‘এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের একটি পরিপূর্ণ জীবন উপহার দিয়েছে। এই অপূর্ব অভিজ্ঞতা নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করতে যাচ্ছি, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা- এই বিশ্ববিদ্যালয়টি যখন এই দেশ ও পৃথিবীর একটি সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে তখন আমরা গর্ব করে বলতে পারবো একসময় এখানে আমাদের শ্রম দিয়েছিলাম’।
এই কথাগুলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হকের। শাবিপ্রবি থেকে মঙ্গলবার পদত্যাগ করেছেন তারা। নিজেদের পদত্যাগপত্রে এ কথাগুলো উল্লেখ করেছেন তারা।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম থেকেই নিজেদের কিছুটা স্বকীয় বৈশিষ্টের কারণে শিক্ষার্থীদের প্রিয় একটি বিদ্যাপীঠ হিসেবেই পরিচিত। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি মাঝে মাঝেই তাদের বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডের জন্য প্রশংসিত হয়েছে, হচ্ছে।
দেশের প্রথম বাংলা সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা, মুঠো ফনে ভর্তি কার্যক্রম সবকিছুই শুরু হয়েছিল জাফর স্যারের হাত ধরে শাবিপ্রবি থেকে । প্রতিষ্ঠার ত্রিশ বছর না পেরোতেই বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে অন্যান্য অনেকের যেমন অবদান রয়েছে ঠিক তেমনি রয়েছে জাফর স্যারের অক্লান্ত পরিশ্রম।
অতি সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কথা মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়টি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়ার উদ্যোগ নেয়। যার মূল কারণ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের যাতে একেক বার একেক জায়গায় গিয়ে কষ্ট করে পরীক্ষা দিতে না হয়।
এছাড়া রয়েছে একই দিনে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সমস্যা। আর এই সব সমস্যা সমাধানের জন্যই এ বিশ্ববিদ্যালয়টি সমন্বিত পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকেও এতে অংশগ্রহণ করতে আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু শাবিপ্রবি-যবিপ্রবি ছাড়া কেউ এ উদ্যোগকে স্বাগত জানায় নি । ভর্তি পরীক্ষার্থীরা এ পদ্ধতিকে স্বাগত জানিয়েছে বলেই মনে হয়। কারণ এতে তাদের ভোগান্তি অনেকাংশে কমে যাবে। আমার ধারণা, আমার মতো অনেকেই হয়তো অপেক্ষায় ছিলেন এ সমন্বিত পদ্ধতি যদি প্রাথমিকভাবে সফল হয় তাহলে হয়তো দেশের বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এ পদ্ধতি অনুসরণ করবে আর শিক্ষার্থীরা বেঁচে যাবে দীর্ঘদিনের ভোগান্তির হাত থেকে।
তবে মঙ্গলবার একটা সংবাদ দেখলাম যেটিতে বলা হচ্ছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় যদি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এক সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে থাকে তাহলে সিলেটের শিক্ষার্থীরা ভর্তির ক্ষেত্রে বঞ্চিত হতে পারে। আমি ঠিক জানি না এর পেছেনে যুক্তি কি। তবে সবচাইতে অবাক হয়েছি যখন শুনলাম কেউ কেউ নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন, সিলেটিদের জন্য ৫০ ভাগ কোটা রাখা হোক। সব শেষে আমরা দেখতে পেলাম বিশ্ববিদ্যালয়টির ভর্তি পরীক্ষা ৩০ নভেম্বর হওয়ার থাকলেও স্থগিত করা হয়েছে। এরপরেই ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য দুঃখজনক ঘটনাটি। পরীক্ষা স্থগিত করার সিদ্ধান্তের কয়েক ঘণ্টা পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম থেকে পদত্যাগ করেলেন আমাদের সকলের প্রিয় অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্যার। সঙ্গে পদত্যাগ করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও তার স্ত্রী ইয়ামীন হক।
বিশ্বায়নের এ যুগে যখন পৃথিবীর তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে সেখানে আমাদের কিনা শুনতে হলো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের সুযোগ বেশি দিতে হবে বা আঞ্চলিক কোটার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
পৃথিবীর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের আঞ্চলিক কোটা রয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে আমি যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে সুইডেনে রয়েছি, তাই এ খানে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এখানে দেখেছি গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে আবেদন করতে হয়। অর্থাৎ একটি প্লাটফর্ম থেকে আপনি আবেদন করবেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। এছাড়া শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে কখনোই কোনো কোটা থাকে না। তবে স্কলারশিপ বিবেচনার সময় অনেক ক্ষেত্রে কিছু কোটা থাকে যেখানে সুবিধা বঞ্চিত কিংবা দরিদ্র দেশের কিছু শিক্ষার্থী এই সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে সেটিও এতোটা সল্প মাত্রায় যে খুব একটা গা করার মতো না।
সুইডেনের প্রায় বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় স্বীকৃত সব আন্তর্জাতিক ৠাঙ্কিংয়ে প্রথম ১০০ থেকে ২০০ মধ্যে। আবার কিছু রয়েছে তলানিতে রয়েছে। এখানে এমন বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যার ৠাঙ্ক হয়তো পৃথিবীর প্রথম ৮০ টা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে, আবার এমন বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যার অবস্থান হয়তো ১৮০। কিন্তু তারা তো একসাথেই পরীক্ষা নিয়ে থাকে। তারা যদি গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে পারে তাহলে আমাদের সমস্যা কোথায়?
এছাড়া পুরো স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কোথাও ‘কোটা’ সিস্টেম আছে বলে অন্তত আমার জানা নেই। এখানকার দেশগুলো যেমন নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক ও আইসল্যান্ডে শিক্ষার্থী ভর্তি করার ক্ষেত্রে কোনো রকম ‘কোটা’ ব্যবস্থা নেই। তবে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক কিছু মাস্টার্স বা পিএচডি প্রোগ্রাম রয়েছে যেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে তবে সেটি কোনোভাবেই এদের নিজস্ব যে ব্যাচেলর বা মাস্টার্স প্রোগ্রাম রয়েছে তার সাথে তুলনীয় নয়। সেখানে কোনো রকম আলাদা যোগ্যতা দেখা হয় না। একমাত্র বিষয় হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পূর্ববর্তী একাডেমিক যোগ্যতা।
সমন্বিত পরীক্ষা পদ্ধতি যদি কার্যকর হয় তাহলে সিলেট অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা ঠিক কিভাবে বঞ্চিত হবে তা আমার মাথায় আসছে না।
আমারা অনেক সময় অনেক কিছুতে কোটা দেখতে পাই। কোটা সিস্টেম আমাদের দেশে চালু আছে। আমি নিজে একদম কোটা সিস্টেমের বিপক্ষে না। তবে সেটি হতে হবে সহনীয় মাত্রায় এবং অবশ্যই যারা শুধুমাত্র সুবিধা বঞ্চিত তাঁরাই কোটা সিস্টেমের সুবিধা পেতে পারে। আর সেটিও এমন হওয়া যাবে না যেখানে অন্যরা মনে করে তারা বঞ্চিত অর্থাৎ সহনীয় মাত্রায়।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয়টি সিলেটে অবস্থিত হওয়ায় যদি সিলেটিদের জন্য একটা নির্দিষ্ট কোটার কথা বলা হয় তাহলে তো প্রশ্ন জাগে তারা কি সুবিধা বঞ্চিত? সিলেটে তো বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বাংলাদেশে এমন অনেক জেলা রয়েছে যেখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই তাহলে তারা তো আরও অনেক সুবিধা বঞ্চিত। আসলে এটি কোনো দাবি হতে পারে না।
এখন যদি এমন হয় সব জেলায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আঞ্চলিকতার জোরে নিজেদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে তখন তো এটি একটি ব্যাপক সমস্যা হিসেবেই দেখা দিবে। এছাড়া অন্যান্য জেলার শিক্ষার্থীরা তখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।
জাফর স্যার শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের কথা ভেবেই একটি নতুন সিস্টেম চালু করতে চেয়েছিলেন। যেমনটি এখন মুঠোফোনে সবাই ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করে। এক সময় এটিও নতুন একটি সিস্টেম ছিলো আমাদের দেশের জন্য কিন্তু এখন প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় এটি ব্যবহার করছে। এ নতুন ধারা জাফর ইকবাল স্যারের হাত ধরেই এসছে। হয়তো এবার সমন্বিত ভর্তি কার্যক্রম নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে কিন্তু ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই এরকম আরও অনেক নতুন নতুন সিস্টেম প্রয়োজন। এর জন্য জাফর স্যারের বিকল্প আমরা কোথায় পাবো?
যদিও একান্ত ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে জাফর ইকবাল স্যার পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু আপনার বর্তমান ও সাবেক ছাত্র-ছাত্রী, শুভাকাঙ্ক্ষী সবাই যে চায় আপনি ফিরে আসুন। আপনাকে যে আমাদের বড় প্রয়োজন। তা না হলে কে আমাদের বাংলা সার্চ ইঞ্জিন উপহার দেবে, কে দিবে মুঠোফোন পদ্ধতিতে ভর্তি পদ্ধতির উপায় বাতলে? ফিরে আসুন স্যার।
লেখক: আমিনুল ইসলাম , শিক্ষক: সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: tutul_ruk@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ২১১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৩