সম্প্রতি হরতাল, অবরোধ, ভাংচুর, ককটেল, সর্বোপরি নিরীহ জনগণের মৃত্যুসহ যাবতীয় রাজনৈতিক ডামাডোল দিয়েও যখন সরকার-বিরোধীদলসহ কাউকেই ক্ষমতার লড়াই থেকে একচুল নড়ানো যাচ্ছিল না, তখন যে ঘটনাটি দেশের আপামর জনগণকে নাড়িয়ে দিল তা হচ্ছে, জনপ্রিয় লেখক ও শিক্ষক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী-সহকর্মী আরেক জনপ্রিয় শিক্ষক ড. ইয়াসমীন হকের পদত্যাগ।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও অন্যায়কারীর অন্যায় আব্দারের কাছে মাথা নত না করে সসম্মানে সরে যাবার উদ্দেশ্যে তাঁরা দুজন পদত্যাগ করেছিলেন।
ড. জাফর ইকবাল “সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি” বাতিল করার অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পদত্যাগ করেছিলেন। বেশ কিছুদিন আগে তাঁর একটি কলামে এই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিটি সম্পর্কে জেনেছিলাম। মূলতঃ তাঁদের চিন্তাপ্রসূত ভর্তি পরীক্ষার এই নতুন পদ্ধতি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলেই আমরা মনে করি।
এইচএসসি পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করার পরও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রধান চিন্তা হয়ে ওঠে, ভালো কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারা। অনেক শিক্ষার্থীর অনেক ভালো ফল বিফলে চলে যায় ভালো কোথাও ভর্তি হতে না পেরে।
ভর্তি পরীক্ষার সময়ে একসাথে কিংবা আগে-পিছে প্রায় সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির তারিখ ঘোষণা করায়, অনেকেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারে না। সময় সাপেক্ষতা সেই সাথে যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার বিশাল খরচসহ নিরাপত্তা এইসবের ঝক্কি-ঝামেলা তো আছেই।
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে আমি দেশের সুবিধাবঞ্চিত এলাকার মেধাবী ছাত্রীদের কথা বিশেষভাবে বলতে চাই। আমাদের দেশে ইদানীং মেয়েদের পরীক্ষা পাশ ও ভালো ফল করার হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। গ্রামে-গঞ্জে অনেক মেয়েই অত্যন্ত ভালো ফল করেও বাড়ির কাছাকাছি কোনো কলেজে ডিগ্রিতে কিংবা কোনো একটি বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হতে বাধ্য হয়। কারণ অস্বচ্ছল পিতামাতার পক্ষে তাদের মেধাবী মেয়েটিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঘুরে ঘুরে পরীক্ষা দেওয়ানোর মত সামর্থ্য ও সাধ্য কোনোটাই থাকে না।
নিজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, রংপুরের মেয়ে হয়ে আমি রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারি নি। যেহেতু ঐসব জায়গায় কোনো আত্মীয় পরিজন ছিল না, তার উপর আমাকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাবার মত পরিবারের কারো তেমন সময় ছিল না, সেজন্য ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেই সব স্থানে পরীক্ষা দিতে পারিনি। ঢাকায় যেহেতু আত্মীয় আছেন, তাই শুধু ঢাকা ও এর আশেপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দেবার সুযোগ হয়েছিল।
আমার এখনো মনে আছে ভর্তি ফরম, কাগজপত্র ফটোকপি করা, পোস্টাল খরচ, পরীক্ষা বাবদ যাতায়াত খরচসহ বিশাল খরচের জন্য আমার মধ্যবিত্ত বাবা-মাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে দেখেছিলাম। এতকিছুর পরেও নিজের ইচ্ছাশক্তি ও পরিবারের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্র্রেণিতে প্রথম হয়ে শিক্ষক হতে পেরেছি। অস্ট্রেলিয়াতে সাফল্যের সাথে পিএইচডি শেষ করতে পেরেছি।
অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমার অনেক মেয়েবন্ধু যাতায়াত ও ভর্তি পরীক্ষার বিশাল খরচের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগের অভাবে অনেকেই হতাশায় ভালোভাবে পড়াশুনা শেষ করতে পারেনি। আমরা বন্ধুরা সেদিন আফসোস করে আলোচনা করছিলাম, “ইশ যদি ভার্সিটির পরীক্ষা এখানেই (রংপুরে) হত, কতই না ভালো হত। ”
আমাদের সেদিনের আফসোস থেকে উত্তরণের পথ যেদিন ড. জাফর ইকবালের কলাম থেকে জানতে পেরেছিলাম, শিহরিত হয়েছিলাম। অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, সুবিধাবঞ্চিত অনেক মেধাবী পরিবারের ছেলেমেয়েরা ভর্তি পরীক্ষা দেবার সুযোগ পাবে। একবার কোথাও ভর্তি হবার সুযোগ পেলে বাবা-মা ধারদেনা, এমনকি জমি বেঁচে হলেও ছেলে-মেয়ের পড়াশুনার সুযোগ করে দেন। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় নিজেদের মেধার প্রমাণ করবার সুযোগটা তো আমাদের দিতে হবে!
বিসিএস পরীক্ষা এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নির্বাচনের পরীক্ষা যদি সারাদেশে বিভিন্ন কেন্দ্রগুলোতে হতে পারে, তাহলে ভতি পরীক্ষাই বা নয় কেন?
এই যুগান্তকারী শিক্ষার্থী-বান্ধব সিদ্ধান্তেরও যে বিরোধিতা হতে পারে, তা কল্পনাও করিনি। নোংরা রাজনীতিকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের নোংরা স্বার্থ-সিদ্ধির পক্ষে গান গাওয়ার সাহস পাবে কেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও তাদের সেই নোংরা আবদারে সাড়া দেবেন, এটা যেন অকল্পনীয়!
আমরা তো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। কোনো রাজনৈতিক নেতাগোছের কারো কাছে আমাদের প্রমোশনের জন্য যেতে হয় না। আমাদের তো কারো লেজুড়বৃত্তি করার প্রয়োজন হয় না। তাহলে স্থানীয় কিছু `অশিক্ষিত` নেতার অন্যায় দাবি মেনে নেয়ার পক্ষে শাবিপ্রবি প্রশাসন কি যুক্তি দেখাবে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ-বহির্ভূত কোনো দাবি একটি মেনে নেবেন তো এরপর একের পর এক অন্যায় দাবি মেনে নিতে হবে। এই নজির সৃষ্টি না করার পক্ষে ড. জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমীন হক যে দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন তা আসলেই নজিরবিহীন।
একজন শিক্ষক হয়ে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব আমাদের সবার আগে। তারা দুজন সে দায়িত্ব পালন করেছেন। ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের এসব রাজনীতিকরা যেন তাদের নোংরা নাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে গলাতে না আসে সে সতর্কবার্তাই তারা পৌঁছে দিলেন।
অন্যায়ের কাছে মাথা নত করা আর নয়। যেখানেই অন্যায় সেখানেই প্রতিরোধ। প্রতিরোধে ব্যর্থ হলে সমগ্র দেশবাসীকে সেই অন্যায়ের কথা চিত্কার করে জানিয়ে দিয়ে পদত্যাগ। দেশবাসীও জানুক কোথায় অন্যায় হচ্ছে, কারা কারা অন্যায় করছে, কারা সেই অন্যায়ের সমর্থন যোগাচ্ছে।
ড. জাফর ইকবালের দৃঢ়তা অত্যন্ত শিক্ষণীয়। মাথা না নুইয়ে থেকে এখনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায়, আর ভালো কাজের সমর্থনে সবাই হাতে হাত ধরে পাশে এসে দাঁড়ায়, প্রশাসন নামক মেরুদণ্ডহীন আজব প্রতিষ্ঠানকেও যে এভাবে শক্ত হাতে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়, সেই বার্তাই দিয়ে গেলেন প্রিয় জাফর ইকবাল।
বাংলাদেশ সময় ০৯০৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৩