আরিফের বয়স তিন বছর। এই বয়সে পৃথিবী বোঝার কথা না।
সাবেদ আলী থাকেন বাসাবো কালীমন্দিরের ভাড়া বাড়িতে। গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানার চন্দ্রিপুর গ্রামে।
২৬ নভেম্বর অবরোধের দিন সকালবেলা সাবেদ আলী তাঁর অটোরিকশার মালিক তোফাজ্জল হোসেনের কাছে যান। প্রতিদিনকার মতো ৮০০ টাকা রোজে অটোরিকশা ভাড়া নেন। অভাবের সংসার, এক দিন বেকার থাকলে তিনবেলা আহার জুটবে না।
দুপুরের দিকে গুলশান এলাকা থেকে সোমেন হাজারি নামের এক যাত্রী নিয়েছেন অটোরিকশায়। তিনি যাবেন হাতিরপুলের ইস্টার্ন প্লাজায়। অটোরিকশা থেকে জায়গামতো নেমে সোমেন বাবু ভাড়া মেটানোর জন্য পকেটে হাত দিয়েছেন, এ সময় রুক্ষ ভঙ্গিতে এলো দুই যুবক। মুহূর্তে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিল অটোরিকশায়। বাঁচার জন্য চিৎকার শুরু করলেন সাবেদ আলী। অসহায় মানুষটি একসময় বেরোলেন মৃত্যুর খাঁচা থেকে। ততক্ষণে আগুনে তাঁর শরীর ঝলসে গেছে। এই দৃশ্য দেখে যাত্রী সোমেন বাবু কাঁদতে লাগলেন। কী করার আছে তাঁর! শেষ পর্যন্ত সাবেদ আলীর জায়গা হলো ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে। তাঁর মুখ আর মুখ নেই, পোড়া শরীর ভর্তি ব্যান্ডেজ। কাফনের মতো সাদা কাপড়ে শরীর ঢাকা। মাঝে মাঝে কাতরাচ্ছেন। হায় হায়, আর তো সহ্য করতে পারি না। মনে হয় মইরা যাইতাছি। মরণের চেয়েও বড় চিন্তা, গাড়ি না চালাইলে খামু কী? ঊউ-পোলাপানরে খাওয়ামু কী?
খবর পেয়ে সাবেদ আলীর স্ত্রী আলেয়া বেগম আরিফকে নিয়ে দৌড়ে গেছেন হাসপাতালে। স্বামীর পোড়া মুখ দেখে হতভম্ব। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। আর আরিফ! বাবার এই চেহারা সে কল্পনাও করতে পারে না। তার মনে হয় চেনা বাবাটি আর নেই, এ যেন অন্য মানুষ। বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে শিশুটি। পত্রিকায় শিশু আরিফের ছবি দেখে বুক ফেটে যাবে যে কারো। কী হৃদয়বিদারক কান্না!
এই কান্নায় ক্ষমতার চেয়ারলোভী মানুষগুলোর কিছুই যায় আসে না। সাবেদ আলীদের কথা, আরিফদের কথা তাঁরা ভাবেন না।
আরিফের কান্নার ছবি দেখে আমি আমার নিজের ছেলের মুখটা দেখতে পেয়েছি। আমার ছেলেটিও আরিফের বয়সী। সাবেদ আলীর জায়গায় যদি আমি হতাম, তাহলে আমার ছেলেটিও এ রকম বুকভাঙা কান্নাই কাঁদত। যারা মানুষের জীবন নিয়ে এ রকম সর্বনাশা খেলা খেলছেন তাঁদের কী একবারও এই অনুভূতি হয় না! একটুও মায়া হয় না মানুষের জন্য! যখন হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরায় মানুষগুলো, তাদের স্ত্রী-সন্তানদের আহাজারিতে ভারী হয় বাতাস, যাঁরা নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়ছেন এই সব নৃশংস ঘটনা আর হত্যাকাণ্ডের, তাঁদের কি একবারও মনে হয় না, ওই লোকগুলোর জায়গায় তাঁরাও হতে পারতেন। শিশু আরিফের জায়গায় হতে পারত তাঁর ছেলেটি।
তিন সাড়ে তিন সপ্তাহের হরতাল-অবরোধে দেশ অচল হয়ে গেছে। না না, অচল না, মনে হয় যুদ্ধ হচ্ছে দেশে। ককটেল ফাটিয়ে মানুষ মারা হচ্ছে, পেট্রোলের আগুনে এমনভাবে পুড়ছে মানুষ, কোনো মানুষের পক্ষে তার দিকে তাকানো সম্ভব না। পোড়া শরীর নিয়ে বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছে মানুষ। গুলিতে মরছে। খেলার উপকরণ ভেবে ফেলে রাখা ককটেল ধরেছে অবুঝ শিশু। বিস্ফোরণে ঝলসে গেছে তার কচি দেহ। মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সে। একটি শিশুর তিনটি আঙুল উড়ে গেছে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাকে বলছে, আঙুল চইলা গেছে মা, আমি এখন ভাত খামু কেমনে?
ছেলের কথা শুনে আঁচলে চোখ মোছেন মা। হাসপাতালের ডাক্তাররা দিশেহারা। তাঁরাও সহ্য করতে পারেন না এই কান্না।
হরতাল-অবরোধে এ পর্যন্ত মারা গেছেন প্রায় ৫০ জন মানুষ। আরো কত মানুষ যে হতাহত, কত মানুষ যে সর্বস্বান্ত, সেই হিসাব নেই।
আনোয়ারা বেগম সাত বছর ধরে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন একটি ব্যাংকে। কাজ সেরে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন, খিলগাঁওয়ে তিলপাপাড়ার গলির ভেতর থেকে কয়েক যুবক বেরিয়ে ককটেল ছোড়ে। মারাত্মক আহত হন তিনি। পরদিন মারা যান। তাঁর মেয়ে বুকফাটা আর্তনাদ করে আর কাঁদে। `আমরা রাজনীতি করি না, রাজনীতি নিয়ে ভাবিও না। আমাদের ভাবতে হয় আগামীকাল কী খাব? আমার মা কী অপরাধ করেছিলেন যে তাঁকে বোমার আঘাতে মরতে হবে? এই বিচার কে করবে? আমাদের কথা তো কেউ শুনবে না! (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৮ নভেম্বর ২০১৩) না, আমাদের কথা শোনার কেউ নেই। আমরা এ দেশের মানুষ রাজনীতির খেলায় অসহায় হয়ে আছি। রাজনীতির মানুষরা আমাদের নিয়ে খেলছেন। সে এমন ভয়ংকর খেলা, আমাদের যে জীবন যাচ্ছে, আমরা যে প্রতিদিন মরছি, এ নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
এত দিন জেনেছি মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি। এখন দেখছি রাজনীতি মানে মানুষ পুড়িয়ে মারা, রাজনীতি মানে দেশ অচল করে দেওয়া, রাজনীতি মানে গরিব মানুষের মুখের আহার কেড়ে নেওয়া, রাজনীতি মানে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, রাজনীতি মানে স্কুল-কলেজের পরীক্ষা বন্ধ, লাখ লাখ ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, রাজনীতি মানে বাস-ট্রাক পোড়ানো, রাজনীতি মানে রেললাইন উপড়ে ফেলা। মানুষের সর্বনাশ ছাড়া এ দেশের রাজনীতি আর কিছুই করতে পারছে না।
একজন অসহায় মানুষের ছবি ছেপেছে ডেইলি স্টার। জামালপুর থেকে কাজের আশায় ঢাকায় এসেছিলেন। অবরোধে কাজ জোটেনি, হয়তো খাবারও জোটেনি। ক্লান্ত অসহায় মানুষটি জামালপুরে ফেরত যাওয়ার জন্য কমলাপুর স্টেশনে বসে আছেন। কিন্তু রেললাইন উপড়ানো, ট্রেন চলছে না। গভীর অসহায়ত্ব নিয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন মানুষটি। মানুষের এই অসহায়ত্বের রাজনীতি আমরা চাই না। আমাদের সন্তান পিতৃমাতৃহারা হোক, এই রাজনীতি আমরা চাই না। আমাদের মানুষগুলো ককটেলে মরুক আর পেট্রলে পুড়ুক, এই রাজনীতি আমরা চাই না। আমরা ঘর থেকে বেরোতে পারব না, এই রাজনীতি আমরা চাই না। যে রাজনীতি আমাদের সন্তানদের স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে যেতে দেবে না, যে রাজনীতি মানুষকে না খাইয়ে রাখবে, যে রাজনীতি ধ্বংস করবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, যে রাজনীতির কারণে সারা বিশ্ব ধিক্কার দেবে আমার প্রিয় দেশকে, যে রাজনীতির আতঙ্কে দেশ ছেড়ে যাবেন গার্মেন্টের বিদেশি ক্রেতা, এই রাজনীতি আমরা চাই না।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যা করছে তাতে রাজনীতির ওপর তিতিবিরক্ত মানুষ। হে আমাদের রাজনীতিবিদগণ, চেয়ার আঁকড়ে রাখা আর চেয়ার দখল করার এই খেলা আপনারা দয়া করে বন্ধ করুন। আমাদের বাঁচতে দিন।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
ইমদাদুল হক মিলন: সম্পাদক, কালের কণ্ঠ
বাংলাদেশ সময়: ০৭২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৩