছিলেন, তিনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারীর দায়িত্বে ছিলেন। এরপর ২০০৮ সালে ফখরুদ্দীন সরকারও সদ্যবিদায়ী বিএনপিকে ব্যাপক কোনঠাসা করেছে। তারেক, কোকো, খালেদা গ্রেফতার হয়েছে। সুগম হয়েছে আওয়ামী লীগের পথ। সুতরাং লাভ কার? এভাবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়?
আমাদের কাঠামোটা এমনভাবে সাজানো হয়েছে বা হয়ে গেছে সেখানে প্রতিবারই সরকার পরিবর্তন হবে। এটা by rotation democracy । এই পাঁচ বছর এই দল। পরের পাঁচ বছর ওই দল। আর এটা অদৃশ্যভাবে কার্যকর করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির নামে লোক দেখানো কিছু হুজুগে জনপ্রিয় কার্যক্রম।
প্রশ্ন হলো, তাহলে আমরা কিভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করবো। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যেভাবে করে আমরাও সেভাবে করব। আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করবো পেশাদারী প্রশাসন যন্ত্রের দক্ষতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে। দক্ষ প্রশাসন যন্ত্র কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। প্রত্যেক স্তরে উপস্থিত বিজ্ঞ কর্মকর্তারা জানেন তাদের এই সময়ে কী দায়িত্ব। এবং তারা সেটাই নিশ্চিত করেন। এবং সেটা নিশ্চিত করা ছাড়া উপায়ও থাকে না। গণমাধ্যম, নির্বাচন পর্যবেক্ষক, বিশ্ব মোড়লরা এমনভাবে নজর ফেলে আছে, এখানে কেউ দায়িত্ব অবহেলা বা বৃহদাকারে পক্ষপাতিত্ব করলে তা মুহূর্তেই ধরা পড়ে। আমার বিশ্বাস এমন একটি প্রশাসন যন্ত্র আমাদের আছে। কেননা, তত্ত্বাবধায়ক এলে এরাই কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা করে। মঙ্গল বা বৃহস্পতি গ্রহ থেকে কেউ উড়ে আসে না।
মনে হয় আমরা যে একটা নতুন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এগুচ্ছি সেটা সম্পর্কে শেখ হাসিনাও পূর্ণ সচেতন নন। নির্বাচনকালীন সময়ে কিভাবে সরকার পরিচালিত হবে তার জন্য বছরখানেক আগে একটা খসড়া দাঁড় করানো তার দায়িত্ব ছিল। তিনি বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন নির্বাচিত সরকার পরিচালনা করছেন প্রথমবারের মতো। দূরভবিষ্যতের জন্য এটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। অপরিকল্পনার ফলে এখনও মন্ত্রীদের পদত্যাগে বিলম্ব, বিলম্ব সংসদসহ বিভিন্ন বিব্রতকর কর্মকাণ্ড চলছে। শেখ হাসিনার অন্তবর্তীকালীন সরকার কিভাবে গঠন করবেন সেটাও পরিষ্কার নয়। তার উচিত ছিল সংসদ প্রতিনিধিত্বকারী সবদলের সমন্বয়ে সরকারের গঠনের উদ্যেগ নেয়া। তার জন্য ৯০ দিন আগেই তার উচিত ছিল সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর কাছে মন্ত্রিসভায় অন্তুভূর্ক্তির জন্য নাম চেয়ে চিঠি পাঠানো। সেখান থেকে মন্ত্রিসভায় কারা আসছেন সেটা নির্ধারণের পর বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ওইদিনই নতুন সভা গঠন করা। শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার জন্য বিএনপি বা অন্য কোন দলকে চিঠি দিয়েছেন বলে জানি না। তা না হলে তারা আসবে কিভাবে? যেচে? চিঠি যদি না দেন তাহলে মন্ত্রিসভা ভাঙলেন কেন?
শেখ হাসিনার ছিল উচিত এক্ষুনি বিএনপিসহ সব দলের কাছে নাম চেয়ে চিঠি দেয়া। হয়তো তিনি বলবেন, তারাতো সরকারে যোগ দেবে না। না দিক, কিন্তু ভবিষ্যত নির্বাচনগুলোতে কিভাবে সরকারের গঠন হবে তার একটি আনুষ্ঠানিক রীতি তৈরি হয়ে যেতো নিশ্চয়ই।
মনোয়ার রুবেল: ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট, monowarrubel@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১১৩১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১৩
জেডএম/জিসিপি