ঢাকা: আমার বেড়ে উঠার সময়টা ছিল অনেক সুন্দর আর অনেক অন্যরকম। দিনাজপুর শহরটা হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ,খৃষ্টান সব সম্প্রদায়ের জন্য একটা আদর্শ স্থান।
খ্রীষ্টান। তখন আমাদের উত্তাল সময়। ঈদ, পূজা, বড়দিন সবই ‘আমাদের’। আমাদের? ২১ ফেব্রুয়ারি সব সব আমাদের?
আমার হিন্দু বন্ধু মুক্তি। ওর একটা ফুটফুটে ভাই হল অন্নপ্রাশণের দিন আমি একটু অসুস্থ বলে যাওয়া হবে না মনে হচ্ছিল। মেসো মশাই চলে এলেন বাসায়। ‘চল, চল, তুই না গেলে বাবু’র মুখে ভাত তোলা যাবে?’ আমি চললাম মেসোর হাত ধরে।
তখন কলেজে পড়ার সময়। খ্রীষ্টান বন্ধু রিচার্ড। ওর বোনের বিয়ে। আমার একবারও মনে হয়নি অন্য বাড়ির অন্য সম্প্রদায়ের বন্ধুর বোনের বিয়ে। ওর বাবা আবার আমার জেঠা’র বন্ধু। চাচা মুসলিম সবার জন্য খাবারের আলাদা ব্যবস্থা করেছেন। আমি ভাবলাম সেখানেই আমারও স্থান। না, চাচা’র হুঙ্কার। ওতো আমাদের বাড়ির মেয়ে। ওর খাবার
আলাদা-কিন্তু তোরা সব বন্ধুরা একসাথে বসে খাবি।
কলেজে তখন অস্ত্র সমেত ছাত্র-রাজনীতির জোয়ার। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ক্লাস চলছে। মাঠে দেখলাম লাবু রিচার্ড প্রাণপনে দৌড়াচ্ছে। ওর পেছনে বিশালকার ছোড়া নিয়ে দৌড়াচ্ছে এক ছাত্র। মনে হল এই বুঝি মরে যাবে সদা হাস্যময় রিচার্ড। মনে হচ্ছিল ঐ ছোড়ার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি, বেঁচে থাক আমার বন্ধুটি। রিচার্ড বেঁচে গিয়েছিল কিন্তু অজয় বাঁচেনি। বুক থেকে গল গল করে রক্ত বের হচ্ছিল। আমরা হতবাক বিষন্ন পাথর। অজয় বাঁচার আকুতি নিয়ে হাত বাড়িয়েছিল পাথর বন্ধুদের দিকে।
বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর বাংলাদেশে তার হাওয়া এসে লেগেছিল। ধুমাধুম ভাঙ্গা হয়েছিল মন্দির। আমার বাবা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন লিফটে উঠছি তিনজন। আমি বাদে অন্য দুজন হাসপাতালের স্টাফ। একজন বললেন-‘কি যে অবস্থা। সারাক্ষণ গা ছম ছম করে। কি যে হবে দেশটার। ’আরেকজন বললেন-‘দ্যাখেন না সিঁদুর পড়ি না। শুধু টিপটাই। শাখা পলা সব খুলে রেখেছি। ’প্রথম জন বললেন-‘দিদি খুব সাবধানে রাতে আসা যাওয়া করবেন মাথায় ঢাকাঢুকা দিয়ে যাবেন। আমি নি:শব্দে লজ্জায় ঘৃণায়
হাহাকার করে উঠলাম। ’
লেখক: কাকলী প্রধান, সিনিয়র ফটোগ্রাফার, দৈনিক কালেরকণ্ঠ।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৩
সম্পাদনা: রাইসুল ইসলাম, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর (অ্যাক্ট.)