ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বিরোধীদলের আন্দোলন সরকারি দলের নির্বাচন অগ্নিদগ্ধ জনগণ

গাজী মহিবুর রহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৩
বিরোধীদলের আন্দোলন সরকারি দলের নির্বাচন অগ্নিদগ্ধ জনগণ

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের মাধ্যমে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন।

একটি দেশের জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে যে ধরনের আমেজ, উন্মাদনা কিংবা নির্বাচনকে ঘিরে উৎসবের চিত্র পরিলক্ষিত হওয়ার কথা তার ছিটেফোঁটাও নেই এই তফসিলকে ঘিরে।

বরং আদৌ নির্বাচন হবে কিনা, হলেও সেটা আন্তর্জাতিক ভাবে গ্রহণযোগ্য হবে কিনা এটাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

উৎসবের বদলে তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বিরোধীদল শুরু করেছে নাশকতা, ভাঙচুর, গাড়িতে আগুন দেওয়াসহ সরকার পতন, নির্বাচন বয়কট-প্রতিরোধ করার আন্দোলনের নামে অবরোধ। কার্যত তা অবরোধের নামে নৃশংসতা, মানুষ হত্যা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিশেষ করে রেলওয়ের ব্যাপক ক্ষতিসাধনসহ এক ধরনের রাজনৈতিক সন্ত্রাস।

সাধারণ মানুষ যেন এই দুই রাজনৈতিক শক্তির কাছে জিম্মি। দেশের প্রধান বিরোধীদল তথা ১৮ দলীয় জোট ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে নবগঠিত মন্ত্রিসভা তথা সরকারের ভাষায় নির্বাচনকালীন বর্তমান সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। তারা এখনও তাদের সেই পুরনো দাবি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে।

ঘোষিত তফসিলকে প্রত্যাখ্যান করে বিরোধীদল প্রথমে ৪৮ ঘণ্টা এবং পরে তা দুই দফায় বাড়িয়ে সর্বমোট ৭১ ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। এরপর দ্বিতীয় দফায় ডাকা ৭২ ঘণ্টার অবরোধ এখনো চলছে।

তফসিল ঘোষণার পর বিরোধীদলের এই অবরোধ কর্মসূচিতে ইতোমধ্যেই প্রায় ২০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। চলন্ত বাসে পেট্রোল বোমা মেরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে গণতন্ত্রের চিতায় পোড়ানো হয়েছে জ্যান্ত মানুষ। হয়তো কোনো মায়ের বুক খালি হয়েছে নতুবা কোনো বোনের সাদা শাড়ি পড়ার দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে। আরও যে কত প্রাণ আন্দোলনের নামে এভাবে অকাতরে ঝরবে তা বলা মুশকিল।

ইতোমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক নামক ঘাতকের থাবায় অসংখ্য তাজা প্রাণ বলি হয়েছে। রাজনীতি নামধারী এ জল্লাদের মৃত্যুক্ষুধা আর কত লাশ হজম করলে মিটবে তা কেবল তারাই ভালো জানে!

রাজনীতিকদের এই মৃত্যু খেলায় তাজুল ইসলামদের মতো কোনো কোনো সাধারণ মানুষ ঠিকই পাঁচ শতাধিক ট্রেন যাত্রীর জীবন বাচাঁনোর জন্য দুই কিলোমিটার দৌঁড়ে গিয়ে স্ত্রীর লাল কাপড় নিয়ে ট্রেন থামানোর জন্য দাঁড়িয়ে যায় মানবতার শ্রেষ্ট উদাহরণ হতে।

যেকোনো গণতান্ত্রিক দাবি আদায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু এখনকার একেকটা রাজনৈতিক আন্দোলন-কর্মসূচি মানেই লাশের মিছিল লম্বা হওয়া। মায়ের বুক খালি হওয়া, কোনো সন্তানের অকালে এতিম হওয়া অথবা কোন বোনের সাদা শাড়ি পড়ে বোবা কান্নায় ফেটে পড়া।

যত বেশি লাশ, আন্দোলন  ততো বেশি সফল, ততো বেশি বেগবান হয়। অথচ রাজনীতির কি নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছে দেশের কর্ণধাররা।

হরতাল-অবরোধ ঢেকেই বড় বড় তকমা লাগানো নেতারা লাপাত্তা। শীর্ষ পর্যায়ের কোনো নেতা-কর্মীকে মাঠে পাওয়া যায় না। আন্দোলনের নামে বলি হয় সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। এমনকি বিরোধীদলীয় নেত্রীর কড়া নির্দেশনা থাকার পরেও মাঠে দেখা যায়নি সেইসব নেতাদের যারা ঠিকই কোট-টাই, দামি পাঞ্জাবি পড়ে ক্যামেরার সামনে এসে হাজির হন রাতের আঁধারে।  

ইতিহাস সাক্ষী রোম নগরী যখন জ্বলে নিরুরা তখন বাঁশি বাজায়। আমাদের দেশও যখন জ্বলছে নিরুরা তখন নির্বাচনের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে আবারো ক্ষমতার মসনদে বসার মোহন বাঁশি বাজাচ্ছেন।

বিরোধীদলের আন্দোলনকে কোনো ধরনের তোয়াক্কা না করে তথাকথিত সর্বদলীয় সরকারের প্রতিটি দলই তাদের দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যস্ত। আওয়ামী লীগ নাকি ইতোমধ্যেই তাদের তিনশ’ আসনের মনোনয়ন প্রায় চ‍ূড়ান্ত করেছে। জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য সরকারি দলও একই প্রক্রিয়ায় এগুচ্ছে।

দেশের প্রধান বিরোধীদলসহ ১৮ দলীয় জোট এই যে আন্দোলন সংগ্রাম করছে প্রতিদিন মানুষ মরছে এ ব্যাপারে যেন সরকারের কিছুই করার নেই। বরং তারা বিরোধীদলের এই আন্দোলনকে দমানোর দায়িত্ব দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন।

সরকার যেমন বিরোধীদলের কোনো কথাকে আপোষের স্বার্থে আমলে নিচ্ছে না তেমনি সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তাসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কথাও চিন্তা করছে না। এভাবে হরতাল-অবরোধের মধ্য দিয়ে আর কিছুদিন দেশ চলতে থাকলে অর্থনীতির চাকা উল্টো পথে ঘুরতে শুরু করবে। এমনিতেই দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত গার্মেন্ট শিল্পে এক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে তার উপর আবার যদি রাজনৈতিক সংকট ঘনিভূত হয় তাহলে সম্ভাবনাময় এবং স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পথে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ আবারও পিছিয়ে পড়বে, আবারো হোঁচট খাবে।

২.
চলমান দুই বলয়ের বাইরে একটি তৃতীয় শক্তি গড়ে তোলার প্রাণপন চেষ্টা ১/১১ এর কুশীলবরা করে ব্যর্থ হয়ে দেশান্তরিত হয়েছেন। আর কখনো দেশে ফেরা হবে কিনা তা হয়তো নিজেরাই জানেন না।

দুই নেত্রীকে জেলের স্বাদ দিতে পারলেও জনগণের ভাগ্যে আবারো ফিরে এসেছে সেই পরিস্থিতি যেই কারণে ১/১১ এসেছিল। কাজেই বিবাদমান দুই পরাশক্তির সমপর্যায়ের কোনো তৃতীয় শক্তি এদেশের রাজনীতিতে আপাত দৃষ্টিতে দৃশ্যমান বলে মনে হচ্ছে না। যদিও মাঝে মধ্যে কিছু দলছুট কিংবা দল থেকে বিতাড়িত নেতাদের তৃতীয় শক্তি গঠনের দৌড়ঝাপ দেখা যায়। বাস্তবে তাদের শক্তি সম্পর্কে তারা নিজেরাও বেশ সচেতন বলেই শেষ পর্যন্ত আর সেই তথাকথিত তৃতীয় শক্তি দেখা যায় না। কিন্তু এ কথা খুবই সময়োপযোগী যে বিবদমান দুই বলয়ের বাইরে কোনো বিকল্প সাধারণ মানুষের নাগালে থাকলে মানুষ তা একবারের জন্য হলেও ভেবে দেখতো তা রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে সর্বত্র মানুষের কথা শুনলে মনে হয়।

সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম প্রচলিত সহিংস রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে চায়। তারা এক সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। তারা যেমন প্রকাশ্য দিবালোকে বিশ্বজিতকে চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য দেখতে চায় না তেমনি রাজনৈতিক অধিকারের নামে হরতাল-অবরোধ দিয়ে বাসে-সিএনজিতে পেট্রোল বোমা মেরে অগ্নিদগ্ধ করে মানুষ মারার দৃশ্যও দেখতে চায় না। এই রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি থেকে দেশ-জাতি নিষ্কৃতি চায়।      

কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো এই দুই দল যতো কিছুই করুক না কেন, এই দুই বলয়ের বাইরে তাদের সমপর্যায়ের তৃতীয় কোনো শক্তি এই মুহূর্তে প্রত্যাশা করাও খুব একটা যৌক্তিক না। ফলে এই দুই পরাশক্তিকেই আমাদের কর্ণধার, নীতিনির্ধারক তথা রাষ্ট্রযন্ত্রের হর্তাকর্তা মেনে নিয়ে কিভাবে রাজনৈতিক সহাবস্থান নিশ্চিত করা যায় সেই পথেই হাঁটতে হবে।

প্রত্যেক নাগরিককেই যার যার নিজস্ব অবস্থান থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে হবে। নাগরিকদের ঐক্য থাকলে রাজনীতিকরাও নিজেদের পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে।

নামদারী নাগরিক ঐক্য গঠন করে নিজের অবস্থান শক্ত করা নয় বরং প্রয়োজন সত্যিকারের নাগরিক ঐক্য। নাগরিকদের সচেতনতা ও ঐক্য না থাকার কারণে প্রতিবারই নির্বাচন পূর্ববতী সময়ে গণতন্ত্রের নামে, আন্দোলনের নামে সাধারণ মানুষকে বলি হতে হয়, লাশ হতে হয়।

সেবার যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে বিচারপতি কে এম হাসানকে মানবে না এই প্রত্যয়ে আন্দোলন শুরু করে তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগ।

আন্দোলনের তীব্রতা ও সহিংসতার মাত্রা ছিল ভয়াবহ। এবং দুই জোটের মধ্যে প্রকাশ্য সংঘাতে রক্তাক্ত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ তথা সারা দেশ, এসেছিলো ১/১১। এবারও হাসানের বদলে হাসিনাকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান না মানার পাশাপাশি সংবিধান থেকে বাতিলকৃত তত্ত্ববধায়ক সরকার পদ্ধতি পূনর্বহালের দাবিতে চলছে আন্দোলন-হরতাল-অবরোধ, জ্বলছে বাস-পুড়ছে মানুষ।

এবারও কি সেইবারের মতো কোনো অগণতান্ত্রিক শক্তি আবির্ভূত হবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে জল্পনা-কল্পনা।  

গত পাঁচ বছরে দেশের চিত্র পাল্টেছে সন্দেহাতীত ভাবে, দেশ এখন উন্নতির ট্র্যাকে কিন্তু রাজনীতির সেই চিরচেনা হরতাল, মানুষ পোড়ানো, গাড়িতে আগুন দেওয়া, খুন, নির্বাচন নিয়ে টাল বাহানা, বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের দমন-নিপীড়ন এখনো রয়ে গেছে সেই পুরনো ধাঁচেই। বরং তা আরো বেগবান হয়েছে পুরনো অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে।

বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে আদর্শিক কোনো দ্বন্দ্ব নেই। দ্বন্দ্ব যেটা আছে তা কেবলই ক্ষমতা কেন্দ্রিক।

দু’দলই ক্ষমতার মসনদে বসার সর্বগ্রাসী খেলায় লিপ্ত। রাজনীতি তার চিরায়ত আদর্শের জায়গাটুকু হারিয়েছে খুবই অপ্রত্যাশিত ভাবে। দুই দলই তাদের নিজ নিজ আদর্শের বদলে বেছে নিয়েছে ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল-অপকৌশলকে। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে সবাই মিলেমিশে একাকার।

যে এরশাদকে স্বৈরাচার বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলতো আওয়ামী লীগ সেই এরশাদকে নিয়েই জোট করে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে। দেশ স্বাধীনের পর থেকেই যেখানে সুবিধাভোগী বামেরা নিজেদের শেষ আশ্রয়স্থল মনে করতো আওয়ামী লীগকে সেই আওয়ামী লীগই ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে রাতের আঁধারে ভোটের জন্য জোটবদ্ধ করতে চায় ইসলামি ঐক্যজোটকে।

ক্ষমতা এখন সব আদর্শের উর্ধ্বে। সরকারিদলের মাথায় এখন কেবলই নির্বাচন। তারা আবারো ক্ষমতার গন্ধ শুকতে শুরু করেছে।

অন্যদিকে প্রধান বিরোধীদলের ঘাড়ে চেপে বসেছে জামাতের প্রেতাত্মা। হাজারো সমালোচনা থাকার পরও তারা জামাতকে ছাড়তে নারাজ। আদালত কর্তৃক নিবন্ধন বাতিলের পরও জামাত হয়ে উঠেছে প্রধান বিরোধীদলের আন্দোলন-সংগ্রামের মূল চালিকাশক্তি।

আর দুই দলের এহেন ক্ষমতায় যাওয়ার যুদ্ধে রক্তাক্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক আন্দোলনের বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ, পেট্রোল বোমায় আক্রান্ত হয়ে বার্ন ইউনিটে কাতরে মরছে সাধারণ মানুষ। এটাই যেন এদের নিয়তি, এটাই যেন এদের প্রাপ্য মুক্তিযুদ্ধের এই বাংলাদেশে!
                                                    
লেখক: গাজী মহিবুর রহমান, কলাম লেখক                                                     Gmrahman1980@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।