ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বুয়েটে চলছে সমান্তরাল প্রশাসন!

হাবীব ইমন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০১৩
বুয়েটে চলছে সমান্তরাল প্রশাসন!

দেশের প্রধান প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) আন্দোলনের এক বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। আন্দোলনটি ছিল সরব।

তিন দফা দাবিতে এ আন্দোলনটি করেছেন সেখানকার শিক্ষক সমিতির নেতারা। দাবিগুলো ছিল- ভিসি অপসারণ, প্রোভিসির অপসারণ এবং প্রোভিসি পদ বিলুপ্তকরণ।

ভিসি-প্রোভিসির বিরুদ্ধে একজন ছাত্রের রেজাল্ট জালিয়াতি, একজন শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া এবং আরো কিছু প্রশাসনিক নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগ নিয়ে এ আন্দোলন। আপাতদৃষ্টিতে অভিযোগগুলো যৌক্তিক হলেও তার ভেতরে ছিল সর্ষের মধ্যে ভূত থাকার মতো ব্যাপার। আমার মনে হয়, চার মাস ধরে চলা এ আন্দোলনের প্রভাব অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়েছে।  

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশের এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সরকার তখন প্রো-ভিসিকে প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু প্রো-ভিসি পদ বিলুপ্ত করেনি। প্রো-ভিসি প্রত্যাহারে আন্দোলন স্থগিত করে শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ক্লাশে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন এবং শর্ত জুড়ে দিয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেন। তাদের দেয়া শর্ত অনুযায়ী আন্দোলনের চাপে উপাচার্য একাডেমিক কাউন্সিলের কোনো সভার সভাপতিত্ব করতে পারছেন না। উপাচার্যের পরিবর্তে একাডেমিক কাউন্সিলের সভার সভাপতিত্ব করছেন ডিনরা। এই শর্ত মেনে নিয়েই এখনো ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছেন উপাচার্য অধ্যাপক এসএম নজরুল ইসলাম।

বুয়েটে এখন চলছে সমান্তরাল প্রশাসন। ছাত্রকল্যাণ পরিচালক, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং রেজিস্ট্রারকে সরিয়ে সেখানে এখন বসেছেন আন্দোলনকারী নেতারা। শিক্ষক সমিতির নেতারা এখন শ’খানেক সিনিয়র শিক্ষককে ডিঙ্গিয়ে দখল করেছেন বিভিন্ন নিয়োগ কমিটি, তদন্ত কমিটি এবং অর্গানোগ্রাম কমিটিগুলো। অথচ, আন্দোলনের সময় বার বার বলা হয়েছিল যে ‘বুয়েটের প্রো-ভিসি অত্যন্ত জুনিয়র একজন শিক্ষক। ’ তৎকালীন প্রো-ভিসির সিনিয়রিটি বুয়েটে প্রথম ৫০ জনের মধ্যে ছিল। প্রো-ভিসি পদে কোন সিনিয়র প্রফেসরকে নিয়োগ দিতে হবে এবং বুয়েটের কাউকে এই পদে নিয়োগ দিতে হবে, এমন কিছু কোনো সরকারি গেজেটে নেই। এটি সম্পুর্ণভাবে আচার্যের (চ্যান্সেলরের) এখতিয়ার। তখন সিনিয়রিটি নিয়ে সারাদেশে বুয়েটকে সংবাদ শিরোনাম করে সেই শিক্ষক নেতারাই এখন সিনিয়রিটি ভেঙ্গে পদ-পদবি গ্রহণ করছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের একটি অনিয়মের দাবিটি এখন অসাড়, আন্দোলনের আজ প্রায় এক বছর পার হয়ে গেলো। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো সমাধানও তারা করতে পারেন নি।  

যে উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে শিক্ষক সমিতি আন্দোলন করেছে, শিক্ষার্থীদের শরীর থেকে তাজা রক্ত সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে উপাচার্য অফিসের সিঁড়িতে ঢেলে বুয়েটের মত একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কলঙ্কিত করেছেন। সেই শিক্ষক সমিতির নেতারা আজ তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। উপাচার্য অপসারণের দাবি এখন আর তোলে না কেউ। দু’একটি মিটিংয়ের পর শিক্ষক সমিতির কার্যবিবরণী থেকেও উপাচার্যের অপসারনের দাবিটি মুছে গেছে। দাবিটি অকেজো হয়ে গেছে। গত এক বছরে শিক্ষক সমিতির নিয়মিত মাসিক সভা হয়নি। তাহলে কি নীতি-নৈতিকতার দোহাই দিয়ে আন্দোলনের ‘নাটক’ সাজানো হয়েছে! সাধারণ ছাত্রদের জিম্মি করে এ আন্দোলন সম্পর্কে বিতর্ক থেকেই যায়। কিছু প্রশ্ন থাকে।  

দীর্ঘদিন ধরে চলমান আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন। এর সূত্রপাত খুঁজলে দেখা যাবে এখানেও ভিসি বিরোধী আন্দোলনের একটি মোড়ক রয়েছে। সেই মোড়কের ফরম্যাট ও প্রক্রিয়া বুয়েট আন্দোলনের মতো। একটি ভিন্নতা অবশ্য রয়েছে, সেটি হলো জাবি-তে শিক্ষার্থীরা বুয়েটের মতো এই আন্দোলনের সাথে এতোটা সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়নি। এখানেও আন্দোলনের পেছনে আসলে রয়েছে শিক্ষকদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিভিন্ন পদ-পদবি পাবার আকাঙ্ক্ষা এবং সর্বোপরি সমান্তরাল প্রশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রশাসনকে হাতের মুঠোয় রাখার বিষয় জড়িত।

সাধারণত এ ধরণের আন্দোলনের মাস্টার মাইন্ড হিসেবে কাজ করে শিক্ষকদের মধ্যে গড়ে ওঠা একটি চক্র। আরো ভালোভাবে বললে কিছু সিনিয়র শিক্ষকই তাদের জ্যেষ্ঠতা এবং ব্যক্তিগত কারিশমাকে ব্যবহার করে এ কাজটি করে থাকেন। জুনিয়র শিক্ষকদের সবার পক্ষে সিনিয়র এসব শিক্ষকের কোনো আদেশ বা অনুরোধ উড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয় না। একজন বিভাগীয় প্রধান যদি বলেন তাহলে জুনিয়র শিক্ষকরা বা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেটা মানতে অনেকটাই বাধ্য। কারণ, তিনিই হচ্ছেন তাদের কাছে সবচেয়ে কাছের অভিভাবক-প্রশাসন।

এছাড়া, যেকোনো কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মানুষের এক ধরনের সহজাত অবদমিত ক্ষোভ থাকে। সঙ্গত কারণে কর্তৃপক্ষের যেকোনো সামান্য ভুল-ত্রুটিকে অনেক বড় করে দেখতে পছন্দ করে সবাই। বুয়েট ভিসির রেজাল্ট জালিয়াতির ঘটনাটাই দেখা যাক। এটি কোনোক্রমেই রেজাল্ট জালিয়াতির ঘটনা নয়। ভিসি কোনো ছাত্রের রেজাল্ট বদলে তাকে প্রথম স্থান থেকে দ্বিতীয় স্থানে নিয়ে আসেন নি। বিষয়টি ছিল একটি ছাত্রের রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত। সেখানে একজন ছাত্র তার বিভাগীয় প্রধান এবং অ্যাডভাইজারের মাধ্যমে আবেদন না করে আবেদনটি সরাসরি ভিসি বরাবর করে । অসুস্থতার কারণে তার একটি কোর্স রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার জন্য। ভিসি সেটি রেজিস্ট্রার বরাবর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য লিখে পাঠান। রেজিস্ট্রার অফিস সেটি বাতিল করে। এর ফলে ঐ ছাত্রের রেজাল্টের কোন পরিবর্তন হয়নি।

আরেকটি বিষয় হলো রেজাল্ট প্রকাশ করার দায়িত্ব শুধু পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের। জানা যায়, এই ছাত্রের আবেদন কখনই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের চৌহিদ্দিতে পর্যন্ত পৌঁছায় নি। ভিসি একটি ভুল করেছেন, তা হলো তিনি ঐ ছাত্রের আবেদনটি বিভাগীয় প্রধানের কাছে ফেরত পাঠাতে পারতেন।

শিক্ষার্থীরা সাধারণত শিক্ষকদের ব্যাপারে অন্ধ বিশ্বাস রাখে, বুয়েটের বেলায় এটি আরো বেশি প্রযোজ্য। তাই সিনিয়র শিক্ষকদের অনেকে এই বিষয়টি নিয়ে তাদের সামনে নিয়ে আসায় তারাও তাদের প্রাণপ্রিয় বুয়েটকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই ব্যাপারটি তখনই উপাচার্যের সভাপতিত্বে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে আলোচনা করেই সমাধান করা যেতো।

বুয়েটে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে একটি উদাহরণ দেখিয়ে আন্দোলনকারীরা মাতম করেছেন সেটি আরো দুর্ভাগ্যজনক। বুয়েটে শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক বিভাগ এবং অনেক ইনস্টিটিউট রয়েছে। বিভাগগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় সদ্য পাশ করা গ্রাজুয়েটদের মধ্য থেকে। এখানে সব সময় মেধা ক্রমানুসারে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় না। যদি তাই হতো তাহলে কোনো নিয়োগ কমিটির প্রয়োজন হতো না। অথচ, শিক্ষক নিয়েগের জন্য ভিসি, প্রো-ভিসি, সকল অনুষদের ডিনবৃন্দ এবং বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত একটি সিলেকশন বোর্ড কাজ করে। কাজেই এখানে যেকোনো নিয়োগের জন্য দায় শুধু ভিসির হতে পারে না। যে আন্দোলনকারী নেতাদের অনেকে অনেক বিভাগের শিক্ষক হিসেবে বুয়েটে শিক্ষকতা করছেন, তাদের অনেকেই মেধা তালিকার ক্রমানুসারে অনেক পেছনে ছিলেন এবং সদ্য পাশ করা গ্রাজুয়েট হিসেবে শিক্ষক হবার যোগ্যতাও অর্জন করেন নি। তবুও তারা এখন এখানকার শিক্ষক। এসব ল্যাটারাল এন্ট্রি পাওয়া শিক্ষকরা এই আন্দোলনে ছিলেন ভীষণ সোচ্চার। আরো দুঃখজনক হলো, যে সকল ডিন ঐ নিয়োগ কমিটিতে ছিলেন তারা কেউ কখনো কোনো শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে লিখিত আপত্তি জানান নি। কিন্তু আন্দোলনের সময় তারাই সর্বাগ্রে গণপদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে সংবাদ শিরোনাম হলেন। দেশের মানুষ বুঝলো, বুয়েটের ভিসি জঘন্য কাজ করে যাচ্ছেন এবং বুয়েটকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। একটা সহজ প্রশ্ন রাখাই যেতে পারে, নিয়োগ দেয়ার সময় এই ডিনরা সবাই ভিসির সাথে সুর মিলিয়েছিলেন কি করে? আন্দোলনের সময় তারাই আবার সেটাকে অনিয়ম বলেছিলেন কেন? সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!

হাবীব ইমন: শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮,২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।