ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

দেশ নয় কুরুক্ষেত্র, সংবিধান নয় মহাভারত

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০১৩
দেশ নয় কুরুক্ষেত্র, সংবিধান নয় মহাভারত

মহাভারত রচনার প্রাক্কালে এর রচয়িতা ব্যাসদেব পরলেন মহা বিপাকে। কী উপায়ে এই ইতিহাস তিনি তার শিষ্যদের মাঝে বিতরণ করবেন? কপালে পড়ল চিন্তার ভাঁজ।



এমন সময় ভগবান ব্রহ্মা এসে হাজির। বললেন, হে ব্যাসদেব তুমি গণেশের স্মরণাপন্ন হও, সে-ই তোমাকে মহাভারত লিপিবদ্ধ করতে সাহায্য করবে।

ব্যাসদেব গণেশকে অনেক অনুরোধ করলেন আর গণেশও ব্যাসদেবের প্রস্তাবে রাজি না হয়ে পারলেন না। কিন্তু জুড়ে দিলেন এক শর্ত। বললেন, লেখা শুরু করলে আমার লেখনী এক মুহ‍ূর্তও থামবে না। আর একবার থামলে তা আর শুরু হবে না।

ব্যাসদেব আবারও পড়লেন মহা বিপাকে। কিন্তু তিনি দমবার পাত্র নন। তিনিও দিলেন পাল্টা শর্ত। বললেন, হে হাতিশ্বর, আমার রচনায় আট হাজার আটশ’ শ্লোক আছে যার অর্থ কেবল আমি আর আমার পুত্র শূক বুঝতে পারে, সঞ্জয়ও বুঝতে পারে কিনা সন্দেহ। আমার অনুরোধ আমি যা বলে যাব আপনি তার অর্থ না বুঝে লিখতে পারবেন না। গণেশ রাজী হলেন।

গণেশ সর্বজ্ঞ হলেও কূটশ্লোক লেখার সময় তাঁকে ভাবতে হতো, আর সেই অবসরে ব্যাসদেব অন্য বহু শ্লোক রচনা করতেন। এভাবেই এগিয়ে চলল মহাভারতের কাহিনী। সংক্ষেপে মহাভারত রচনার পশ্চাতভূমি এই।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী রচনার ঘটনাক্রমও অনেকটা সে রকম।

মহাভারত রচনার ক্ষেত্রে ব্যাসদেবের কোনো উপদেষ্টামণ্ডলী ছিল বলে জানা যায়নি। তিনি তার নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েই রচনা করেছেন মহাভারত।

আমাদের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী রচনার ক্ষেত্রে একটি উপদেষ্টা পরিষদ ছিল বটে। কিন্তু সে উপদেষ্টা পরিষদের কোনো পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। সংবিধান সংশোধন কমিটির উপদেশ-পরামর্শ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পাশ করা হয় পঞ্চদশ সংশোধনী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজস্ব চিন্তা ধারার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়ন করেন।

আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা আছে, ‘বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ(Embodiment of the will of the people) এ সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য। ’

কিন্তু সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কি জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি স্বরূপ? নাকি কেবল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ!

প্রশ্নটি এ কারণে যে, আমরা জানি, ২১ জুলাই ২০১০-এ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারপারসন ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কো-চেয়ারপারসন করে মহাজোটের অংশীদারসহ মোট ১৫ সদস্য নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হলো। দুঃখজনভাবে বিরোধীদল সেদিন সে কমিটিতে অংশগ্রহণ করে তাদের প্রস্তাব পেশ করেনি। কিন্তু আজ তারা দেশ অচল করে প্রকারান্তরে সংবিধান সংশোধনের দাবি করছে।

বিরোধীদল কোনো প্রস্তাব দিলে তা গ্রহণ করা হতো কি না সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। উপদেষ্টা পরিষদের পরামর্শ উপেক্ষা করা প্রধানমন্ত্রীর জন্য কোনো বড় বিষয় নয়। কারণ, সংবিধান ও রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী তিনিই সর্বেসর্বা। উপদেষ্টারা নবরত্নের চেয়ে বেশি কিছু নয়।

সংবিধান সংশোধন কমিটির ২৭টি বৈঠকের কোনো প্রস্তাবই বিবেচনা করা হয়নি পঞ্চদশ সংশোধনীতে। উপেক্ষা করা হয়েছে তিনজন প্রধান বিচারপতি, ১০জন আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, ১৮ জন বুদ্ধিজীবী ও সম্পাদকসহ সবার পরামর্শকেই।

শুধু তাই নয়, আজকে যারা প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাশীল সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিষয়ে বেশি উচ্চকণ্ঠ তারাই সেদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কথা বলেছেন।

সেদিন তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, আবদুল মতিন খসরু, রাশেদ খান মেনন, আবু মাল মুহিত ও ড. শিরিন শারমীন চৌধুরীসহ সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষেই কথা বলেছেন।

কিন্তু রাজনীতিবীদদের গণেশ উল্টাতে সময় লাগে না। সেদিন যারা এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন আজ তারাই বিরোধীদল ছাড়া নির্বাচন করার জন্য তথাকথিত সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন।

এক্ষেত্রে তোফায়েল আহমেদের একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলে, ‘যদি দুই টার্মের জন্য (তত্ত্বাবধায়ক)ব্যবস্থা রাখা হয়, তা হলে দেখা যাবে যে ওই দুই টার্মের পর হয়তো আমাদের ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। তখন আমাদের চিৎকার করতে হবে…’ অথচ, এই তোফায়েল আহমদই সংসদে এমকে আনোয়ারের উত্থাপিত প্রস্তাবের ওপর যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তা বিস্ময়কর।

শুধু তাই নয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও প্রথমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তবে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ৯০ দিনের মধ্যেই সীমিত করার পক্ষে মত দেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে না পারে তবে নির্বাচন হবে পূর্ববর্তী সরকারের অধীনে।

প্রধানমন্ত্রীর সেদিনের সেই প্রস্তাবও আজকের বিদ্যমান সংশোধনীর চেয়ে ভালো ছিল। কিন্তু তিনিই তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসে সংশোধনীটি প্রবর্তন করলেন।  

রাজনীতিবিদদের এতো দ্রুত অবস্থান বদল বুঝি এদেশেই সম্ভব।

সংবিধানে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ-অনুচ্ছেদ-৭(১)। কিন্তু সে ক্ষমতা আর জনগণের হাতে নেই। সাংবিধানিকভাবে আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের খোয়াব দেখি, কিন্তু চর্চা করি প্রজাতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা। ফলে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের বদলে প্রজাতান্ত্রিক রাজতন্ত্রই আমাদের ললাট লিখন।    

এখানে প্রচলিত রাজনীতি সংবিধানের ওপর কর্তৃত্ব করছে। সংবিধান অনুযায়ী রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে না। সহজ কথায় আমরা সাংবিধানিক রাজনীতি করি না, সংবিধানের রাজনৈতিক ব্যবহার করি মাত্র।

সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা সংক্রান্ত আদালতের রায়ের ওপর ভিত্তি করে পঞ্চদশ সংশোধনী করার কথা বলা হলেও বাস্তবে পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণার আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার জন্য একটি বিল মন্ত্রীসভা অনুমোদন করে।

বর্তমান রাজনীতির মূল আলোচ্য বিষয় হলো সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন। সেই আলোচনার পরিধি তত্ত্বাবধায়ক সরকারর চেয়ে আরো ব্যাপক। কিন্তু সেটি নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। তাই নির্বাচন কমিশনসহ  অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্ষমতাশীল করার বিষয়ে কারো মুখে রা নেই।

রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্র তথা জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি। দলগুলোর এসব এজেন্ডার সাথে জনগণের জ্বলে পুড়ে মরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো ইহকালীন সম্পর্ক নেই। এ রাজনীতির সাথে আমাদের সম্পর্ক হচ্ছে পরকালীন।

বিরোধীদলের এসব কর্মসূচির কারণে প্রত্যেক হরতাল-অবরোধের দিনই ৭-৮ জন করে প্রাণ হারাচ্ছে। জ্বলে পুরে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যেনো কুরুক্ষেত্র।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় আমাদের সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় ছিল। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে (অনুচ্ছেদ-৭খ) সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশকে অপরিবর্তনীয় করে ফেলা হয়েছে। যেটা পুরোপুরি অগণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক ভ্রান্তি। এসব অপরিবর্তনীয় বিধানের মধ্যে এমন অনেক বিষয় আছে যার পরিবর্তন ও সংশোধন করা অতি জরুরি।

বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলাম তার কনস্টিউশনাল ল’ অব বাংলাদেশ গ্রন্থে বলেছে, কোনো সংসদই পরবর্তী সংসদের হাত পা বেঁধে দিতে পারে না। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সে কাজটিও করা হলো।

ব্যাসদেবের ইচ্ছাপূরণ করতে গিয়ে গণেশ লিপিবদ্ধ করেছিলেন  মহাভারত। গণেশ ব্যাসদেবের সব শ্লোক বুঝেই মহাভারত লিপিবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে আমাদের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী যারা লিপিবদ্ধ করেছেন তারা তা বুঝে করেননি। আজকের রাজনৈতিক সংকটের শিকড় সেখানেই প্রথিত।

পাণ্ডব ও কৌরবদের গৃহবিবাদই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কারণ। কে হবেন রাজাধিপতি? পাণ্ডু পুত্র না ধৃতরাষ্ট্রের? এই নিয়ে হিংসা, দ্বেষ, ষড়যন্ত্র, কপট দূতক্রিয়া, বনবাস ইত্যাদি। পরিণাম-১৮ দিনব্যাপী যুদ্ধ। নিহত হলেন ভারতবর্ষের বহু রাজা। এমনকি ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধনসহ মোট শতপুত্র স্বর্গবাসী হলেন। অবশেষে ভষ্যিভূত কুরুক্ষেত্রের রাজা হলেন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডপুত্র যুধিষ্ঠির।

রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে রাখার জন্য আমাদের এখানেও হিংসা, দ্বেষ, ষড়যন্ত্র ও কপট দূতক্রিয়া সবই আছে। আছে, হত্যা, রক্তপাত, অগ্নিসংযোগ সবই। পার্থক্য হলো, মহাভারতে নিহত হয়েছিলনে ভারত বর্ষের বহু রাজা এমনকি স্বয়ং দুর্যোধনও। কিন্তু আমাদের এখানে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।  

রাজনৈতিক দলগুলোর মনে রাখা প্রয়োজন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দেশকে কুরুক্ষেত্র পরিণত করা চলবে না, যেমনটি বিরোধীদল আজ করছে। তেমনি সরকারকেও মনে রাখতে হবে, সংবিধান দেশের জন্য। এটি কোনো মহাভারত তো নয় যে তা সংশোধন করা যাবে না। নিহত সিএনজি চালক আসাদ গাজীদের মৃত্যুর দায়ভার কেউ এড়াতে পারবে না।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।