মিথ্যার মোড়কে সত্যকে খুব অল্প সময়ই ঢেকে রাখা যায়। সত্য তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের দরুণই মিথ্যার স্বর্গরাজ্যকে ভেঙে চূর্ণ করে স্বীয় অস্থিত্বের জানান দেয়।
বইটিতে অসংখ্য মিথ্যাচারের দ্বারা নেয়ামত ইমাম বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবকে অভিযুক্ত করেছেন একজন ব্যর্থ শাসক, একজন স্বৈরাচারী ও অযোগ্য রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। মুজিবকে নিয়ে এ ধরনের প্রোপাগান্ডা অতীতেও হয়েছে, নেয়ামত ইমামের পূর্বেও বহু পশ্চিমা লেখক অসংখ্য মিথ্যাচারকে মলাটবন্দী করে মুজিবের শাসনকালের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন, তবে তাদের লেখনীতে তারা একটি স্বাধীন জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে মুজিবের অর্জনের তুলনায় তার সাময়িক প্রশাসনিক দক্ষতার বিষয়টিকে খাটো করেই দেখেছিলেন। কিন্তু নেয়ামত ইমাম পূর্বতন লেখকদের সীমানার গন্ডি ছাড়িয়ে এতটাই দূরে পৌঁছে গেছেন, যতটা পশ্চিমা স্বার্থের রক্ষক কোনো লেখকও কখনো করেন নি। আসুন দেখে আসা যাক, এ ধরনের দাবির পশ্চাতে নেয়ামত ইমামের যুক্তিগুলো কী এবং সেগুলো কতটা গ্রহণযোগ্য?
উক্ত গ্রন্থে নেয়ামত ইমামের প্রধান ভাষ্য হচ্ছে, ‘বাংলার মাটিতে মুজিবের শাসন ছিল দুরাচারী শাসন, তার সময়েই শুরু হয়েছিল বাঙালির সহিংসতার রাজনীতি, তিনি আমাদের স্বাধীন দেশটাকে ভেজালে ভরে দিয়েছিলেন, তারপর না আমরা আর বিশুদ্ধ হতে পেরেছি, না আমাদের বিবেক কাজ করেছে!’ ইমাম খুবই চমৎকার কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন! যেমন, স্বাধীন দেশ, বাঙালি জাতি, আমাদের বিবেক, সহিংসতা ইত্যাদি। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে শব্দগুলোর অবতারণা ইমাম করেছেন, মুজিবের অনুপস্থিতিতে এগুলো কি সম্ভব ছিল?
পাকিস্থান শাসনের সুদীর্ঘ ২৩ বছরে বাঙালির স্বাধীনতা নিয়ে সবচেয়ে বেশি কে ভেবেছিলেন? কে পাকিস্থানের গণপরিষদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলা শব্দটির একটি ঐতিহ্য আছে, এর একটি নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতি আছে, তোমরা পূর্ব বাংলার নাম পূর্ব পাকিস্থান রেখো না!’ আর মুজিবের সময় যদি কিছু সহিংসতার ঘটনা ঘটে থাকেও তবে সেই সহিংসতার জন্য মুজিবই দায়ী ছিলেন, তাই বা কী করে বলা যায়? যেখানে বাঙালির ইতিহাস বলে, যেসমস্ত প্রো-পাকিরা ৭১ এ মুজিবের লোকদের নির্বচারে হত্যা করেছিল, নিজেদের পাকিস্থানি শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে, তারাই তো পরবর্তীকালে পশ্চিমা বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের সহায়তায় মুজিবের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাঙালিত্ব গ্রহণ করে এদেশে সহিংসতার বীজ বপন করেছিল এবং এখন পর্যন্ত তাদের এই কর্মকাণ্ড জারি রয়েছে। মুজিব বাধ্য হয়েছিলেন বহিঃশত্রুর হস্তক্ষেপ মেনে নিতে, সাময়িক ক্ষমা দিয়েছিলেন জাতীয় শত্রুদের।
নেয়ামত ইমাম তার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে লিখেছেন ‘দি ব্ল্যাক কোট’ গ্রন্থে আমি আরেকটি বিষয়ের উল্লেখ করতে চেয়েছিলাম যে, ‘শেখ হাসিনার সরকার একটি বিশাল সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের নতুন নামকরণ করেছে শেখ মুজিবের নামে। জোর করে শেখ মুজিবকে অমরত্ব প্রদানের এই প্রক্রিয়াটি আমার কাছে অসম্ভবরকম সস্তা ও অপমানকর মনে হয়েছে। ’ নেয়ামত ইমাম তার রচনায় পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের ফসল গণতন্ত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সে সমাজের দিকে তাকালেও কিন্তু দেখা যায় আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার পর জর্জ ওয়াশিংটনের নামে আমেরিকার রাজধানীর নামকরণ করা হয়েছিল, তাহলে নেয়ামত ইমাম কি কখনো ভেবে দেখেছেন, ৭১ এর পর বাংলাদেশের রাজধানীর নাম কি হওয়া উচিৎ ছিল? আফসোস, শেখ মুজিব বাংলার রাজধানীর নাম মুজিবনগর করেননি!
নেয়ামত ইমামের ‘দি ব্ল্যাক কোট’ গ্রন্থের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো ১৯৭৪ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগ; যা বর্ণনা করতে গিয়ে ইমাম বলেছেন এ দুর্যোগে বাংলাদেশের ১৫ লাখ লোক মারা গেছেন। যদিও সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো হিসেবেই অদ্যবধি আমরা পরিসংখ্যানে এই সংখ্যা ৩ লাখের অধিক পাইনি। ইমাম অবশ্য এই তথ্যটি সংগ্রহ করেছেন ডেভিড লুইসের গ্রন্থ থেকে, তথ্যটি তার নিজ-গবেষণালব্ধ নয়, এবং তথ্যটিও কোনো মৌলিক তথ্য নয়। তবুও এর উপর ভিত্তি করেই ইমাম দাবি করেছেন, ‘১৯৭০ সালের একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যথেষ্টভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়ায় যদি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দুঃশাসক বলে বিবেচনা করা হয়, আমি যুক্তি দেখাই, তাহলে ১৯৭৪ সালের আরেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে তার চেয়েও আরো ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হওয়ায় কেন শেখ মুজিবকে দুঃশাসক হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না?’ খুবই সুন্দর যুক্তি, যদিও মৃতের সংখ্যা এবং দুর্যোগের কারণ দুটোই প্রোপাগান্ডা! কারণ এখন আমরা জানি, ১৯৭৪ এর দুর্যোগে বাঙালিরা যে দুরাবস্থার শিকার হয়েছিলেন তার জন্য মার্কিন খাদ্য-সরবরাহকারী জাহাজের ইচ্ছাকৃত বিলম্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
আর যদি নেয়ামত ইমামের ১৫ লাখ মানুষ মারা যাওয়ার অদ্ভূত ব্যাখ্যাও আমরা গ্রহণ করি, তবুও বলতে হবে, যদি ৭৪ এ মুজিবের দোষে বাংলার ১৫ লাখ লোক প্রাণ দিয়ে থাকে, তবে ২৫ শে মার্চের কালো রাতে মুজিব যে ১ কোটি বাঙালিকে রক্ষা করেছিলেন, তার তুলনায় এই ১৫ লাখ (প্রকৃত সংখ্যা সর্বোচ্চ ৩ লাখ) লোকের মৃত্যুকে খুব বড় করে দেখার কিছু নেই। আমরা যাই বলি না কেন মুজিব তো আর ঈশ্বর নন যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থামিয়ে দেবেন, আর তার কাছে অর্থ না থাকলে তিনি দুর্যোগ পীড়িতদের কিভাবে রক্ষা করবেন? আজকের উন্নয়নশীল বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আমরা অনেক কিছু ভাবতে পারি, কিন্তু সে সময়ে মুজিবের বাংলার কি এত সামর্থ ছিল? তিনি মারা যাওয়ার পর তার ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টে মাত্র ১২ হাজার টাকা পাওয়া গিয়েছিল। যেহেতু তিনি ঈশ্বর নন, তাই তিনি ৭৪ এ তার জাতিকে বাঁচাতে পারেননি, কিন্তু ৭১ এ তো মনুষ্য সামর্থের সবটুকু দিয়ে জাতিকে বাঁচিয়েছিলেন। ২০০০ সালের ২৮ শে মার্চ ‘নিউজ ফ্রম বাংলাদেশ’ এ এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল, ‘১৯৭৬ সালে সাংবাদিক মুসা সাদিকের সাথে এক সাক্ষাৎকারে টিক্কা খান বলেছিলেন, ‘যদিও কিছু নেতা পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়েছিল, তবে ২৫ শে মার্চের রাতে মুজিব যদি পালিয়ে যেত, তবে আমি সে রাতে এক কোটি বাঙালিকে হত্যা করতাম!’ একটি মুক্তিকামী জাতির মঙ্গলের জন্য আর কিই বা করবেন মুজিব, গ্রেপ্তার হওয়ার সংবাদ জেনেও জাতিকে বিপদে ফেলে পালিয়ে যান নি! হাতে অপ্রাসঙ্গিক যুক্তির বস্তা থাকলেও নেয়ামত ইমাম কি মুজিবের এই ত্যাগকে কি অস্বীকার করতে পারবেন?
নেয়ামত ইমাম তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘একজন ব্যক্তি হিসেবে তিনি একটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেবেন কি না, সেটি সম্পূর্ণ তার ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু একজন শাসক হিসেবে স্বাধীন জাতিটিকে স্বৈরাচারের মতো শাসন করবেন কি না, সেটি মোটেই তার ইচ্ছার ব্যাপার ছিল না, সেটি ছিল সে জাতির জনগোষ্ঠীর ইচ্ছা বা অভিমতের বিষয়। এক্ষেত্রে শেখ মুজিবকে আমি অন্য যে কোনো একজন নাগরিক থেকে আলাদা করে দেখি না। ’ নেয়ামত ইমামের কাছে আমার প্রশ্ন আমেরিকানরা জর্জ ওয়াশিংটনকে, আফ্রিকানরা ম্যান্ডেলাকে, ভারতীয়রা গান্ধীকে, পাকিস্তানিরা জিন্নাহকে তাদের সমাজের আর দশটা সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা করেই দেখে, তবে কেন আপনি শেখ মুজিবকে আমাদের সমাজের আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো করে দেখতে চান? আর শেখ মুজিব নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছার মূল্য দিতে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এ ব্যাখ্যাই বা আপনি কোথায় পেয়েছেন? ৬০ এর দশকের পর থেকেই (পাকিস্তান শাসনের এলিটরা বাদে) নির্যাতিত এবং নিষ্পেষিত বাঙালির দাবি ছিল একটাই, বাংলার সাধীনতা।
স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেল মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, আর সেই আন্দোলনকে বেগবান করেছিলেন মুজিব, জাতীয় স্বার্থে, এবং জাতির আবেদনের প্রেক্ষিতে। তাছাড়া মুজিব দেশটাকে স্বৈরাচারের মতো শাসন করেছিলেন এই ব্যাখ্যা আপনি কোথায় পেয়েছেন? বাংলার স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর যেখানে সমগ্র বাঙালি জাতি (রাজাকারগুলো বাদে) শেখ মুজিবকে চূড়ান্ত সম্মানের আসনে বসিয়েছিল, তখনও তো মুজিব ১৯৭৩ এ সাধারণ নির্বাচন দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন। আর আপনি যদি বাকশালের কথা বলেন, এ ধরণের সরকার সে সময়ে পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রেই ছিল, মুজিবের সমসাময়িক নেতা মাহাতির মুহাম্মদ ২২ বছর মালোয়েশিয়াকে শাসন করে পশ্চাৎপদ একটি রাষ্ট্র থেকে সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। আর মুজিব যখন বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাতে শ্রদ্ধেয় বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা মাওলানা ভাসানীরও মত ছিল, এমনকি পরবর্তীকালের বাঙালির কর্ণধার মেজর জিয়াও এই বাকশালের একজন কার্যকরী সদস্য ছিলেন। খুব সম্ভবত নেয়ামত ইমামের এই ব্যাখ্যার কারণ এই যে, মুজিব বাংলার রাজনীতিতে রাজাকারদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেননি যারা ৭১ এ বাঙালির জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।
নেয়ামত ইমাম আরো বলেছেন, ‘বাংলাদেশের যেসব বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান দেশটির গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের প্রতি শদ্ধাশীল, তারা তাদের দপ্তরে শেখ মুজিবের ছবি প্রদর্শন থেকে যেন বিরত থাকেন, কারণ শেখ মুজিব গণতন্ত্রের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা পোষণ করেছিলেন। ’ প্রশ্ন একটাই জিন্নাহ উত্তর পাকিস্থানে যে জাতি দীর্ঘকাল গণতন্ত্রের লেশমাত্র দেখেনি সে জাতি মুজিবের শাসনে এতটা গণতান্ত্রিক কিভাবে হয়ে উঠেছিল? ৭২ এর সংবিধানের মাধ্যমে এই দেশবাসীকে গনতন্ত্রের দর্শন তো মুজিবই দিয়েছিলেন। আর ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের উপর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদতো ৭২ এর সংবিধানেই উল্লেখ ছিল, এবং বাঙালি জাতিতো সেই সংবিধান আনন্দের সাথেই গ্রহণ করেছিল। খুব সম্ভবত বাঙালি জাতি সেই সময়ে নেয়ামত ইমামের মতো এতটা পশ্চিমায়ন দ্বারা দূষিত হতে পারেনি।
নিয়ামত ইমাম আরো দাবি করেছেন, ‘যেসব পূর্বপাকিস্তানি নাগরিক ১৯৭১ সালে পৃথক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও স্বাধীনতার ব্যাপারটি সমর্থন করেনি বা তার বিরোধিতা করেছে তারা যুদ্ধাপরাধী নয়। ’ প্রশ্ন একটাই যদি যুদ্ধাপরাধী নাই হবেন তবে তারা কি? খুব সম্ভবত নেয়ামত ইমাম পাকিস্থানি অভিধানে পড়েছেন রাজাকার মানে দেশপ্রেমিক! এই রাজাকারদের কৃত-কর্মের বৈধতা দেয়ার জন্য নেয়ামত ইমাম যুক্তি দেখিয়েছেন, ‘ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করলেও সঙ্গত কারণেই তিনি চান না স্কটল্যান্ড ব্রিটেন থেকে আলাদা হয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক। ব্রিটেনের চারজাতির ঐক্য রাষ্ট্রটির ভবিষ্যতের উন্নয়ন ও প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য বলে তিনি মনে করেন। তবে তাকে কি অপরাধী বলা যাবে?’ এ ধরনের ব্যাখ্যা দেয়ার পূর্বে নেয়ামত ইমামের ভেবে দেখা উচিৎ ছিল, স্কটল্যান্ড প্রায় ৫০০ বছর যাবত ব্রিটেনের অধীনে আছে, কিন্তু ভারত ভাগের পূর্বে বাঙালির হাজার বছরের সাফল্য মন্ডিত ইতিহাসের কোন অংশে কি এমন বর্ণিত আছে যে বাংলা পাকিস্তানের অধীনে ছিল?
তিনি এখানেই থামেন নি, আরো দাবি করেছেন, ‘একাত্তরে বাংলাদেশ ছিল একটি আইডিয়া, যেমন ৪৭-এ পাকিস্তান ছিল একটি আইডিয়া। যারা বাংলাদেশ নামক আইডিয়াটির বিরোধিতা করেছে বাংলাদেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা কোন অংশে কম ছিল না। তারা শুধু পশ্চিম পাকিস্তানকে ভালোবাসেনি, ভালোবেসেছে পাকিস্তান নামক দেশটিকে। তারা ভেবেছে পূর্ব পাকিস্তান হারিয়ে বৃহত্তর ভারতের তুলনায় পাকিস্তান ভৌগোলিকভাবে একটি দুর্বলতর প্রতিবেশী-রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। ’ আফসোস আজ পর্যন্ত কোনো গ্রন্থে, এমনকি দৈব বাণীতেও এরকম কথাটি শোনা যায়নি যে, রাজাকাররা বাংলাদেশকে ভালোবেসেছে, এবং বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হলে বাংলাদেশ ভারতের বিপরীতে একটি দুর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। নেয়ামত ইমাম সত্যিই একজন ঔপন্যাসিক, কারণ ইতিহাসে এ ধরনের ব্যাখ্যা আমরা কোনদিন পাইনি, তবে উপন্যাসে এ ধরনের ব্যাখ্যা ঠিক আছে, কিন্তু সেখানেও লিখে দেয়া উচিৎ ছিল, এই উপন্যাসের সকল স্থান, কাল, পাত্র ও ঘটনা কাল্পনিক, যার সাথে বাস্তব জীবনের কোনো যোগসূত্র নেই!
নেয়ামত ইমাম শুধু যে মুজিবের শাসনের সমালোচনা করে ক্ষান্ত হয়েছেন এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই, এমনকি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনাও তিনি করেছেন এভাবে, ‘বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বিভিন্ন ইসলাম বিদ্বেষী বিষয়ের ভিত্তিতে অবশংবদ ইসলামী দল বা গোষ্ঠীকে ব্যাপকভাবে সাজা দেয়ার পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা মোটেও গনতান্ত্রিক সরকারের কাজ নয়। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেয়ার আইনটি বাতিল করা হলে একটি দেশ খানিকটা সভ্যতার দিকে এগিয়ে যায় বলে মনে করা হয়। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি করে শাহবাগের প্রজন্ম কি বাংলাদেশকে একটি অসভ্য দেশে পরিণত করতে চায়?’ নেয়ামত ইমামের এই বক্তব্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং মাহাত্মপূর্ণ একটি বক্তব্য, যেটির দিকে তাকালে আমরা খুব সহজেই তার রাজনৈতিক মতাদর্শ ও অভিলাষ সম্বন্ধে বিষদজ্ঞান লাভ করতে পারবো। প্রকৃতই তিনি একজন বিবেকবান, দেশপ্রেমিক নাগরিক, যেমনভাবে রাজাকাররা ৭১-এ বাংলাদেশকে ভালোবসেছিলেন, তিনিও ঠিক তেমনভাবেই আজকের বাংলাকে ভালোবাসেন। প্রিয় পাঠকেরা আশা করি আপনারা বুঝতে পেরেছেন, ‘দি ব্ল্যাক কোট’ কী বস্তু?
আরিফ ইকবাল হোসেন: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময় : ১৬৩৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২১০৩