ঢাকা: যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত মিত্র সৌদি আরব। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এসে দু`দেশের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত এই মিত্রতার সম্পর্কে দেখা দিয়েছে টানাপোড়েন।
গত ১১ নভেম্বর টাইমের চলতি সংখ্যায় প্রকাশিত নিবন্ধটিতে উঠে এসেছে, বৈশ্বিক চরমপন্থা এবং সন্ত্রাসবাদের প্রসারে সৌদি আরবের ভূমিকা এবং নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ গ্রহণে সৌদি আরবের অস্বীকৃতির নেপথ্য কারণ।
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার উদাহরণ দিয়ে ‘দ্য সৌদিস আর আপসেট? টাফ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বিখ্যাত কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক-সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ফরিদ জাকারিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সম্পর্কের সাম্প্রতিক টানাপড়েনের শুলুকসন্ধান করেছেন।
সিরিয়া ও ইরান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের টানাপড়েনের কারণেই দেশটি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ প্রত্যাখ্যান কি না, নিবন্ধে সে বিষয়টিও তুলে ধরেছেন ফরিদ জাকারিয়া।
বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য নিবন্ধটিকে ঈষৎ সংক্ষেপিত রূপে তুলে ধরা হলো:
“যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি ব্যর্থ হচ্ছে, আমরা অবশ্য তা আগেই বলেছি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সৌদি আরবের অসন্তোষই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
সম্প্রতি সিনেটর জন ম্যাককেইন(২০০৮ সালের নির্বাচনে ওবামার প্রতিদ্বন্দ্বী), ডিক চেনি (জুনিয়র বুশের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট) এবং সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামও সৌদি আরবের জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ প্রত্যাখ্যানে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। (সম্প্রতি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ গ্রহণ প্রত্যাখ্যান করে সৌদি আরব। )
সারা বিশ্বেই ইসলামিক চরমপন্থা ও জঙ্গিবাদের উত্থান ছড়িয়ে পড়ার পেছনে সবচেয়ে দায়ী সৌদি আরব। গত চার দশক ধরে ওয়াহাবি ইমামদের প্রচারিত ইসলামের অসহিষ্ণু, উগ্র এবং সহিংস ব্যাখ্যা রফতানিতে ব্যয় হচ্ছে এই রাজতন্ত্রের বিপুল তেলসম্পদ।
তাই যদি দায়িত্বহীন পররাষ্ট্রনীতির জন্য বিশ্বে কোনো পুরস্কার থাকতো তবে সে পুরস্কার অবশ্যই সৌদি আরবই লাভ করতো।
জার্মানি থেকে ইন্দোনেশিয়া, পৃথিবীর যেখানেই যান, আপনার চোখে পড়বে সৌদি অর্থে স্ফীত ইসলামিক সেন্টার। শুধু অসহিষ্ণুতা আর ঘৃণাই নির্গমন করছে এগুলো।
২০০৭ সালে স্টুয়ার্ট লেভিও (বুশ প্রশাসনের অর্থ-মন্ত্রণালয়ের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি) একই কথা বলেছিলেন। তিন বলেন, যদি তার হাতে পৃথিবীর শুধু একটি দেশের তহবিল (সন্ত্রাসবাদে) যোগানো বন্ধ করবার সুযোগ থাকতো, তবে সেই দেশটি হতো সৌদি আরব।
কিন্তু যখনই কোনো প্রমাণ তাদের সামনে আনা হয়, তারা স্রেফ অস্বীকার করে। ‘এগুলো ব্যক্তিগত ও বেসরকারি ফাউন্ডেশনের তহবিল, যার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই’ -- বলেই দায় এড়ায় তারা। অথচ সৌদি সরকার এবং রাজপরিবারের সদস্যরাই এগুলোর মূল হর্তাকর্তা। তাছাড়া সৌদি আরবের মত নিরঙ্কুশ রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গাছের পাতাটি নড়িও এক কথায় অসম্ভব।
সৌদি আরবের ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হিলারি ক্লিনটনও। ২০১০ সালে উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া (২০০৯ সালের ডিসেম্বরে প্রেরিত) একটি তারবার্তা অনুযায়ী, সৌদি আরব যে এখনও সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে তহবিল যোগানদাতা, তা নিশ্চিত করেন সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এছাড়া ৯/১১ এর আগ পর্যন্ত সৌদি আরব ছিলো বিশ্বের তিনটি মাত্র রাষ্ট্রের একটি যারা আফগানিস্তানের তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি এবং সমর্থন জানিয়েছিলো। এখনও তালেবান বা এ ধরনের গ্রুপগুলোকে অর্থায়ন বন্ধের ব্যাপারে রিয়াদ খুব সামান্যই পদক্ষেপ নিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদীদের আস্তানা পাকিস্তানের ওপরও সৌদি আরবের প্রভাব অপরিসীম।
পাকিস্তানের সাবেক আইনমন্ত্রী ইকবাল হায়দার ২০১২ সালের আগস্ট মাসে ডয়েচে ভেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘তালেবান হোক আর লস্কর-ই-জংভিই হোক তাদের আর্দশ যে সৌদি ওয়াহাবিবাদ, কোনো দ্বিধা ছাড়াই একথা বলা যায়’। এছাড়া পাকিস্তানজুড়েই ওয়াহাবি গ্রুপগুলোকে সৌদি আরব এখনও খোলামেলাভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়টিও যোগ করেন তিনি।
এমনকি ২০০৩ সালে সৌদি আরবে আল কায়েদার হামলার পর নিজের দেশে মুসলিম চরমপন্থিদের ওপর খড়গহস্ত হলেও সৌদি কর্তৃপক্ষ কখনই ওয়াহাবি ইমাম, ওয়াহাবি মতবাদ প্রচারকেন্দ্র, মাদ্রাসা এবং বিদেশে মাটিতে থাকা জঙ্গিদের সমর্থন দেওয়া বন্ধ করেনি।
ইরাক যুদ্ধের সময়ও সুন্নি জঙ্গিরা সৌদি আরব থেকেই সবচেয়ে বেশি সহায়তা পেয়েছিলো। একই ধারা বর্তমানে অব্যাহত আছে সিরিয়াতেও।
তাই সিরিয়া ও ইরানের ক্ষেত্রে ওবামা সরকারের গৃহীত সাম্প্রতিক পদক্ষেপই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সৌদি অসন্তোষের মূল কারণ। ওই সব দেশের জনগণের প্রতি মানবিক তাড়নাপ্রসূত উদ্বেগ নয়, বরং সৌদি আরবকে পরিচালনা করছে এর রাজতন্ত্রের গভীরে প্রোথিত তীব্র শিয়া-বিরোধী মনোভাব।
ওয়াহাবিজম ছাড়া ইসলামের অন্যসব ধারা এবং বিভাজনকে অস্বীকার করার প্রবণতা সৌদি রাজতন্ত্রের অনেকদিনের পুরনো রীতি। নিজের দেশে সংখ্যালঘু এসব গ্রুপের ওপর চলা নির্যাতনকে দেখেও না দেখার ভান করে আসছে তারা।
২০০৯ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি প্রতিবেদনে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়, কিভাবে সৌদি সরকার, ধর্মীয় নেতৃত্ব, ধর্মীয় পুলিশ এবং বিদ্যালয়গুলো স্থানীয় শিয়া জনগণের ওপর ধারাবাহিকভাবে বৈষম্য চালিয়ে আসছে। গ্রেফতার ও মারধরের পাশাপাশি গুলি চালানোর মত বিষয়ও নিয়মিত ঘটনা।
শুধু শিয়ারাই নয়, আরব উপদ্বীপের সব চার্চ ধ্বংস করা প্রয়োজন, ২০১২ সালের মার্চ মাসে এমন একটি ফতোয়া জারি করেন সৌদি আরবের গ্রান্ড মুফতি।
তাই শিয়াদের কোনো ধরনের ক্ষমতায়নকেই সৌদি শাসকগোষ্ঠীর ভয়, তা পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেন। কারণ তাদের ধারণা এতে সৌদি আরবে বসবাসরত ১৫ শতাংশ শিয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও সাহস সঞ্চারিত হবে। আর এই বিশাল জনগোষ্ঠীর বসবাস মূলত সৌদি আরবের তেল সমৃদ্ধ অঞ্চলেই।
এ ভীতি থেকেই ২০১১ সালের ‘আরব স্প্রিং’ চলার সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের (শিয়া) আন্দোলন দমাতে প্রতিবেশী বাহরাইনে সেনা পাঠিয়েছিলো সৌদি আরব।
সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্য এবং এর আশপাশের এলাকায় সংঘটিত নানা ঘটনায় সৌদি শাসকগোষ্ঠী উদ্বিগ্ন। তারা বুঝতে পেরেছে, আরব জাগরণ থেকে সঞ্চারিত অসন্তোষ তাদের নিজেদের সীমানাতেও অনুপস্থিত থাকবে না। ইরানের পুনর্বাসনের (পশ্চিমাদের সঙ্গে পরমাণু ইস্যুতে ইরানের সমঝোতা) সম্ভাবনার ব্যাপারেও তারা আতঙ্কিত। পাশাপাশি খুব শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি পাবে, এটাও সৌদি শাসকগোষ্ঠীর অজানা নয়।
এসব দিক বিবেচনা করেই হয়তো নিরাপত্তা পরিষদের আসনে বসা থেকে বিরত রয়েছে সৌদি আরব। কারণ তাদের আশঙ্কা নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সংঘটনের পথে বাধার সৃষ্টি করবে।
পাশাপাশি তাদের নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপরও আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে এই পদ। হয়তো এই পদ রিয়াদকে এমন কিছু ইস্যুতে ভোট দিতে বাধ্য করতে পারে, যা তারা নিজেরাই বহুদিন ধরে অস্বীকার করে আসছে।
তবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আসন প্রত্যাখ্যানের কারণ যাই হোক না কেন, এটা স্বীকার করে নেওয়াই ভালো যে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ক্ষুব্ধ। আর তাদের এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে।
অনুবাদ: রাইসুল ইসলাম
বাংলাদেশ সময়: ১১০৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১৩
আরআই/জিসিপি/জেএম