বিএনপি কার্যালয়ে উল্টে থাকা চেয়ার আর জনশূন্যতা নিয়ে উত্তপ্ত হয়েছিল টকশোগুলো। বিএনপি থেকে বিবৃতি এসেছিল গণতন্ত্রের উপর পদাঘাতের।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলটির নেতারা এই সময়ে চোয়ালের পেশীর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে চলেছেন। বিভ্রান্তিকর বক্তব্যে বিএনপির ত্রাস সৃষ্টিকারী কর্মসূচিগুলোকে আন্দোলনরূপে চালানোর চেষ্টা চলছে। প্রতিদিন রাষ্ট্রিয় সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে, বীভৎস মৃত্যু ঘটে চলেছে আর বিএনপি নেতারা অজ্ঞাত স্থান থেকে দাবি করে চলেছেন, এসবের দায় সরকারের। কিছু কিছু টক-শো আলোচকও একই তালে মাথা দুলিয়ে বলছেন, সরকার বিএনপিকে সহিংসতার পথে ঠেলে দিয়েছে।
এই দু’টো যুক্তি বস্তুত গোয়েবলস থিওরির মত। একই উক্তির পুনরাবৃত্তি করে মগজ ধোলাইয়ের কৌশল। যারা বলেন সরকার বিএনপিকে সহিংসতার পথে ঠেলে দিয়েছে, কোনো সন্দেহ নেই তারাই প্রমাণ করে দেন সহিংসতা বিএনপি-ই করছে। এ সহিংসতার তীব্র প্রতিবাদ না জানিয়ে ‘সরকারই দায়ী’ বলে যারা যুক্তি দেখান, তারা বস্তুত সহিংসতাকেই জিইয়ে রাখেন। এই সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেয়ার অর্থ জাতীয় স্বার্থ নয়, কোনো দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করা কেবল।
বিভিন্ন আলোচনার অন্যতম একটি শিরোনাম হল বিএনপি’র ‘আন্দোলন’। বাংলাদেশের জন্ম আন্দোলনের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে। ৫২, ৬৯, ৭১ – আমরা দেখেছি, জেনেছি, উপলব্ধি করেছি আন্দোলনের প্রবাহ, জনসম্পৃক্ততা, শক্তি। সহজ কথায় আন্দোলনের চরিত্র। এই ঐতিহাসিক পটভূমি পেরিয়ে স্বাধীন দেশেও গণতন্ত্র রক্ষার্থে আন্দোলন হয়েছিল। যেমন, ৯০ এর এরশাদবিরোধী আন্দোলন। বিএনপি সরকারের পতন ঘটাতে আওয়ামী লীগও আন্দোলন করেছিল। আন্দোলন যখন জনসম্পৃক্ততা পায়, তখন তা রূপ নেয় গণআন্দোলনে। এমন আন্দোলনে নানা কর্মসূচি থাকে, মিছিল থাকে, স্লোগান থাকে, সংস্কৃতি থাকে, নেতাদের অবস্থান থাকে রাজপথে, কর্মীদের ভিড়ে উজ্জীবিত থাকে একেকটা জনসভা। এমন আন্দোলনে জনতাও উৎসুক হয়ে যোগ দেয়। এমন আন্দোলনে পুলিশ বাধা দিতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। এ জাতির আন্দোলনের ঐতিহাসিক চরিত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ‘আন্দোলন’কে সন্ত্রাসের সমার্থক রূপ দিয়েছে।
শাসক গোষ্ঠী আন্দোলনকারীদের সহিংসতার জন্য কখন দায়ী হতে পারে? যদি আন্দোলনকারীদের সাথে শাসক গোষ্ঠি মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, যদি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে শাসকগোষ্ঠি বাধা দেয় এবং তাতে করে আন্দোলনকারীরা হঠাৎ-উত্তেজনায় অনিয়ন্ত্রিত আচরণ করে, তখনই কেবল। এখনকার বাস্তবতা কী বলে? অরাজকতা সারা দেশে হচ্ছে এবং বিরোধী দল ও জামায়াতের আঁতাতের নীল নকশা মাফিকই তা হচ্ছে। রাজপথে জাতীয় স্বার্থে কোনো ঝাঁঝালো স্লোগানের মিছিল নেই। স্বয়ং ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল কর্মীদের মাঠে থাকতে বলার পরও রাজপথে আন্দোলন জমেনি। বরং অবরোধকারীরা ট্রেন উল্টে দিচ্ছে, বাসে পেট্রোলবোমা ছুঁড়ে মারছে। অজ্ঞাতবাস থেকে ভিডিও বার্তায় কঠোর থেকে কঠোর আন্দোলন আহবানের বার্তা আর কিছুই না---- আরো আরো রেল লাইন উপড়ে ফেলার ডাক, আরো আরো বাস-সিএনজি পোড়ানোর ডাক।
কেন অবরোধ হচ্ছে? কেন মানুষ পুড়ছে? কেন জনজীবন বিঘ্নিত হচ্ছে? জনজীবনের বলি চড়িয়ে বিরোধী দল আর সরকারি দলের সংলাপ কোন গণতন্ত্র এনে দেবে আমাদের? কাদের জন্য হবে সেই গণতন্ত্র? নির্বাচন হয় জনগণের রায়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। কিন্তু আমরা কেবল দেখি রাজনীতিকদের দর কষাকষির উপর নির্বাচন ঝুলে আছে। একটি যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠির সাথে জোট করে এই দেশে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করার ভাষণ দেয়া জাতির সাথেই তামাশা। হরতাল পেছাতে বিএনপিকে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের সাথে শলা করতে হয়, রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাতে জামায়াতের প্রতিনিধি সঙ্গে রাখতে হয়, বিএনপির জনসভায় জামায়াতকে আগে বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ দিতে হয়। বিএনপির সভামঞ্চে জামায়াত এমন ঘোষণা দেয়ারও দাম্ভিকতা দেখায়: ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইল জ্বলবে। ’
জামায়াতের উপস্থিতিতে সভামঞ্চে উঠে বিএনপি নেত্রী ঘোষণা দেন রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া হবে। গণতন্ত্রের নাম ভাঙ্গিয়ে গণতন্ত্রের হত্যাযজ্ঞ নিত্য চলছে এভাবেই। আশ্চর্যজনক হলো, কেউ মেরুদণ্ড সোজা করে এই দাবিটা তোলে না যে, সংলাপ হোক, তবে এই সংলাপ হবে জামায়াত বিবর্জিত। হতে পারে জামায়াত এখনো আইনত নিষিদ্ধ দল নয়, তবে ট্রাইব্যুনাল থেকে অদ্যাবধি যত পর্যবেক্ষণ উপস্থাপিত হয়েছে, সেসবের পর আমাদের জামায়াতকে বর্জন করা নৈতিকভাবে অপরিহার্য। আর তাই, বিএনপি নেত্রীকে জামায়াতের সাথে জোট বাঁধার দায় ঘাড়ে নিতেই হবে।
যদি ধারাবাহিকভাবে বিএনপি’র দাবিগুলো কাগজে লিখতে বলা হয়, তবে সুস্পষ্ট করে তালিকা পাওয়া যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাকি শেখ হাসিনাবিহীন নির্বাচন, নাকি তারেক জিয়ার নাম ভোটার তালিকায় সংযুক্তি, নাকি স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন-- –এই মূহুর্তের চরম নৈরাজ্যকর অবস্থানে যদি বিরোধী দলের নেতাদের তাদের দাবিগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তি সাজাতে বলা হয় তবে তারা খেই হারাবেন।
তত্ত্বাবধায়ক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, এইসব বাহানাকে জনগণের সামনে উপস্থাপন করে জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার্থে জিহাদে নেমেছে। বিএনপি সেই জিহাদের রাস্তা প্রশস্ত করে দিচ্ছে। বিগত পাঁচ বছরে সরকারের কঠোর সমালোচনা করার মত অবস্থানে পাওয়া যায়নি প্রধান বিরোধী দলকে। সরকারের বিপরীতে একটি বিরোধী দল মুখ্যত একটি ছায়া-সরকার। তারপরও জাতীয় স্বার্থবিরোধী, গণবিরোধী কোনো ইস্যুতে বিএনপি মাঠ নামতে পারে নি। সরকারের রাষ্ট্রীয় পরিচালনাগত বিচ্যুতিতে সচেতন নাগরিকেরাই সমালোচক, আন্দোলনকারীর ভূমিকা পালন করেছে। যদিও আওয়ামী লীগ এই পাঁচ বছরে নির্বাচনী ওয়াদার বাস্তবায়নে অনেকাংশে মনোযোগী হতে চেষ্টা করেছিল। আওয়ামী লীগ মেয়াদ সমাপ্তির পথে বিগত পাঁচ বছরের উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরে জনগনের মনে সরকারের প্রতি আস্থা বজায় রাখতে একটি চমৎকার উদ্যোগও নিয়েছিল---- উন্নয়ন বিলবোর্ড। তবে এই পরিকল্পনাটি অপরিকল্পিত হওয়ায় এবং অনেকের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বিলবোর্ডগুলো হারিয়ে গেল। জনগণের দ্বারস্থ হতে হলে যে উন্নয়নমুখি কাজ করা ছাড়া বিকল্প নেই --– রাজনৈতিক কূটচালে এই চর্চাটির অপমৃত্যু ঘটালো বিএনপি ও বিএনপিমনস্করা।
নির্বাচন আমাদের হলেও এর বাস্তবায়নে হরহামেশা চলছে বিদেশি দূতদের আনাগোনা। চলে রুদ্ধদ্বার বৈঠক। তবু জাতির সামনে ধোঁয়াশা আরো ঘনীভূত। প্রসঙ্গটা আন্তরিকতার। প্রশ্নটা উদ্দেশ্যের। এখানেও বহুজনে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আঙ্গুল তুলে বসেন। এর অর্থ বিরোধী দলীয় নেত্রী আন্তরিকতা প্রদর্শনের দায় থেকেও মুক্ত। অথচ একটি সুস্থ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজের নামটি অন্যভাবে লিখতে পারেন মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী। বারবার প্রধানমন্ত্রীকে না দেখিয়ে বেগম খালেদা জিয়া ফিরতি ফোনকলটি নিজেই করতে পারতেন। বলা ভাল যে, এখনো পারেন। সচিব পর্যায়ের বৈঠক নিয়ে বিএনপি কেন লুকোচুরি করেছে, এই রহস্যও জাতির সামনে উন্মোচন করা জরুরি। বিএনপি তাদের আন্তরিকতার আরো একটি স্বাক্ষর রাখতে পারতো সশস্ত্র বাহিনী দিবসে। যদি বিএনপি নেত্রী ব্যক্তিগত দাম্ভিকতা ত্যাগ করে, সত্যিকার অর্থে জনগণের স্বার্থে উপস্থিত হতেন সশস্ত্র বাহিনী দিবসে, তবে তিনি ‘দেশনেত্রী’ উপাধির যোগ্য হকদার হতেন। এমন নয় যে, সশস্ত্র বাহিনী দিবসে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিই সব কিছু সমাধা করে দিত। তবে সেদিন দু’নেত্রীর মুখোমুখি সৌজন্য সাক্ষ্যাৎ বরফ গলানোর উছিলা হতে পারত।
গত ৭ নভেম্বর বিরোধী দলীয় নেত্রীর জিয়ার মাজার পরিদর্শনের নিউজ করেছিল একটি অনলাইন পত্রিকা। অনলাইন প্রতিবেদনটির প্রথম পাঠক মন্তব্যটি ছিল – ‘বেগম জিয়া, আপনার উচিত গান পাউডারে পুড়ে যাওয়া মুনিরের তরতাজা কবরে গিয়ে শ্রদ্ধা জানানো। জীবন দিয়ে ছেলেটা আপনার হরতাল সফল করে গেছে’। শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে যাওয়ার মত মানবিক বিবেচক হতে পেরেছেন। বার্ন ইউনিটের দগ্ধ মানুষগুলো যখন গণতন্ত্রের প্রতি, রাজনীতিবিদদের প্রতি ঘৃণা বর্ষণ করেছিল, একজন রাজনীতিবিদ হওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রী যন্ত্রণাকাতর জনতার এই ঘৃণা বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। বিপরীতে বিএনপি নেত্রী যখন কেবল মুখরক্ষা করতে সামান্য দু:খপ্রকাশ করেন তখন জাতির প্রতি তার দায়িত্ববোধের করুণ চিত্রটি ভেসে ওঠে। অর্থনৈতিক স্থবিরতা এড়াতে ব্যবসায়ীরা স্মারকলিপি সমেত উপস্থিত হলে বিএনপি নেত্রীকে পাওয়া যায়নি। অথচ বিদেশি দূতেরা এলে খালেদা জিয়া সাক্ষ্যাৎ করেছেন পরদিনই। দেশের মানুষের স্বার্থের চেয়ে ক্ষমতার স্বার্থ বৃহৎ হয়ে উঠলেই এমনটা ঘটে।
মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আজ বুঝতেই হবে তাঁর অবস্থান একটি দায়িত্বশীল অবস্থান। বারবার সরকারের দায়িত্ব বলে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ হলো জল ঘোলা করা। সরকারের দায়িত্ব সরকারকে বুঝিয়ে দিতে দিতে বিরোধী দলের কাণ্ডজ্ঞান, দায়িত্ব শূন্যের কোঠায় নামিয়ে দেয়া হয়েছে। জামায়াতের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা বিরোধী দল পাড়ার উচ্ছন্নে যাওয়া মস্তান ছেলেটার মত আচরণ করছে। সন্ত্রাসী বাহিনীর শক্তিমত্তা ছাড়া জনসম্পৃক্ততার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই এই রাজনৈতিক দলটির মাঝে। দেশবাসীকে আশ্বাসে বাঁচিয়ে রাখার দায় থেকে বিরোধী দলীয় নেত্রী মুক্ত হবেন কিভাবে? যে জামায়াতের বিরুদ্ধে পুরো জাতি একতাবদ্ধ, সেই জামায়াতের সাথে জোট বাধার জবাবদিহিতা তিনি কী করে এড়াবেন? খালেদা জিয়ার কাছে এই অনুরোধ রাখতে হয়, যদি বিএনপি নির্বাচনমুখী দল হয়ে থাকে তবে সমঝোতার ফোনটি আপনিই করুন। কিন্তু তার আগে বিএনপিকে হতে হবে জামায়াত মুক্ত। যদি বিএনপি সমাধান চায়, যদি বিএনপি গণতন্ত্র চায়, তবে তা প্রমাণের দায় মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রীরই।
আইরিন সুলতানা: ব্লগার, কবি, কলামিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১৩