একটি দেশের সরকার সে দেশ নিয়ে কি নীতি নির্ধারণ করবে এটি যেমন তাদের নিজেদের ব্যাপার, ঠিক তেমনি দেশটির সংসদ কোন বিল আনবে বা কোন বিল পাস করবে সেটিও তাদের নিজস্ব বিষয়। তবে, সেটি অবশই তাদের নিজেদের দেশ সম্পর্কে হবে বলেই ধরে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হওয়ার পর একটি রায় কার্যকর হয়েছে। আর এই কার্যকর হয়ে যাওয়া রায়টি হচ্ছে কাদের মোল্লার ফাঁসি। কাদের মোল্লা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ জামায়াতের একজন সক্রিয় নেতা ছিলেন। তিনি এমন একটি দলের নেতা ছিলেন যে দলটি প্রকাশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী ছিলো এবং তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে এমন সব মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলো, যার তালিকা দিতে গেলে হয়তো লেখাটি আর শেষ করা সম্ভব হবে না।
রায় কার্যকর হওয়ার আগে অনেক নাটক আমরা দেখেছি- এর মাঝে বিভিন্ন দেশ, বিদেশি সংস্থা যেমন ছিলো তেমনি ছিলো এ দেশীয় কিছু মানুষ- যারা এ পুরো বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছিলো।
এ দেশের একজন এমপি তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখলেন, এই কাদের মোল্লা নাকি একাত্তরের সেই কাদের মোল্লা না! এছাড়া ইনিয়ে বিনিয়ে তিনি আরও অনেক যুক্তি হাজির করার চেষ্টা করলেন। তার এই লেখা বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কম চেষ্টা হয়নি।
তবে সব চাপ উপেক্ষা করেও বাংলাদেশ সরকার এই ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী কাদের মোল্লার রায় কার্যকর করতে সক্ষম হয়।
এই রায় কার্যকর হওয়ার পর দেখা গেলো, পাকিস্তান জামায়াত সে দেশে বিক্ষোভ শুরু করেছে। তারা কাদের মোল্লাকে অখণ্ড পাকিস্তানের একজন খাদেম হিসেবে স্লোগান দিচ্ছে। একটি দেশের কোন দল কি করলো এটি নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর কিছু নেই। তবে এর পর দেখা গেলো, সে দেশের একজন মন্ত্রী ও একজন নেতা বলেছেন, কাদের মোল্লাকে এভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ঠিক হয়নি। তিনি নাকি নির্দোষ!
এর সর্বশেষ সংস্করণ হিসেবে এ দেশে গোটা জাতি যখন বিজয় দিবস পালন করছে, তখন পাকিস্তান সংসদ কাদের মোল্লার জন্য শোক প্রস্তাব দিয়ে আনা বিলটি পাস করে। এ করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। সঙ্গে এও বলেছে, ‘কাদের মোল্লা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অখণ্ড পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন এবং তা তিনি নিজের মুখেই বলে গেছেন’। এ ছাড়া বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নাকি ‘ক্ষমা করা ও ভুলে যাওয়া নীতি’ গ্রহণ করা উচিত।
যদিও দু’একটি দল সে দেশের সংসদে এর বিরোধিতা করেছে তবে শেষ পর্যন্ত বিলটি কিন্তু সে দেশের সংসদে পাস হয়েছে।
অন্য একটি স্বাধীন দেশ কি নীতি গ্রহণ করবে সেটি বলে দেওয়ার পাকিস্তান কে- ঠিক মাথায় আসছে না।
আন্তর্জাতিকভাবেই এই দেশটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র এবং সন্ত্রাসীদের পুষে রাখার জন্য বিখ্যাত। নিশ্চয়ই সবার মনে আছে, সন্ত্রাসী ওসামা বিন লাদেনকে আর কোনো দেশে নয়, এই পাকিস্তানেই খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো। এই দেশটিতে মার্কিন বাহিনী এখন বিনা অনুমতিতেই যখন তখন বিমান হামলা করে সন্ত্রাসী নিধনের নামে। এমন একটি দেশের সংসদ এবং সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু অবশ্য আশা করা ঠিকও নয়।
তবে একটি দিক না বললেই নয়। এ দেশে যে এমপি বলেছিলেন- এই কাদের মোল্লা সেই কাদের মোল্লা নন। তিনি এখন পাকিস্তানের এই শোক প্রস্তাবের পর কি জবাব দেবেন? এর জবাব যদি তিনি বা তারা দিতে না পারেন তাহলে এই বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য দায় তাদেরই নিতে হবে, আর বিচারও তাদের পাওনা বলেই মনে হয়।
শুনেছি এর মাঝেই ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি হাইকমিশনারকে তলব করেছে সরকার। পাকিস্তান সরকার ১৯৭১ এর জন্য কখনো ক্ষমা চায়নি। এবার এই শোক প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে দেশটির দৃষ্টিভঙ্গীও পরিষ্কার হয়ে গেলো। আর এটি যখন তাদের সংসদে পাস হয়ে গেছে, তাই আমাদের উচিত এখন এ দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের বিচার ও ক্ষমার বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে পেশ করা।
আমিনুল ইসলাম: সহকারী অধ্যাপক, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, tutul_ruk@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৩