মাহবুব আলম, বাস চালক। প্রতিদিনের মতই যাত্রী নিয়ে ছুটছিলেন তাদের কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে।
কেউ হয়ত ভাবছিলেন আজ বাড়ি একটু তাড়াতাড়ি ফিরবেন, পরিবারের সবার সঙ্গে একটু সময় কাটাবেন। ব্যস্ততার ঢাকা নগরীতে কতইবা আর অবসর পাওয়া যায়! আপন মনেই হাসছিলেন হয়তবা! আবার পাশেই কেউ হয়ত আসন্ন পরীক্ষা চিন্তায় ব্যস্ত ছিলেন। কানে হেডফোন লাগিয়ে ভাঁজছিলেন নতুন কোন সুর। অনেকের অলক্ষ্যে কেউ আবার হয়ত স্বপ্ন দেখছিলেন ভবিষ্যতের। ভাল একটা চাকরি, ভাল একটা বাসা...
কিন্তু হঠাৎ একটি মুহূর্ত! শুধু একটি মুহূর্ত পাল্টে দিল সব হিসেব নিকেশ। ধ্বংস হল কারো স্বপ্ন, কারো সুখ, কারোবা জীবন। পেট্রোল বোমা নামক এক বিস্ফোরক ছিন্নভিন্ন করে দিল সমস্ত সুতো!
এভাবে প্রতিদিনই মৃত্যুও কোলে ঢলে পড়ছেন কোননা কোন মাহবুব আলম। যে কিশোরটি এত অল্প বয়সে জীবনযুদ্ধে নেমেছিল তাকেও হারতে হয়েছে পৈচাশিক যন্ত্রণায়। কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়া এ কিশোর তখনও বুঝতেই পারেনি কী ভয়ংকর এক দু:স্বপ্ন অপেক্ষা করছে তার জন্য।
একজন স্বামীর সামনে তার স্ত্রী, একজন বাবার সামনে তার সন্তান যখন জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান, তখনকার সেই অর্বণনীয় যন্ত্রণার মানে কী আমরা উপলব্ধি করতে পারি? পারি না।
আর পারি না বলেই আমরা ঘটনা জেনে প্রথমে একটু হা-হুতাশ করে আবার সবকিছু ভুলে যাই। এদিকে তখন আমাদের সরকার ও বিরোধীদল পরস্পরকে দোষারোপ করায় ব্যস্ত।
রাজনীতি যখন দেশের মানুষের রক্তে তার হাত রাঙিয়ে ফেলে তখন তাঁকে কি আর রাজনীতি বলা যায়? এ কেমনতর রাজনীতি? হরতাল-অবরোধের রাজনীতিতে এ পর্যন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়েছে অনেক মানুষ। আর তাতে নিহতও হয়েছে প্রায় ৪০ জনেরও বেশি। অথচ এই বীভৎসতা থামানোর উদ্যোগ নিচ্ছেনা কেউই। দুই দলের ক্রমাগত দাবা চালাচালিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে এসব সাধারণ জীবন। যাদের বেশিরভাগের স্বপ্ন হয়ত খুব বড় না, দুবেলা দু’মুঠো খেয়ে একটু শান্তিতে থাকা। কিন্তু সরকার বা বিরোধী দল যার কোনটিই নিশ্চিত করতে পারছে না। উপরন্তু মানুষগুলো ঘরে ফিরছে লাশ হয়ে। প্রতিদিন মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছেন এই আশঙ্কা নিয়ে যে সুস্থ দেহে, প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন কি না!
আমাদের রাজনীতিবিদরা প্রতিনিয়ত বলেই চলেছেন যে, তারা জনগণের জন্য কাজ করেন। এই কি তার প্রমাণ? ক্ষমতার লড়াইয়ে একে অন্যকে হারানোর চেষ্টার পাশে জনগণের জীবনের কোন মূল্য নেই? নাকি তারা বলবেন, কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়!
গৃহবধূ গীতা সরকারের কি দোষ ছিল? তিনি ভোট দিয়ে তাদের নিরাপত্তা তুলে দিয়েছিলেন সরকারের হাতে? আজ যখন তিনি তার সন্তানকে চোখের সামনে ঝলসে যেতে দেখেন আর নিজের যাওয়া দেহ নিয়ে গুমরে উঠে বলেন- ‘আমরা কোন অসুস্থ সরকার চাই না। আমরা খালেদারেও চিনি না, হাসিনার কাছেও যাই না....’ তখন সেই তীব্র ক্ষোভের আগুনে ঘৃণার আঁচটা কি তারা টের পান না?
উনি ঠিকই বলেছিলেন, আমরা ওনাদের তৈরি করেছি, ওনারা আমাদের তৈরি করেন নি। আর তার মাশুল দিচ্ছি আমরা এভাবে! কখনও পুড়ে, কখনও পঙ্গু হয়ে, কখনও জীবন দিয়ে।
কিশোর সাংবাদিক সুস্মিতা কিংবা ঢাকা কলেজের ছাত্র ওহিদুরের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার ভাব এমন যে এগুলো জনগণের প্রাপ্য। টগবগে এই প্রাণগুলোর জন্য না সরকার অনুতাপ করেন না বিরোধীদল। তারা শুধু পারেন গণমাধ্যমে বিবৃতি আর আশ্বাস দিতে। তারা কি একবারও ভাবেন যখন পরিবারের অন্ন যোগানদাতা একমাত্র ব্যক্তিটিকে মৃত্যুর মুখে ফেলে দেয়া মানে একটি পরিবারকেই ধ্বংস করে দেয়া? একজন সদস্যকে পঙ্গু করে দেয়া মানে ওই পরিবারের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া। তারা কী কখনও আসবেন এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য? হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ অনেকেই পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে কাতরাচ্ছেন। পুড়ে যাওয়া রোগীদের চিকিৎসা কতটা ব্যয়বহুল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ পর্যন্ত তারা কতজনের চিকিৎসার ভার নিয়েছেন? কতজন অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন? রোজ রোজ চলা এই ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করার কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন?
কার্যত এমন আমরা কিছুই এখনও দেখতে পাচ্ছি না। দেখছি শুধু কয়লা হওয়া কিছু শরীর। মনুষ্যত্ব বলে আদৌ কিছু আছে কিনা সেটা নিয়েও আজকাল সন্দেহ হয়। না হলে কীভাবে একটি মানুষ আরেকটি মানুষকে জীবন্ত ঝলসে দিতে পারে! শত কাকুতি মিনতি সত্ত্বেও এমনভাবে তাদের পুড়িয়ে দিচ্ছে যেন তারা মানুষ না, অন্য কিছু।
পশুর নাম যদি কিছু বলা হয় তবে তা পশুদেরই অপমান। একটা কুকুর যদি তার আপন স্তন্যপান করিয়ে ছোট্ট বানর শিশুকে নতুন জীবন দিতে পারে, সেখানে আমরা মানুষরা কোথায় নেমে গেছি তা ভাবতেও ঘৃণা হয়।
আমাদের দেশের কয়জন মানুষ সঠিক রাজনীতি বোঝেন? দেয়ালে পিঠ ঠেকে আজকাল অনেকেই হয়ত কিছু কিছু বুঝতে শুরু করেছেন। কিন্ত বলতে গেলে বেশির ভাগ মানুষ বেশি কিছু বোঝেন না। তারা যা বোঝেন তা হল দেশ আর দেশের মানুষকে ভাল রাখার জন্য একজন নেতা প্রয়োজন। যিনি তাদের সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে সর্বাবস্থায় শক্ত হাতে হাল ধরবেন। তাদেও প্রয়োজনে কাজ করবেন। সেই সঙ্গে একটি গঠনমূলক বিরোধীদল যারা সরকারের সমালোচনা করে দেশ ও দশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বিষয়টিকে অধরা স্বপ্ন বলেই মনে হয়। জীবন প্রদীপই যখন নিভে যায়, তখন সরকার কি আর বিরোধী দল কি, সবাইকে একই নীতিরই মনে হয়।
পত্রিকার পাতা কিংবা টেলিভিশন খুললেই আজকাল নি:শ্বাস ভারি হয়ে আসে। একটা প্রাণ গেলে কি হয়? কিছুই না। শুধু যার যায় বোঝে সে আর বোঝে তার পরিবার। এই শোকের কোন শান্ত্বনা থাকে না, কোন শেষও থাকে না। তরুণ ওহিদুর কত স্বপ্নই না দেখেছিলেন। বাবাকে ফিরে পাবেন, তার পরিবারে আবারও খুশির জোয়ার আসবে। কিছু স্বপ্ন সাধ সব কিছু নিঃশেষ হয়ে গেল কিছু হিংস্র হায়েনার কবলে পরে।
গণতন্ত্রের স্বার্থে নাকি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে বলা হয়েছে। সামান্যতম নীতিবোধ না থাকলে রাজনীতিবিদরা এটা নিয়েও যুক্ত দেন। আর ত্যাগ স্বীকারের নাম যদি নিরীহ মানুষ হত্যা হয়, তাহলে দেশের জন্য যারা কাজ করে চলেছেন তাদের লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাওয়ার কথা। এই যদি হয় দেশপ্রেম, তাহলে উভয়দলের সদস্যরা কেন এই ত্যাগ স্বীকার করছে না? সাধারণ মানুষ কেন বলি হচ্ছে এই নারকীয়তায়?
প্রশ্ন এখন এটাই। এদের কেউ জানে না কি তাদের দোষ! যাদের আগুনে দগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নেয়ার মত সামর্থ্য নেই। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দু’মুঠো খাবার যোগাড় করে। তারা কখনও কল্পনাও করেননি কিছু মানুষের ক্ষমতার মোহের আঁচ এসে লাগবে তাদের সাধাসিধে জীবনে।
আর কত হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ হলে সরকার ও বিরোধীদলের রাজনীতিবিদরা বুঝতে পারবেন যে এর অবসান দরকার? গীতা সরকার যা বলেছেন তা আমাদের দেশের জনগণের কথা। তাকে ধন্যবাদ যে তিনি নির্ভীকতার সঙ্গে চরম সত্যটি বলেছেন। তীব্র ক্ষোভের আগুনে জ্বলে ওঠা এই নারীর সঙ্গে আমারও বলতে চাই- আমার মানুষ, আমরা বাঁচতে চাই, আমরা এই অসুস্থ রাজনীতি আর চাই না।
সারা মনামী হোসেন: গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৩