ফিঙে পাখি নাকি দোয়া করে এই বলে যে, গৃহস্থের ঘর পুড়ুক আমি ছাই খাবো। যেহেতু পাখির ভাষা আমাদের জানা নেই সেহেতু এর সত্যমিথ্যেও কারো জানা নেই।
অপরদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তা কোনোভাবেই পর্যাপ্ত নয়।
সরকার ও বিরোধী পক্ষের বাইরে একদল মানুষ এখন দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনে ছোলা পুড়িয়ে খাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের একটি দল ছুটে গিয়েছেন রাষ্ট্রপতির কাছে। তাদের নেতৃত্বে যিনি ছিলেন তার পরিচয় বহু। তিনি ৭১-এ পাকিস্তানে ছিলেন। ৭৫-এও ছিলেন না কোথাওই!! তিনি এক সময় নিজ গরজে দেশের বৃহত্তর দলটি ত্যাগ করেন এবং যাওয়ার আগে সে দল সম্পর্কে বহু আকথা-কুকথা জনগণকে শুনিয়েছিলেন। তিনি একজন আইনজীবী, তবে দেশের ভেতর বিদেশি স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি খ্যাত। একই সঙ্গে তিনি নিজে একটি রাজনৈতিক দলের মালিকও। যে মালিকানা তিনি অন্য কাউকে ছাড়বেন কি না তা জানা যায় না, তবে তিনি অপর রাজনৈতিক দলগুলোকে অগণতান্ত্রিক বলে গাল দিতে ছাড়েন না। তিনি প্রয়োজনে তার অবস্থান সম্পূর্ণ বদলে ফেলতে পারেন, যেমন এখন তিনি তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচন করার সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন এবং প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের গোষ্ঠী উদ্ধার করেছেন। নিজে রাজনৈতিক দল করা সত্ত্বেও, একটি তীব্র অবস্থান নেয়া সত্ত্বেও তিনি বিশিষ্ট নাগরিক ও সুশীল হয়ে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছেন তার অপর সঙ্গীদের নিয়ে। তাদের কেউই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন কিন্তু যেহেতু তার নেতৃত্বে তারা গিয়েছেন সেহেতু ধরেই নেয়া যায় যে, তারাও তার মতামতকেই সমর্থন করেন।
আমার খুব মজা লাগে ভাবতে যে, একজন ব্যক্তি রীতিমতো রাজনৈতিক দলের প্রধান হয়েও অনায়াসে সুশীল, বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে বহাল থাকেন, অপরদিকে শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়াই কেবল হয়ে যান ‘“রাজনীতিক”; তারা আর সুশীল থাকেন না, কেন? রাজনৈতিক দল করেও যদি সুশীল থাকা যায়, বিশিষ্ট নাগরিক হওয়া যায় তাহলে তারা দু’জনও সমান ভাবে সুশীল, নন? কিন্তু না, তাদের সে অবস্থান দিলে তো সুশীলদের “রাজনীতিক” হওয়ার সুযোগ থাকে না। দেশের মানুষকে এই যে প্রতিনিয়ত বোকা বানানোর চেষ্টা, দেখে সত্যিই দুঃখ লাগে।
প্রশ্ন হলো, যারা দেশব্যাপী এই ভয়াবহ খাণ্ডবদাহন শুরু করেছে, যার নির্দেশে সারাদেশে মানুষ পুড়ে মরছে, রেলপথ ওপড়ানো চলছে, নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে তাদের কিংবা তার কাছে না গিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে কেন গেলেন? আজকে সবার আগে খালেদা জিয়ার কাছে গিয়ে এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলতে পারতেন যে, রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের হাতিয়ার জনগণের জানমাল নয়। কিন্তু তা তারা বলবেন না, বিশেষ করে যার নেতৃত্বে এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা গিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতির কাছে, তিনি খালেদা জিয়াকে একথা বলবেন কোন্ মুখে? কারণ, তিনি আর খালেদা জিয়া তো একই অবস্থানে, অর্থাৎ দু’জনেই দু’টি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বরং খালেদা জিয়া এই ব্যক্তির চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছেন। কারণ খালেদা জিয়া জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন এবং বিপুল ভোটেই জয়লাভ করেন। কিন্তু এই ব্যক্তিতো কোনো দিনই ভোটে বিজয়ী হতে পারেন নি। কিন্তু জনগণের বিরোধিতা করতে তিনিই সব সময় অগ্রগণ্য ভূমিকায় থাকেন, যা আমরা দেখেছি ১/১১-র কালে। রাজনীতিকে রাজনীতিবিকদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে তিনি সবার আগে রাস্তায় নামেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আজকেও তিনি নেতৃত্ব দিয়ে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে গেলেন রাষ্ট্রপতির কাছে। সেখানে গিয়ে তারা রাষ্ট্রপতিকে কী পরামর্শ দিলেন তা স্পষ্ট জানা যায় না। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারবেন না, জানা কথা। দেশ এখনও সংবিধান বহির্ভূত কোনো অবস্থানে যায়নি, সংবিধানের সম্পূর্ণ বিধান মেনেই চলছে। হ্যাঁ, যারা সংবিধানের বাইরে একটি সমাধানে যেতে চাইছে তারাই অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, আগুন জ্বালাচ্ছে, পুড়িয়ে মারছে মানুষ। আর সে কারণেই হয়তো এই বিশিষ্টজনেরাও রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট আর্জি জানিয়ে আসতে পারেননি।
বিএনপি-জামায়াতও কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেয়নি; তাহলে তারা আসলেই কী চান সে ব্যাপারে? খালেদা জিয়া ওয়েস্টিন হোটেলে যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তা যে অসার ছিল তাতো আর নতুন করে বলার দাবি রাখে না। দুই আমলের তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে উপদেষ্টাদের নিতে বলেছিলেন ঠিকই কিন্তু তারাতো আর সে দায়িত্ব নেয়ার মতো অবস্থায় নেই। কিন্তু তারপর এর বিকল্প কিছু আমরা শুনিনি তাদের কাছ থেকে--- কেবল ধংসযজ্ঞের নির্দেশ ছাড়া।
অপরদিকে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার, যারা কি না একা নয়, বরং কয়েকটি দলের সমন্বয়ে সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করেছে তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। যুক্তিবাদী যে কোনো মানুষকেই যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কার অবস্থান যৌক্তিক? তাহলে কি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কেউ আজকের ধংসযজ্ঞের সমর্থনে কথা বলবেন? মনে হয় না। তারপরও, সরকার সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছে এবং সে অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত সংবিধানকে সমুন্নত রেখে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত সেই একই তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক এমন মুহূর্তে দেশের বিশিষ্টজনদেরও যদি সংবিধান-বিরোধী অবস্থান হয় তাহলে এদেশে আর গণতন্ত্রের প্রয়োজন কি? একদিকে গণতন্ত্রের বুলি কপচাবেন অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্তকে সহিংসতা দিয়ে রুখতে চাইবেন, তাতো হবে না, হয় না, তাই না?
একথা আসলে কারোরই বোঝার বাকি নেই যে, নির্বাচনটা ব্যাহত হলে কার কতোটা লাভ হবে। হ্যাঁ, বিএনপি হয়তো ভাবছে যে, নির্বাচন ঠেকানো গেলে, তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ পরিষ্কার হবে। কিন্তু কোন সে মূল্যে? এটা কি বুঝতে কারো অসুবিধে হচ্ছে যে, আসলে বিএনপি বলে যে রাজনৈতিক দলকে আমরা চিনি তাদের শক্তি আসলে জামায়াতী তালপুকুরে শিবির নামক দৈত্যের হাতের মুঠোয়? যদি এই শক্তির বদৌলতে বিএনপি নির্বাচন ঠেকিয়ে ফেলেও তাহলে তার বিনিময়ে জামায়াত-শিবিরকে যে বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটিই দিয়ে দেয়া লাগতে পারে, সেটা বুঝতে কি কারো রাজনীতির পণ্ডিত হওয়ারপ প্রয়োজন আছে? নির্বাচনী ঐক্যের দোহাই দিয়ে যারা জামায়াত-বিএনপি’র সখ্যকে বিচার করেন তাদের কাছে প্রশ্ন করা যেতেই পারে, জামায়াত তো নির্বাচনে অযোগ্য রাজনৈতিক দল, এখন তাদের সখ্য তাহলে কীসের জন্য? জানি, এর উত্তর জানা নেই কারোরই। জানি না, আলোচ্য বিশিষ্ট নাগরিকগণ একবারও কি বিএনপি নেত্রীকে জিজ্ঞেস করার সাহস রাখেন যে, নির্বাচনেই যদি অংশ না নেন তাহলে জামায়াতকে সঙ্গে রেখেছেন কেন? এই বিশিষ্টদের যিনি নেতৃত্ব দিলেন তিনিতো আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজীবী, তিনি কি এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন যে, কোনো নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য করা যায় কি না? আর নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল যদি সহিংসতা চালায় এবং তার সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলও যুক্ত থাকে তাহলে উভয় দলকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধংসের জন্য আইনের আওতায় আনা যায় কি না? জানি, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই আইনজীবী এসব প্রশ্নের উত্তরে সম্পূর্ণ নীরব থাকবেন, কারণ দেশের স্বার্থে কোনো মামলায় তাকে আমরা পাই না। তিনি তখন বিদেশি স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশ ও বাঙালির দুর্ভাগ্য যে, এখানে গণতন্ত্র বারবার আহত হয় তাদেরই হাতে যারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এদেশের “বিশিষ্ট” হিসেবে পরিচিত। যারা ১/১১-র অরাজনীতিকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছিলেন কিংবা আজকে যারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কের জন্য কাঁদছেন তারা কিন্তু ইউরোপের কোনো দেশ কিংবা আমেরিকায় এরকম কোনো অরাজনৈতিক, অগণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে কথা বলার সুযোগ পাবেন না। কিন্তু এদেশে বলা যায় এবং সে জন্য তারা পুরস্কৃতও হয়ে থাকেন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে তারা খুব সহজেই উড়িয়ে দিতে পারেন এবং সেজন্যও তারা পুরস্কৃত হয়ে থাকেন। আজকে বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের ও বহু দলের সরকারের বিরুদ্ধে যে ধংসযজ্ঞ চলছে, যাতে সাধারণ মানুষ এবং তাদের সম্পদ পুড়ছে, রাষ্ট্রের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, কিন্তু যাদের নির্দেশে এসব ঘটছে বিশিষ্টজনরা আজ তাদেরই পক্ষ হয়ে মাঠে নেমেছেন। বিশিষ্ট হতে হলে এরকমটাই বোধ করি করতে হয়, নাহলে হয়তো বিশিষ্টই হওয়া যায় না।
ঢাকা॥ ২৮ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার॥ ২০১৩॥
masuda.bhatti@gmail.com
বাংলাদেশ সময় ১৬১০ ঘন্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৩