গত বছর নভেম্বরে ইসলামাবাদে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোট ডি-৮-এর শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানাতে ঢাকায় আসেন পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানী খার। তার কয়েক ঘণ্টার সফরেই ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি আলোচনায় তুলে আনেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
কিন্তু জবাবে হিনা বলেন, দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পেছনের কথা ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
হিনা ঠিকই বলেছেন। সুসম্পর্কের জন্য পেছনের কথা ভুলেই যেতে হয়। কিন্তু তাহলে কি পৃথিবীর সব খুনিই খুন করে নিহতের পরিবারকে এই কথাই শুনিয়ে যাবে? খুনি যদি খুনের ব্যাপারে একটুও অনুতপ্ত না হয়, তবুও!
দুঃখিত হিনা রব্বানী। পাকিস্তানে কি হয় জানি না। বাংলাদেশে এ ধরনের সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে আগ্রহী লোকের সংখ্যা হয়তো খুবই কম।
গত বছরই এ বিষয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। সেখানে আমার ছোটবেলার একটা বাস্তব অভিজ্ঞতার উল্লেখ করেছিলাম। গল্পটি ছিলো এরকম-
২০০১। কলেজে পড়ি। সিলেট শহরে সাইবার ক্যাফে ধারণাটা সবে পরিচিত হতে শুরু করেছে। এক ঘণ্টা ২০ টাকা হারে চুটিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করার অফার দিলো এমনই এক ক্যাফে। ইন্টারনেটের আইডিয়াটা এতো লোভনীয় লাগতো যে, কলেজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে হলেও মাঝেমাঝেই বন্ধুবান্ধব মিলে চলে যেতাম সাইবার ক্যাফেতে।
কাজ তো তেমন ছিলো না। আর ইন্টারনেটের যে স্পিড ছিলো, তাতে কয়েকটা পেজ ঘুরতেই সময় শেষের ঘণ্টা বেজে যেতো। এমনই এক কলেজ পালানোর দিনে ইয়াহু চ্যাটে কথা হচ্ছিলো ইসলামাবাদের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীর সঙ্গে।
রাজনীতির মারপ্যাঁচ বোঝার মতো বুদ্ধি মাথায় তখনও ঢোকে নি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কি জিনিস, এর ইতিহাসটা তো জানাই ছিলো। তাই একথা ওকথার পর জিজ্ঞেস করে বসলাম, ১৯৭১ সালে তোমাদের পাকসেনারা যে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারলো, মা-বোনদের ধর্ষণ করলো, এ বিষয়ে তোমার মন্তব্য কি?
উত্তর যা এলো, তা ছিলো আমার ধারণারও বাইরে।
এক যুগ আগের কথা হলেও পরিস্কার মনে আছে, মেয়েটি বলেছিলো- তোমরা যা করেছো, তাতে এই শাস্তি তোমাদের প্রাপ্য।
কি এমন অপরাধ করেছিলাম আমরা?
ইসলামের সঙ্গে বেঈমানি করে পাকিস্তান ভেঙেছো।
একটা মেয়ে কিভাবে অন্য মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনাকে সমর্থন করতে পারে, তা আমার মাথায় তখনও ঢোকেনি।
‘ধন্যবাদ, তোমার ক্ষেত্রে ঘটনাটা ঘটলে বুঝতে’- বলে ক্যাফে থেকে বের হয়ে এসেছিলাম।
৪২ বছর পরেও যে বাংলাদেশ সম্পর্কে পাকিস্তানের অবস্থান একটুও বদলায়নি তা বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ঘটনায় প্রমাণিত।
১৯৭৪-এর জুনে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার অন্যতম কারিগর জুলফিকার আলী ভুট্টো আসেন বাংলাদেশ সফরে। সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিতেও যান তিনি। কিন্তু তিনি স্মৃতিসৌধে যান গলফ খেলার পোশাক পরে, যা ছিলো জাতির জন্য ভয়ংকর অপমানকর।
সফরে ’৭১ নিয়ে ভুল স্বীকার বা ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা, এ নিয়ে কোন বক্তব্যই ছিলো না তার।
এরপর ১৯৮৫ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক এবং ২০০২ সালে আরেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফও আসেন বাংলাদেশে। তারাও যথারীতি ফুল দেন জাতীয় স্মৃতিসৌধে। এবার পাওয়া যায় বক্তব্য। তারা বলেন, “তোমাদের বীরেরা আমাদেরও বীর”, এবং “পাকিস্তানের জনগণও ’৭১-এর ঘটনায় সমব্যথী”।
কিন্তু এসব উক্তিকে স্রেফ ‘গরু মেরে জুতা দান’-এর মতো রাজনৈতিক স্টান্টবাজি বলেই ধরে নিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। আর বাঙালি যে ভুল ধারণা করেনি, তা প্রমাণ করলো পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ।
যে জাতীয় পরিষদ ১৯৭০-এর নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করা সত্ত্বেও ক্ষমতা দিতে চায়নি, যেই জাতীয় পরিষদ যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রতিবাদে শোক ও নিন্দা জানিয়েছে। নিন্দা জানানোর জন্য বেছে নেয়া হয়েছে চমৎকার একটি দিন—১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের বিজয় দিবস।
আরো স্পর্ধা দেখিয়ে তারা বাংলাদেশকে হুমকিও দিয়েছে, ‘পুরোনো ক্ষত জাগিয়ে তোলা ঠিক হবে না’ বলে।
‘খেলা আর রাজনীতি এক নয়’, ‘খেলার সঙ্গে রাজনীতি না মেশানোই ভালো’ জাতীয় কথা যারা বলেন, তাদের মুখে জুতা মেরে পাক ক্রিকেট দলের একসময়ের বিখ্যাত পেসার, বর্তমানে তেহরিক-ই-ইনসাফের নেতা ইমরান খানও বলেছেন ‘কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো ছিলো ভুল’।
এতে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী আনন্দে আত্মহারা হলেও, বাংলাদেশের পাকিস্তানপ্রেমী ক্রিকেট দর্শকরা কতটুকু আঘাত পাবেন, তা সহজেই অনুমেয়।
পাকিস্তান বিষয়ে বরাবর মুখে কঠোর অবস্থান দেখিয়ে এলেও দ্বিপাক্ষিক বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ নিয়ে সুরাহায় আসতে কখনও আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখায়নি বাংলাদেশ সরকার।
গত বছর হিনা রব্বানীর ‘পেছনের কথা ভুলে যাওয়া’ সংক্রান্ত বক্তব্যের পর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের বক্তব্য জানতে চাইলে তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস বলেছিলেন, ‘এ বিষয়ে কথা বলতে হিনা বাংলাদেশে আসেন নি’।
এবারও পাক হাইকমিশনার আফ্রাসিয়াব মেহদী হাশমী কোরেশীকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে এনে কঠিন ধমক দিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু বারবারই কি গোড়ায় গলদ রয়েই যাচ্ছে না?
এবারও ‘ক্ষমা চাওয়া’ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়’। কিন্তু কিভাবে?
গণহত্যাকারী পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য না করে পরিস্থিতি এমন অবস্থায় পৌছেছে যে, এখন তারা সেই গণহত্যার পক্ষে সাফাইও গাচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের উচিত এখন চারটি পয়েন্টে পাকিস্তানকে বাধ্য করা। এগুলো হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা, উত্তরসূরি রাষ্ট্র হিসেবে সম্পদের ন্যায্য হিস্যা প্রদান, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবর্তন এবং যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ প্রদান।
যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর মতো আচিরেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টিও জোরেসোরেই তোলা উচিত বাংলাদেশের।
কূটনীতিককে গ্রেপ্তার ইস্যুতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে উত্তেজনা, তাতে ভারত সরকারের সমস্ত গৃহীত পদক্ষেপকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে বিরোধী দল বিজেপি। নিজের দেশের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে তারা সবাই একাট্টা।
আশার কথা, বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও পাকিস্তানি নিন্দা প্রস্তাবের সমালোচনা করে বলেছে, ‘সরকারের আরও আগেই এর প্রতিবাদ জানানো উচিত ছিলো’।
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করায় নিন্দা প্রস্তাব এবং ’৭১-এ সংগঠিত অপরাধকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশকে হুমকি এটাই প্রমাণ করে- পাকিস্তান মোটেও তার অপরাধের জন্য অনুতপ্ত নয়। যুদ্ধাপরাধকে সমর্থন করায় পাকিস্তান নিজেই পরিণত হয়েছে একটা যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্রে।
পাকিস্তানের উদ্দেশে বলার মতো কথা একটাই। যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্র পাকিস্তান, নিন্দা নয়, ক্ষমা চান।
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ: ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৩