এ এক আশ্চর্য ডিসেম্বরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। বিজয়ের মাস বলে যত কথাই বলি না কেন আসলে বিপন্ন স্বদেশ ভালো নেই।
মানুষ কেন এভাবে বদলে গেল? কেন তাদের মন ও চেতনা থেকে দূরে চলে গেছে স্বাধীনতার মায়া? কাগুজে আবেগ আর স্মৃতিনির্ভর বিজয় কখনোই জয়ী হতে পারে না। আজ মানুষ যেসব সমস্যার মোকাবেলা করছে তার সাথে বিজয়ের কোনো মিল নেই। আমার এক নিকটাত্মীয় চাঁদপুরে থাকেন। বিধবা বোনটি ব্যাংকে যেতে পারছে না, টাকা তুলতেও পারছেন না। প্রতিবেশীর কাছ থেকে চাল ধার এনে ভাত রান্না করে চলতে হচ্ছে তাকে। তার বক্তব্য একটাই, ‘না পারলে ছেড়ে দিচ্ছে না কেন?’ পারা না পারার এই যে কঠিন সমীকরণ, এটাই এখন আমাদের জাতির সামনে চ্যালেঞ্জ। যারা ভাবছেন তারা মনে করছেন, অবরোধ দমন বা হরতাল নির্মূল করলেই সমাধান আসবে। তারা আসলে গভীরে যাচ্ছেন না। মূলত দেশশাসন আর দেশকে চেতনায় রাখা ভিন্ন বিষয়। বলা বাহুল্য এ বিষয়ে আমাদের অপছন্দের রাজনীতিই অনেক বেশি সার্থক। কেন সার্থক? সেটা না ভেবে বা তার বিশ্লেষণ ছাড়া আমাদের অতীত রোমন্থনে আসলে কোনো লাভ নেই।
গত কয়েক দশকে বড় হয়ে ওঠা প্রজন্মের একটা বড় অংশ স্বাধীনতা বোঝে না। তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখে নি। তাদের কাছে এগুলো বায়বীয়। আমাদের কাছে গান্ধী-জিন্নাহ যেমন, এদের কাছে বঙ্গবন্ধু আর জিয়াও তেমনি আবছা চরিত্র। সে দ্বন্দ্ব নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। কে বড় আর কে খাটো সে তর্কে তাদের আগ্রহ নেই। তারা চায় মোবাইলে চার্জ থাকবে, ক্রেডিট থাকবে, পকেটে টাকা থাকবে, ইন্টারনেট চলবে আর জীবন হবে ফান বা আনন্দময়। আমাদের বয়সী নেতারা সে সত্য মানেন নি বা বুঝতেই পারেন নি। তারা কুইনাইনের মত আদর্শ বটিকা খাওয়াতে চেয়েছেন। কাজ হয়নি।
অন্যদিকে ধর্ম বা পুঁজিব্যবসায়ীরা বসে থাকেনি, এ দুই সাংঘাতিক শক্তিশালী টনিক খাইয়ে তারা তাদের বলয় গড়ে তুলেছেন। ফলে হয় ধর্ম নয় টাকা-- এ দুইয়ের জোরে সব অপকর্ম বা বিরোধিতাই এক সময় হালে পানি পেয়ে যাচ্ছে। এদের নিয়ন্ত্রকরা জানেন মাফিয়াচক্র না হলে টেকা যাবে না। তাই সারা দেশে এমনকি বিদেশে ও নেট ওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন তারা, যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের মত সবর্জনীন বিষয়ও আজ বিতর্কিত।
আমাদের রাজনীতির বড় বিপদ এককেন্দ্রিক নেতাগিরি। এখানে কেউ কথা বলতে পারে না । কেউ কোনো মতও দিতে পারে না। হুকুমের দাসরা হুকুম মানতে মানতে কখন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন নিজেরাও জানেন না। যে কারণে নামজাদা-নামকরা নেতারা আজ ব্যর্থ। না পারেন সামাল দিতে, না কোনো কিছু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। বাংলাদেশের সার্বিক চেহারাটা তাই আজ এক ব্যাপক পরিবর্তনের মুখে। কেউ জানে না কি হতে যাচ্ছে। এই যে না জানা বা অনিশ্চয়তা তার ভেতরই মানুষের অনাস্থা বা নেগেটিভ মতটা বেড়ে ওঠে। আজকের শাসক দল এখন সে রোগে ভুগছে আর তার ছায়ায় বিরোধী দল কোনো কারণ ছাড়াই নিজের পথ করে নিতে পারছে। কোনো স্বাধীন দেশের নির্বাচন নিয়ে এত মাতামাতি আর বিদেশিদের আনাগোনা এক ধরনের লজ্জাই বটে।
আজকের ডিসেম্বরে আমাদের একটাই প্রশ্ন: ‘কি হতে যাচ্ছে?’ যেটাই ঘটুক না কেন আমাদের সত্য স্বীকার করতেই হবে। যদি বর্তমান সরকারের পতন হয় বা সরকারকে সরে যেতে হয় তা হলে নির্বাচনে তারা জিতবেন না। এটা এরশাদও জেনে গেছেন। সে-বেলায় যারা গদীতে আসবে তারা বিচার ও শাস্তি প্রক্রিয়া থামিয়ে দিতে পারেন। আস্তে আস্তে সে প্রক্রিয়া নিষ্ক্রিয় হয়ে অনেকে মুক্ত হবেন বা ছাড়া ও পেতে পারেন। অন্যদিকে প্রতিশোধের কারণে মুক্তিযোদ্ধা বা এ-জাতীয় চেতনার কেউ কেউ জেলে যাবেন শাস্তি ভোগ করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাতেই কি মুক্তি মিলবে? আমাদের দেশের রাজনীতিকরা একটা বিষয় বোঝে না। কারো ক্যান্সার হলে তাকে লাখ টাকা দামের পোশাক পরালেও সে বাঁচবে না। আমাদের সামাজিক ক্যান্সারের নাম দুর্নীতি আর রোগের নাম ধর্মীয় উন্মাদনা। এখানে মাঝামঝি বলে কিছু নেই।
আমার মনে হচ্ছে এ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ আর যাই হোক একাত্তরের চেতনায় থাকতে চাইছে না। এটা তার দোষ নয়। বহু ব্যবহারে ব্যক্তিগত কারণে ব্যবহৃত হতে-হতে-হতে মরচেপড়া চেতনা আর কাজ করতে চাইছে না। গান কবিতাপাঠ বা নাটক দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা যায় কিন্তু প্রাণ ফেরানো যায় না।
দেশ না বাঁচলে কোনো কিছুই কিছু নয়। সে বাঁচবেই। এত বছর পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া দেশটি আসলে কিভাবে বাঁচতে চায় সেটাই এখন দেখার বিষয়। প্রগতিবাদীরা যতই মন খারাপ করুন মানুষ পাল্টে গেছে। মুখ ও মুখোশেই তার প্রমাণ দেখছি, তবু ভালো থেকো বাংলাদেশ। আমরা তোমায় ভালোবাসি।
অজয় দাশগুপ্ত: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯,২০১৩