ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সংকট নিরসনে দু’নেত্রীকেই ছাড় দেয়া প্রয়োজন

সাজেদুল চৌধুরী রুবেল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১৩
সংকট নিরসনে দু’নেত্রীকেই ছাড় দেয়া প্রয়োজন

অবশেষে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটকে বাদ দিয়েই নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন করা হল। এ সরকারের মন্ত্রিসভায় নতুন সদস্য হিসেবে যারা অন্তর্ভুক্ত হলেন তাঁদের মধ্যে দুজন আওয়ামী লীগের, পাঁচজন জাতীয় পার্টির ও একজন ওয়ার্ক‍ার্স পার্টির বলে খবরে প্রকাশিত হয়েছে।



প্রশ্ন হল, বিএনপির মতো প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচনকালীন যে সরকার গঠন করা হয়েছে তাকে ‘সর্বদলীয় সরকার’ হিসেবে অভিহিত করা কি আদৌ সমীচীন হবে? বরং একে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিগত জোট সরকারের নতুন সংস্করণ বলাই অধিক শ্রেয়। আমরা যারা দলকানা তারা এ ধরনের একটি ‘অর্ধদলীয়’ সরকারকে জোর করে সর্বদলীয় বলে চালিয়ে নিতে চাইলেও দেশে বিদেশে কি তা গ্রহণযোগ্য হবে? যদি তাই না হয়, তাহলে এ সরকারের অধীনে যে নির্বাচনটি হবে তাও তাঁদের কাছে সম্মানজনক ভাবে গৃহীত হবেনা। সুতরাং সুষ্ঠু, সুন্দর, গ্রহণযোগ্য ও সর্বপরি একটি সম্মানজনক নির্বাচনের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।

আমরা জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৭ অক্টোবর  বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে হরতাল প্রত্যহার করে সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে টেলিফোন করেছিলেন। কিন্তু বিরোধী নেতা সেদিন সাড়া দেননি।   হরতাল বহাল রেখেছিলেন। হরতালের পর আলোচনায় বসতে রাজি আছেন বললেও পরবর্তীতে তাঁর কিংবা প্রধানমন্ত্রী কারো পক্ষ থেকেই এ ব্যাপারে কোন সঠিক উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে দেশে নেমে আসে রাজনৈতিক সহিংসতা। হরতালের নামে বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীরা নেমে যায় আদিম বন্যতায়। লিপ্ত হয় সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডে। রাস্তাঘাটে মানুষকে কেবল গুলি বা বোমা মেরেই নয়, পুড়েও মেরেছে অনেককে। বস্তুত এসব হরতাল জাতীয় ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি জনজীবনকে ঠেলে দেয় এক ভয়ানক বিপর্যয়ের মুখে।

প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে খালেদা জিয়া যদি সেদিন সংলাপে বসতেন তাহলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি হয়তোবা এতোটা ঘোলাটে হতোনা। গ্রহণযোগ্য বা শান্তিপূর্ণ সমাধান বেরিয়ে আসতো আলোচনার টেবিল থেকে। কিন্তু বিএনপি নেত্রী সে পথে না হেঁটে ভুল পথে পদচারিত হলেন। তাঁর সে ভুলের মাশুল দিতে হল নিরীহ ও নিরাপরাধ জনগণকে। পুরো দেশ রাজনৈতিক উত্তাপে পুড়ে ছাই হল।              

এরপরও বিরোধী দলীয় নেতা অনুতপ্ত না হয়ে আপোসহীনতার কথা বলেন। গত ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি “আর আপোস নয়” বলে ঘোষণা দেন। অর্থাৎ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে তিনি সরকারের সঙ্গে কোন আপোসে যাবেন না। দেশকে আবারো নির্মম নিয়তির দিকে ঠেলে দেয়ার আশঙ্কাই ফুটে উঠে তাঁর এ আপোসহীন বক্তব্যে। ফলে জনমনে আবারো সৃষ্টি হয় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। বিরোধীদলীয় নেতাকে বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, ‘আপোসহীনতা’ গণতন্ত্রের ভাষা নয়। শব্দটি এক ধরনের উগ্রতা বহন করে। পক্ষান্তরে ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, সন্ধি বা আপোসের মাধ্যমে অনেক বড় বড় রাজনৈতিক সমস্যারও নিস্পত্তি ঘটেছে।

তবে আশার কথা, প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াতে গণভবনে না গেলেও মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ২০ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বঙ্গভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।   নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু নিয়ে যে রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনে তাঁরা রাষ্ট্রপতির সহযোগিতা ও হস্তক্ষেপ কামনা করেন। রাষ্ট্রপতি তাঁদের বিভন্ন দাবি-দাওয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরবেন ও তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতা অনুযায়ী যতোটুকু সম্ভব ততোটুকু করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।

খালেদা জিয়ার ইতিবাচক এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে এও আশা করবো, জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবেন। নির্দলীয় সরকারের দাবি থেকে সরে এসে সর্বদলীয় সরকারের রূপরেখা মেনে নিয়ে তিনি যদি তাঁর জোটকে এতে অন্তর্ভুক্ত করেন  এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের সাহসী প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তবে তা বাংলাদেশে উদার রাজনীতির ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

সমঝোতার প্রশ্নে উভয় পক্ষকেই ছাড় দিতে হয়। বিরোধীদলীয় নেতা ছাড় দিয়ে যদি তাঁর দাবি থেকে সরে আসেন সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকেও তাঁর অবস্থানের কথা বিবেচনায় এনে দেশ ও জাতির স্বার্থে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ছাড় দিতে হবে। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেবেন। কিছুদিন আগে এক সমাবেশে তিনি নিজেই এ কথা বলেছিলেন। এবং আমরা বিশ্বাস করি বঙ্গবন্ধুতনয়া ও গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনার পক্ষে যে কোন ধরনের ছাড় দেয়া সম্ভব।

সত্যিকার অর্থে ছাড় দেয়ার মনমানসিকতা নিয়ে যদি দু’নেত্রী এক টেবিলে বসেন তবে সমস্যা সমাধান সময়ের ব্যাপার মাত্র। একজন সর্বদলীয় সরকারে এসে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন, অন্যজন তাঁর বর্তমান দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে সৎ , নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য কোন ব্যক্তির হাতে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার প্রধানের দায়িত্ব তুলে দেবেন। দায়িত্ব প্রদানের আগেই দু’নেত্রী আলোচনা সাপেক্ষে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে নির্বাচিত করতে পারেন। যদি আলোচনার মাধ্যমে সর্বদলীয় সরকার প্রদানের জন্য কাউকে সেভাবে নির্বাচিত করা না যায়, বাংলাদেশের মানুষ যেহেতু ভাগ্যনির্ভর সে ক্ষেত্রে তাঁরা লটারির আশ্রয় নিতে পারেন। উভয় নেত্রী দু’টো নাম কাগজে লিখে দেবেন। দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতিতে এ লটারি নির্বাচন সম্পন্ন হবে যাতে করে দেশের মানুষ সরাসরি দেখতে পায়। লটারির মাধ্যমে যিনি নির্বাচিত হবেন তিনি-ই হবেন সবার গ্রহণযোগ্য সর্বদলীয় সরকার প্রদান। যার অধীনে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য ও উৎসব মুখর নির্বাচন সম্পন্ন হওয়া সম্ভব।

এ জন্য প্রয়োজন দু’নেত্রীর সদিচ্ছা ও ছাড় দেয়ার সত্যিকার মনমানসিকতা।       

সাজেদুল চৌধুরী রুবেল: আয়ারল্যান্ড প্রবাসী, Shajed70@yahoo.com

বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১৩
জেডএম/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।