হঠাৎ বদলে যাওয়া রাজনীতি ও মসনদে আসীন হবার প্রবণতা দেখে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না এটাই কি আমার দেখা-আমার চেনা বাংলাদেশ? গোড়াতে বলে নিই, বিগত কিছুদিন ধরে যে মারামারি, হানাহানি, কাটাকাটি, হরতাল, ককটেল, মানুষ পোড়ানো- তার অবসানে যে কোন দাওয়াই বা ব্যবস্থাকেই স্বাগত জানাই। জামায়াত ও বিএনপির বেশুমার হরতাল ও গোঁয়ার্তুমির জন্য দেশ সর্বনাশের কিনারায় যেতে পারে না।
বিএনপির কথা ও কাজে মনে হচ্ছিল তাদের রাজনীতির বা পথের কাঁটা ছিলেন কেবল শেখ হাসিনা। তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার কাজটা হলেই কেল্লা ফতে। এই বিষয়টা যখন যত বেশি খোলসা হয়ে উঠল, তখন আওয়ামী লীগও কৌশলে নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে উঠে পড়ে লাগলো। যার সর্বশেষ চিত্র নতুন মন্ত্রিসভা আর আসন্ন উপদেষ্টা মণ্ডলীর নতুন বিন্যাস।
এ পর্যন্ত যারা শপথ নিলেন তারা কি আসলেই দেশ বা জনগণের আশা- আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, না এরা একজাতীয় স্কচ টেপ? জোড়া লাগানোর কাজে ব্যবহৃত হলেন? পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ সাহস-নীতিবোধ আর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থাকা দরকার, তোফায়েল আহমেদ ছাড়া বাকীদের কি তা আছে?
রাশেদ খান মেননের ব্যাপারটাও অদ্ভূত। কিছুদিন আগে তিনি মন্ত্রী হতে অস্বীকার করার পর এই সামান্য সময়ের জন্য কেন দায়িত্ব নিলেন? জাতীয় পার্টির এরশাদ সাহেব যে কী ‘চিজ’ সে তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। বাচ্চা শিশুও বুঝতে পারবে রওশন এরশাদ যেহেতু হাসিনাবিরোধী ছিলেন এবং মহাজোটে থাকতে চাইছিলেন না তাকে মন্ত্রিত্ব ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ করার পাশাপাশি কাজী জাফরের গালে চপেটাঘাতটা অবশ্য মন্দ হয়নি। কিন্তু আমরা আসলে কী চাই? মুখ বদল না পাকাপাকি শান্তি আর কল্যাণ?
সর্বদলীয় সরকারের পাশাপাশি উপদেষ্টামণ্ডলীতে যাদের নাম দেখছি তাঁরা যদি সত্যি সে পদে আসেন তবে বহু হিসাব-নিকাশ নতুনভাবে নতুন করে করতে হবে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও মঞ্জুরুল আহসান খান ছাড়া বাকিরা সব সময়ই জঘণ্য আওয়ামীবিরোধী কথা বলে এসেছেন। বিশেষ করে কাদের সিদ্দিকী আর আ স ম আব্দুর রব। এদের কথা-বার্তা বা ভূমিকা জামায়াতের চেয়েও খারাপ।
আ স ম রব ও কাদের সিদ্দিকী উভয়েই রাজনৈতিক এতিম। দেউলিয়া মানুষ সব সময় বাজে কথা বলে বাজেভাবে রি-অ্যাক্ট করে। কারণ, তাদের হারানোর কিছু নেই। বরং যা পায় তা-ই লাভ। দেশে এদের বিরুদ্ধে শক্ত জনমত আছে। বিশেষত বিগত দু’এক বছরে কাদের সিদ্দিকীর জামায়াত প্রীতি, রবের অসংলগ্ন বক্তব্য তাদের অবস্থানকে রীতিমত নাজুক করে তুলেছে। যে শক্তিবলয় এ দেশের প্রগতি ও মুক্তির প্রহরী তারা এ দুই প্রাক্তণ মুক্তিযোদ্ধার নব্য রাজাকারিতে দারুণভাবে নাখোশ। তাছাড়া এরা সীমানা ছাড়িয়ে গেছেন। এদের টেনে এনে কি আসলে কোনো ফায়দা হবে? যদি তারা পদে আসীন হন, তবে নির্বাচনে বা ভোটের বাক্সে নেতিবাচক প্রভাব ছাড়া কিছুই পড়বে বলে মনে হয় না। আর যদি না আসেন তাহলেও এখন তারা বলে বেড়াবেন, ‘টক বলেই আঙ্গুর খাইনি’।
বিচিত্র এই দেশে ক’দিন আগেও যিনি এরশাদকে হাসিনা ত্যাগের জন্য পায়ে ধরেছেন, হাসিনাকে ডাইনি বলে গাল দিয়েছেন, তিনিই কাল কদমবুচি করে দেখিয়ে দিয়েছেন-পাওয়ার গেম কত শক্তিশালী। আমাদের মত সাধারণ মানুষের এসব হজম করা কঠিন। আমরা এখন অবধি আওয়ামী রাজনীতিকে পরিত্যাগ না করার কারণ তার অতীত ও বঙ্গবন্ধু। তাজ উদ্দীনের মত মানুষের দল বলে এখনো আমরা আস্থা রাখতে আগ্রহী। রাজনৈতিক মোকাবেলার জায়গাটা কৌশলের নামে বরবাদ করে ফেললে এরা বাঁচাতে আসবে না। এই রব এবং তার সঙ্গী ইনুরাই বঙ্গবন্ধুকে সরানোর জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছিলেন। এদের সামনে রেখে জামায়াত, মুসলিম লীগ আর স্বাধীনতাবিরোধীরা ঘর গুছিয়েছে সে সময়। আজ দুর্দিনে আসল মানুষদের হারিয়ে এদের কাছে টানার ভেতর চমক থাকলেও স্থায়িত্ব থাকবে না।
এ প্রক্রিয়া যদি বিএনপিকে নিঃস্ব বা এতিম করার জন্য হয়ে থাকে তাও খুব ফলবতী হবে বলে মনে করি না। বিএনপি এদের দ্বারা যতটা লাভবান হয় বা হয়েছে তার চেয়ে অধিক লোকসানের বোঝা কাঁধে নিতে হয়। এদের কারণে কথার তোড়ে সাধারণ মানুষ বিরক্ত হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ এই সত্যটা বুঝতে পারছে না কেন? আর যদি এ ফর্মুলা কোন অভিভাবক বা মুরুব্বীরও হয় তা রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ বলেই প্রতিভাত হবে একদিন। আমরা দূর দেশে থাকি। খবর বা হাল নাগাদ অবস্থা জানতে বিলম্ব না হলেও অনেক সময় আসল ছবিটা পাওয়া যায় না। তারপরও কেন জানি মনে হচ্ছে- এই প্রক্রিয়া সরকারি দলের জন্য সুফল বয়ে আনবে কি না তা যেন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রইল।
আগেই বলেছি, জামায়াত ও জঙ্গিবাদের দমন, সুষ্ঠু নির্বাচন ও শান্তিপূর্ণ জীবন এটাই আমাদের প্রার্থনা। সে প্রার্থনা বা মনোকামনা পূরণের জন্য বেছে বেছে দাগী দলত্যাগী বা বকোয়াজ নেতাদের মন্ত্রী করার কি আদৌ কোনো দরকার ছিল? ঘরপোড়া আওয়ামী গরু এখনো সিঁদুরে মেঘ চিনলো না?
বিদ্যাসাগরের হিতোপদেশে একটা চমৎকার উপদেশ আছে। কেউ যদি একবার কারো বিশ্বাস ভাঙে বা সততা নষ্ট করে অন্যের কাছে গিয়ে নিজেদের বদনাম বা লোকসানের পথ বাতলে দেয় তবে তাকে ভ্রষ্ট বলে মেনে চলাই উত্তম। একবার চরিত্র হারালে তার আর চরিত্র হারানোর ভয় বা লজ্জা থাকে না। নির্বাচন করে দেওয়া আর আওয়ামী দুর্গ বাঁচানোর জন্য ইমপোর্ট করা নেতাগুলোকে দেখলে কি মনে হয় যে এরা সৎ ও বিশ্বস্ত? বা এরা আবার ডিগবাজি খাবে না?
তারপরও আমরা আশা করব, বিএনপি তার হঠকারিতার রাজনীতি বাদ দিয়ে সঠিক লাইনে ফিরে আসবে। আর আওয়ামী লীগ তার প্রকৃত বন্ধু ও সজ্জনদের দিয়েই লড়াই করবে। আদর্শহীনতার জিয়া রাজনীতি, পলিটিক্সকে ডিফিকাল্ট করে আজ এই জায়গায় এনেছে। এরশাদের ভণ্ডামি সে প্রক্রিয়াকে দিয়েছে নতুন বেগ। আর এবার আওয়ামী লীগ যদি নতুন কোনো উপদ্রব তৈরি করে তবে আমাদের আর হতাশার অন্ত থাকবে না। হায়রে জনগণ, আর কত কী যে দেখতে হবে তোমাদের!
অজয় দাশগুপ্ত: কলাম লেখক, সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ০০২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১৩
এইচএ/জেডএম/জিসিপি