২০০৪ সালের কথা। এইচএইচসি পরীক্ষা শেষ হতেই ভর্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে কোচিংয়ে ভর্তি।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আগের দিন রাত দশটায় রাজশাহী শহরে গিয়ে পৌঁছলাম। সারা রাস্তা ট্রেনে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গিয়ে পরদিন পরীক্ষা দেওয়ার আগ্রহটাই মরে গেলো। তারপরও সব সামলে মন বেঁধে পরীক্ষায় বসা।
এরপর বাংলাদেশের আরও কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য এখান থেকে ওখানে ছুটে বেড়ানো। সঙ্গে মা-বাবা।
এর ঠিক ৬ বছর পর ২০১০ সাল। আমার ছোটবোনের ভর্তি পরীক্ষার সময় মাকে রাজশাহী থেকে চট্টগ্রাম, খুলনা পর্যন্ত ছুটে বেড়াতে হয়েছে। এর মধ্যে এমন পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়েছে যে, অনেক জায়গায় পরীক্ষাই দিতে যেতে পারেনি আগের ও পরের দিন পরীক্ষার তারিখ হওয়ার কারণে।
সম্প্রতি ভর্তি পরীক্ষার ফরম পূরণ করাটা অনেক সহজ হয়ে এলও মূল বিষয়টাতে এখনো সেই মান্ধাত্তা তালই রয়ে গেছে। এখনো ভর্তি পরীক্ষা নামক সোনার হরিণ ধরতে শিক্ষার্থীদের ছুটতে হয় দেশের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। অনেক ক্ষেত্রে তাদেরও অবস্থা নিশ্চয়ই আমার মতই হয়। পরীক্ষা দিতে গিয়ে পরীক্ষার আগ্রহেই ভাটা পড়ে।
চিত্রটা শুধু আমার পরিবারের নয়। বাংলাদেশের যে পরিবারের ছেলে-মেয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায় তাদেরই পড়তে হয় অনিবার্য এ ভোগান্তির মুখে।
তাই বাংলানিউজে প্রকাশিত অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল স্যারের ‘সাদামাটা কথা- বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা’ শিরোনামে লেখাটায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এক প্রশ্নে পরীক্ষার বিষয়টা যখন শুনলাম, তখন অনেকটা হাপ ছেড়েই বাঁচলাম যেন। কারণ এররকম হলে আর ভোগান্তিতে পড়তে হবে না আমাদের শিক্ষার্থীদের।
অবশেষে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মিলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাফর ইকবাল স্যারের মতো আমাদেরও আশা ছিল এর সুফল দেখে হয়ত অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এগিয়ে আসবে।
কিন্তু প্রতিটা ভাল কাজের পথেই ঘাটে ঘাটে প্রতিন্ধকতা তৈরি হয়। নিরীহদের জিম্মি করে ফায়দা লোটার চেষ্টা চালায় সার্থান্বেষী মহল। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সমন্বিত ইস্যুটাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার শরীরে লেপে দেওয়া হচ্ছে রাজনীতির কলংক।
যতটুকু জানা যায়, শাবিপ্রবির বর্তমান ভিসি এবং অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্যারের প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকেই একটা মহল সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সিলেটবাসীর মনে একটা ভুল ধারণা ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
তারা বরাবরই ‘সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা’ আর ‘গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা’ বিষয়টাকে এক করে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছেন। যেখানে তারা এ বিষয়টাই জোর দিয়ে প্রকাশ করছেন যে, সমন্বিত পরীক্ষা হলে সিলেটের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হবেন। পড়বেন কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে।
কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা’ আর মেডিকেল কলেজের ‘গুচ্ছ পদ্ধতির পরীক্ষা’ পদ্ধতি এক নয়। মেডিকেলের ‘গুচ্ছ পদ্ধতি’তে সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের একটাই পরীক্ষা হয়। তাতে মেধা তালিকার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৠাঙ্কিং করা হয়।
কিন্তু ‘সমন্বিত পদ্ধতি’তে প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের স্বায়ত্বশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিয়মকানুন বজায় রেখেই এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে পারবে।
প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা আলাদা মেধা তালিকা হবে। সে অনুযায়ী শিক্ষর্থীরা ভর্তির সুযোগ পাবেন। এক্ষেত্রে সিলেটের স্থানীয় মেধাবী শিক্ষর্থীদের বঞ্চিত হওয়ার কোনো সুযোগই নেই।
গত ১১ অক্টোবর বাংলানিউজে প্রকাশিত ‘সাদামাটা কথা- বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা’ শিরোনামে লেখাটিতে ড. জাফর ইকবাল বলেছেন, সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষার জন্যে আমরা যে পদ্ধতিটি গ্রহণ করতে যাচ্ছি সেটি এমনভাবে দাঁড় করানো হয়েছে যেন এর কারণে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কেই তাদের প্রচলিত কোনো নিয়মকেই পরিত্যাগ করতে না হয়। ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম পুরোপুরি বজায় রেখেই এ সুযোগটি নিতে পারবে।
এখানে তিনি আরও বলেন, একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একসঙ্গে পরীক্ষা নেওয়ার একটা বড় সুবিধা হচ্ছে, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করার সময় শুধু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়ে খুশি থাকতে হবে না। দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বসে প্রশ্ন তৈরি করতে পারবেন।
তিনি বলেন, এই পদ্ধতিটি গ্রহণ করা হলে সবচেয়ে বড় লাভ হবে ছাত্র-ছাত্রীদের। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সারাদেশ থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়তে আসে, যার অর্থ সারাদেশ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসতে হয়। এবছর তাদের কষ্ট অনেক কমে যাবে। সেই উত্তরবঙ্গের ছাত্র-ছাত্রীদের কষ্ট করে সিলেট আসতে হবে না। তারা কাছাকাছি যশোর ক্যাম্পাসে বসে পরীক্ষা দিতে পারবে। ঠিক সে রকম সিলেট এলাকার কোনো ছাত্র-ছাত্রী যদি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়, তাকে আর কষ্ট করে যশোর যেতে হবে না। সিলেটে বসে পরীক্ষা দিতে পারবে। একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে দু’টো বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো বিভাগের জন্য বিবেচিত হতে পারবে।
শাহজালাল ও যশোর বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় এবং সে অনুযায়ী ৩০ নভেম্বর পরীক্ষার সময়সূচিও নির্ধারিত হয়।
এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিলো। কিন্তু গোল বাঁধলো ১৯ নভেম্বর। ওই দিন হঠাৎ ‘সচেতন সিলেটবাসী’ নামে একটি সংগঠন সমন্বিত পরীক্ষা পদ্ধতিকে ‘গুচ্ছ পদ্ধতি’ অভিহিত করে তা বাতিলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর স্মারকলিপি দেয়।
সেখানে সংগঠনটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সিলেটকে পিছিয়ে রাখতে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এ গুচ্ছ পদ্ধতির পরীক্ষা আয়োজন করা হয়েছে।
সচেতন সিলেটবাসী এবং সিলেটের অন্য আরও কয়েকটি সামাজিক সংগঠনের দাবি, এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা হলে সিলেটের মেধাবী শিক্ষার্থীরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন।
এছাড়া প্রথম শ্রেণির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে এক কাতারে ফেলাতে ক্ষোভও জানিয়েছেন তারা।
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে মানববন্ধনসহ আরও নানা কর্মসূচি দেয় ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারীরা।
অবশেষে আন্দোলনকারীদের চাপের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ৩০ নভেম্বরের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করে।
এরপর ২৭ নভেম্বর ‘সচেতন সিলেটবাসী’সহ সিলেটের আরও বেশ কয়েকটি সংগঠন পরীক্ষার আগের দিন সিলেটে অবরোধ এবং পরীক্ষার দিন সিলেটসহ হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজারে হরতালের ডাক দেয়।
আর এ ঘটনার পর পদত্যাগপত্র জমা দেন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার অন্যতম উদ্যেগতা ড. জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হক।
অবশেষে সমন্বিত পরীক্ষার পক্ষে আন্দোলনকারীদের চাপে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সমন্বিত পরীক্ষা পদ্ধতি পুনর্বহাল করে। কিন্তু ৩০ নভেম্বরের পরীক্ষা স্থগিত করে দেয়।
অথচ ২১ নভেম্বর জারি হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে- সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় কোনো একটি অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত বা বৈষম্যের শিকার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের কষ্টের কথা বিবেচনা করেই শুধু একই প্রশ্নপত্রে সিলেট ও যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ ইশফাকুল স্বাক্ষরিত ওই প্রজ্ঞাপনে আরো বলা হয়, শিক্ষার্থীরা যাতে নিজ নিজ অঞ্চেলে বসে পরীক্ষা দিতে পারে সে জন্যই এ পদ্ধতির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ভাবতে অবাক লাগে বিশ্বায়নের এই যুগে সিলেটবাসীদের অনেকেই নাকি নিজেদের অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য ৫০ ভাগ সিট বরাদ্দ রাখার দাবি জানিয়েছেন।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের কথা না হয় বাদই দিলাম। বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আঞ্চলিক কোটা বরাদ্দ কি আছে? একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো জায়গায়ই তখনই কোটা বরাদ্দ দেওয়া হয় যখন সেখানে পিছিয়ে পড়া কোনো জনগোষ্ঠীর প্রশ্ন আসে। এবং তা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়।
যেমন বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই আদিবাসী/উপজাতি কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, খেলোয়াড় কোটা, সাংস্কৃতিক কোটা থাকে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের ক্ষেত্রেও আলাদা কোটা থাকে। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সমতা বিধানই যার উদ্দেশ্য। তাহলে কি সিলেটবাসী মেধা ও মননের ক্ষেত্রে নিজেদের পিছেয়ে পড়া জনোগোষ্ঠী ভাবছেন!
যা হোক, আসলে অনেক সময়ই কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে বলি হতে হয় দেশের আপামর জনসাধারণকে। শিক্ষাঙ্গনেও ব্যক্তি স্বার্থের কাছে প্রতিনিয়ত পরাস্ত হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ।
কিছু স্বার্থান্বেষী শিক্ষকের কারণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও একপ্রকার অচল হয়ে পড়েছে সার্বিক কার্যক্রম। এখানেও কি ঠিক তেমনই কোন নাটক মঞ্চায়নের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে না! হয়ত এখান থেকেই একটা সময় ডাক আসবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও বড় কোনো আন্দোলনের। যা হয়ত শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্টই নয়!!
এই যেমন শাহজালালে পরীক্ষা স্থগিত করায় শিক্ষার্থীদের কোন লাভ হওয়ার সুযোগ নেই। বরং পরীক্ষা পরে হওয়া মানে দেরিতে ক্লাশ শুরু হওয়া। তার মানে আরো পিছিয়ে পড়বে একাডেমিক ক্যালেন্ডার। স্বপ্নপ্রত্যাশী গোবেচারা শিক্ষার্থীদের কপাল পুড়বে অনাকাঙ্খিত সেজনজটে।
এটাই এখন আমার দেশের বাস্তবতা। ধারাবাহিক অস্থিতিশীলতায় বাড়ছে সেশন জটে ভুগছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে বয়স বাড়ছে ঠিকই। শেষ হয়ে আসছে সরকারি ও মানসম্পন্ন চাকরির বয়স।
জীবিকার জন্য যোগ্য হয়ে ওঠার দৌড়ে বিশ্ববিদ্যালয় নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটে যদিওবা একটা আসন পাওয়া যায়, কিন্তু এত ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে পড়ালেখার পাট চুকিয়ে সরকারি বা মানসম্পন্ন চাকরি পাওয়া যেন আরো বড় সোনার হরিণ হয়ে ওঠে। আর সোনার হরিণ ধরতে না পারার আক্ষেপ এক সময় পরিণত হয় হতাশায়। আসে ক্ষোভ। মাদকের নেশায় মত্ত হয়ে আত্মঘাতী অপরাধে ক্ষয়ে যায় জীবন। অশুভ আগ্রাসনে গুমরে কাঁদে শিক্ষালব্ধ জ্ঞান। অপরাধ এসে ভর করে স্বপ্নের পেছনে ছুটে শূন্য পাওয়া জীবনে।
এসবের দায় যদি সরকার, আপনি কিংবা আমিও মাথা পেতে নিই, তাহলেও কি সেই সময় বা তাদের জীবনকে সুন্দরভাবে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব!!!
তাই, দয়া করে উচ্চ শিক্ষাজীবনের শুরুতেই এমন অস্থিরতা ছড়াবেন না। শুরুটা অন্তত নির্বিঘ্ন করুণ। শুরুটা ভালো হলে পরের সব পর্বই আরো ভালো হবে। শেষটাও তো ভালো চাই আমরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৩