ফার্স বা কৌতূকেরও একটা সীমা থাকে! আমাদের দেশ ও জনগণ কি এতই দুর্ভাগা, বোকা যে তারা কৌতূক কোনটা, কোনটা সিরিয়াস তাও বোঝে না? নেতাদের মাথায় কি ঢুকেছে জানি না। তারা হয় উদভ্রান্ত, নতুবা পচে গলে একাকার।
মঙ্গলবার সবশেষ কৌতূকের জন্ম দিলেন এরশাদ। গুলশান কার্যালয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবার ঘোষণা দিয়ে আবারো প্রমাণ করলেন তার মুখের কথা আর কাজে কোনো মিল নেই।
অতীতের কথা থাক। এবার তিনি কি বললেন? নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়নি তাই তিনি যাবেন না। তাই যদি সত্য হয়, তাহলে দায় তো তার মন্ত্রীদেরও আছে। যাদের তিনি মন্ত্রিসভায় পাঠিয়ে সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা বানানোর চেষ্টায় ঘি ঢাললেন, তাদের ভূমিকা কি তবে? তাছাড়া বাসর রাত শেষ না হতেই বিচ্ছেদের কাবিননামা পাঠানো এটা কেমনতর সম্পর্ক?
এরশাদ সাহেবকে বিশ্বাস করার মাশুল দেবে আওয়ামী লীগ। সেটা তাদের ব্যাপার, কিন্তু আমরা কি দেখছি? কি দেখছে দেশের মানুষ? প্রবাসী বাংলাদেশি বা সারা বিশ্বের কৌতূহলী চোখ, যারা আমাদের খবরাখবর রাখেন বা রাখতে হয় যাদের, তারা কি দেখলো? হাস্যকর এই নির্বাচনে না গেলেও নাকি মন্ত্রিসভায় থাকতে আপত্তি নেই। আরে, যদি পরিবেশই না হবে তবে তো এরা ব্যর্থ। এই ব্যর্থ মন্ত্রিসভায় নিজের লোকজন রাখবেন কেন আপনি!
বড় নোংরা জায়গায় চলে গেছি আমরা। কে কি বলছে, কেন বলছে, কি খেলছে বলা মুশকিল। এরশাদ সাহেবের অতীত কি বলে? তিনি কি কখনো কথা রেখেছেন, না কথা রাখার লোক তিনি? সরকারি দলের সঙ্গে জোট বাঁধার পর থেকে যখন যা খুশি বলে বেড়ানোই তার কাজ। এটা কি রাজনীতি?
বিরোধীদলে থাকলে যেসব দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়, মানুষকে যেসব ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে সচেতন করতে হয়, তার কোনো কিছুই দেখিনি কোনদিন। অবশ্য সেটা বোঝা তার কর্মও নয়। গদি দখল করে রাজনীতি করতে আসা মানুষ তিনি।
রেডিমেড ফ্যামিলির মতো সবকিছু রেডিমেড চান তিনি। পেয়েছেনও। হাসিনা-খালেদার ঝগড়া আর বৈরিতার সুবাদে তার আসন পোক্ত হয়েছে। শাস্তির বদলে ধীরে ধীরে সিংহাসনের কাছাকাছি চলে আসা এরশাদ সাহেবের বৈশিষ্ট্য আনুযায়ী এই ঘোষণা আমাকে তাই একটুও অবাক করেনি। কে জানে এর পেছনে আবার কি চাল আছে?
তবে তার এই ঘোষণা যদি সত্য হয়, আওয়ামী লীগের জন্য একটি ভালো ও একটি খারাপ খবর জমা থাকবে। খারাপ- এই মহাজোটের পচা ‘পা’ টি কেটে বাদ দেওয়া। আর ভালো খবর- এই মোজা জোড়া বিফলে যাবে না। একদম ফাটাফাটি ফিটের জন্য বিএনপি তা চড়া মূল্যে কিনে নেবে। কিন্তু মুশকিল হলো আমাদের তরুণ প্রজন্ম বা নাগরিকরা কি শিখছে? কি দেখছে তারা? যাদের আমরা নেতা বলছি, তারা যদি সকালে এক কথা বিকেলে এক কথা বলেন একবার প্রগতিবাদী আবার দোয়ার জন্য ছোটেন তবে ভারসাম্য কোথায়? আমার মতো অল্প জানা মানুষও এটা বুঝতে পারছি, কল নড়বড়ে হয়ে গেছে অনেকের।
বয়সের চাপে হোক, গদির নেশায় হোক, ধর্ম-অধর্মের জন্য হোক, যেকোনো কারনে বয়স্করা আর সামাল দিতে পারছেন না। ফের জায়গা ছাড়তেও রাজি নন তারা। তাদের একটা বিশ্বাস জন্মে গেছে তারা যা বলবেন, যা করবেন তাই গিলবে মানুষ। মানুষ যে গিলছে না সেটা বুঝতে পারলেও মানতে চায় না বলেই জোর জবরদস্তি করে আগুন জ্বালিয়ে মানুষ মেরে বোঝাতে হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিকে সবচেয়ে বেশি আত্মস্থ করেছেন এরশাদ। কথার বরখেলাপ বা ইচ্ছেমতো মিথ্যা সত্য যা খুশি বলা কোনো ব্যাপার নয়, বরং এভাবেই লাইমলাইটে থাকা সম্ভব!
আপাতত আবার হিসেব উল্টে দিলেন এরশাদ। তবে কোনটা সত্য এই মুহূর্তে অনুমাণ করা কঠিন। তিনি কি আসলেই নির্বাচনে যাবেন না, নাকি এ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে বিরোধীদলকে আরও একবার ঘোলখাইয়ে ছাড়বেন? যেটাই হোক না কেন, আমাদের দেশ ও জাতি আবারো সংকটে ত্রাণ বা দিশার পরিবর্তে হতাশার ভেতর ই ডুবলো। কারণ নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা তিনি আগেই দিতে পারতেন। তার পরিবর্তে এত টাকা পয়সা খরচ করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এই মনোনয়ন খেলার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
একটা বিষয় খেয়াল করুন। এখন আর তেমন কোনো এজেন্ডা নেই মাঠে। দুর্নীতি- দুঃশাসন সব ভুলে গেছি আমরা। হেফাজত-জামায়াত সেও নিভু নিভু। মাঠে নেই ধর্মের বিরুদ্ধে নাস্তিকতার অভিযোগের কাণ্ডারিরাও। শুধু ভোট নয়, এই এখন এজেন্ডা। প্রতিবার নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই এজাতীয় আগ্নেয় পরিস্থিত কি এটাই প্রমাণ করে না যে আমরা আসলে গণতন্ত্রের যোগ্য হয়ে উঠিনি এখনো? আমার এক বন্ধু সুদূর হবিগঞ্জ থেকে বললেন, শেখ হাসিনার জন্য মায়া হচ্ছে। তার আবার রাগও হচ্ছে। কেন তিনি এরশাদকে বিশ্বাস করতে গেলেন।
আমার কিন্তু তার জন্য নয়, বরং খালেদা জিয়ার জন্যই মায়া হচ্ছে। স্বয়ং এরশাদ যখন তার দিকে মোড় নিচ্ছে, তখন কি আর অন্য কোনো শত্রুর প্রয়োজন পড়বে?
কথায় বলে সাপের সঙ্গে বন্ধুত্ব আর মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস এক ব্যাপার। এরশাদের সঙ্গে রাজনীতি আর বন্ধুত্ব যেন তারই প্রতিচ্ছবি। এই বয়সী প্রায় শেষ পথের যাত্রীরা তাদের মন ও মর্জির মতোই আনপ্রেডিকটেবল।
এদের হাতে আগামী দিনের বাংলাদেশ বা তার দায়িত্ব নিরাপদ কিছু নয়। ডিগবাজি ওস্তাদ এরশাদ সেটাই প্রমাণ করলেন। তবে সামনে আরও কি আছে কে জানে? হয়তো এ লেখা আলোর মুখ দেখার আগেই তিনি আবার পাল্টে যাবেন। তাতে তো লাভ ছাড়া লোকসানের কিছু নেই। কবে যে এরা বিদায় নেবে? প্রকৃতিও কি এই দোদুল্যমানতার বিচার করবে না?
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ২০৫১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৩