ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ইমরান খান ও দি রয়েল বেঙ্গল টাইগার

অজয় দাশগুপ্ত, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৩
ইমরান খান ও দি রয়েল বেঙ্গল টাইগার

বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কথা বললে অনেকেই তা হেসে উড়িয়ে দিতেন। কেউ কেউ মনে করেন- এটা মুক্তিযুদ্ধ প্রেমীদের কল্পনা বিলাস, কারো কারো মতে- এদের মাথা খারাপ বা নিজেদের দোষ বা ব্যর্থতা ঢাকতেই এ সব আজগুবি কথার অবতারণা।



এখন আপনারা সবাই আসলে কি দেখছেন?  সারা বিশ্বে পিল পিল করে বেরিয়ে আসা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধীদের দেখেও কি বলবেন আমরা মিথ্যে বলতাম? আজ দুনিয়ার এত মানবিকতাপ্রেমী আর মানবাধিকার বাহিনী দেখে কি বুঝতে পারছেন কেমন ছিল একাত্তর? কত ত্যাগ আর ঐক্য থাকাতে আমরা স্বাধীনতা ও বিজয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছি?

৪২ বছর পর আমরা আবারো যা দেখছি তাতে এটাই স্পষ্ট- শত্রু কখনো চির মিত্র হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে দু’টি দেশ আদাজল খেয়ে আমাদের বিরুদ্ধে লেগেছিল সেই পাকিস্তান আর আমেরিকা আজ নানা ইস্যুতে এক ভাষায় কথা বলছে। এটা যে যোগাযোগ করে বা একত্রিত হয়ে তারপর বলছে তা কিন্তু নয়।

পাকিস্তান ও আমেরিকার আগের সে পীরিত নেই। বরং নানা কারণে উভয়ের ভেতর ফাটল বড় হচ্ছে। ভারতের আর্থিক বিকাশ, উন্নতি আর বিশ্বময় নিজের জায়গা দৃঢ করবার কারণে আমেরিকার সাধ্য নেই তাকে এড়িয়ে চলে।

একাত্তরের ভারত আর আজকের ভারত যেমন এক নয়, সেকালের আমেরিকা আর আজকের আমেরিকাও এক নয়। আমেরিকার বেলায় ঘটেছে অধ:পতন। তার অর্থনীতি বা সমাজ স্হির হলেও আগের মত আগুয়ান নয়। তার ব্যাংক ফেইল পড়ে। তার দেশে প্রাকৃতিক বিপযর্য়ে মানুষের বাড়ি-ঘর লুট হয়। ব্ল্যাক আউট হলে নারী ধর্ষিত হয়। স্কুলে গোলাগুলি বা খুন-জখমও প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনা।

সোভিয়েত পতনের ভেতর দিয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্ন ভেঙে গেলেও তা একশ’ ভাগ সফল কিছুও নয়। দেশে দেশে তার কর্তৃত্ব প্রশ্নময়। আজকের দুনিয়ায় আমেরিকার মত ঘৃণ্য দ্বিতীয় কোন দেশ নেই। আমরা অবশ্যই মনে রাখছি- এ প্রক্রিয়া বা মন্দলাগার সঙ্গে সে দেশের জনগণের তেমন কোন সম্পর্ক নেই। তাঁরা বরং নিজেদের দেশের এই আধিপত্য বিস্তার বা সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধেই এক পায়ে খাড়া। তারপরও আমেরিকার ফরেন পলিসি বা আন্তর্জাতিক মনোভাব বরাবরই আমাদের দেশের মত দেশের বিরুদ্ধে। তারা দুনিয়ার কোথাও মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে থাকেনি, থাকতে পারেনি। একাত্তরে আমাদের দেশে সংগঠিত ভয়াবহ হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠন, পোড়া মাটি নীতির পরও তারা পাকিস্তানিদের মদত দিয়ে গেছে।

ডিসেম্বরে বিজয়ের ঊষালগ্নে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠাতেও দ্বিধা করেনি নিক্সন ও কিসিঞ্জার প্রশাসন। তারপরও আমরা জিতেছি।

আমার ধারণা, আমেরিকার কর্তা বদল  হলেও সে দেশের সরকারি কর্তারা তা ভোলেনি। নথি পত্রে খোদিত ইতিহাস বা তথ্য থেকে তারা এটা নিশ্চিত জানে, একাত্তরে তাদের গালে চড় মেরেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ফলে আজ তারা নিয়ম পাল্টে যত বন্ধু বা মিত্র হবার ভান করুক না কেন,ভেতরে ভেতরে আক্রোশ রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ যখন তার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার আর শাস্তি দেয়ার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে তখন তাদের অতীত জেগে উঠেছে। জেগে উঠেছে পুরনো আক্রোশ। যারা শেখ হাসিনার নিন্দায় পঞমুখ, তার বিরুদ্ধে না বললে যাদের ভাত হজম হয় না, তারা কি এখন দেখতে পাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যাপারে আপোসহীন? আমেরিকার জন কেরী, মনকি বান কি মুনের কথাও কানে তোলেন নি তিনি। না তোলার যে সাহস বা যোগ্যতা তাও কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ভেতর থেকেই পাওয়া। সে সময় আরো দুর্বল, আরো ক্লীশ, দেশহীন, সহায়-সম্বলহীন আমরা যদি বিজয়ী হতে পারি আজ কেন পারবো না? আজ আমাদের কিছু আছে বলেই তারা আমাদের কাউন্ট করছে। আর এই যা কিছু তা কারো দয়া বা দান নয়। বাঙালি মেধা, শ্রম ও নিজের রক্তে তা অর্জন করেছে। ঠিক যে কারণে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বা ভারতকে সে এড়াতে পারছে না, আমাদের বেলায়ও তাই।

আমরা এখন অনেক দেশের ঘুম হারাম করে এগিয়ে চলা জাতি। তাই আমেরিকা এখন আর ধমক দিতে পারে না। স্বাধীনতার পর পর অসহায়ত্ব আর দুর্বলতার সুযোগে যে সব শাস্তি দিতে পারতো তাও এখন অচল। তাই অনুরোধ জানায়, ফোনে আবদার করে ....

মানবাধিকারের নামে খুনিদের প্রতি ভালোবাসা আপ্লুত আমেরিকার পাশাপাশি পাকিস্তানও আবার জেগে উঠেছে। তাদের ভাষা যেমন অপরিশীলিত- আচরণ বা বক্তব্যও সবর্দাই  আক্রমণাত্মক।

সে দেশের জামায়াত এখনো কাদের মোল্লাকে দলের মানুষ মনে করে। সেটা বলতেও লজ্জ্বা নেই তাদের। আরো একধাপ এগিয়ে আমাদের দেশ আক্রমণের জন্য সেনাবাহিনীকে উস্কে দেয়ার মত বক্তব্য দিয়েছে তারা। মানবাধিকারের পান্ডারা এটাকে কিভাবে দেখেন?

আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম দেশে পাক আক্রমণ শানানোর উস্কানি কি শান্তির ললিত বাণী? সে দেশের সংসদে শোক প্রস্তাব নেয়ার  পাশাপাশি ইমরান খানের মত ক্রিকেটারের ভাষ্যে মনে হয়েছে, পাকিরা কোনদিনও সভ্য হবে না। তাদের আর্ন্তজাতিক আচরণ কখনোই ভালো কিছু নয়। বস্তুত পৃথিবীর চোখে ভয়ংকর এক দেশ পাকিস্তানের নেতারাও সে দেশের চেহারার মতই ভয়ংকর। এখানকার অর্থাৎ সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পাকিস্তানি অধ্যাপক আমাকে বলছিলেন, কতটা অপমানিত আর শংকিত তাঁরা। তাদের দেশের ওপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ও আরো কিছু এয়ারলাইনস যাত্রীদের জানালার কাঁচ নামিয়ে দিতে বাধ্য করে। এক ফোঁটা আলোও যেন বাইরে না যায়। তাদের দৃঢ বিশ্বাস, আলো দেখলেই নীচ থেকে গুলি বা আগ্নেয়াস্ত্র ছুঁড়বে তালেবানেরা। পাকিস্তানের আর্ন্তজাতিক ইমেজ আজ এমন-ই ভঙ্গুর।

সে দেশের মানুষ আসেন  আমাদের ছবক দিতে। আমাদের দেশটি আজ তাদের ফেলে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। এদেশে যত ঝামেলা আর দাঙ্গা-হাঙ্গামা তার জন্য দায়ী এদের এজেন্ট ও ফেলে যাওয়া দালালরা। এরাই আমাদের দেশকে পেছনে টেনে রাখছে। ছলে-বলে কৌশলে প্রয়োজনে অর্থ-অস্ত্র যখন যা দরকার তা দিয়ে আমাদের দেশটিকে অশান্ত করে রাখার মানুষগুলো এখন বুঝতে পারছে দিন শেষ।

ক্যামোফ্লেজ বা আজগুবি তত্ত্বে চিরকাল বোকা বানানো যায় না। তাছাড়া তাদের এজেন্টরা সবাই এখন বুড়ো বা গতায়ু। তাদের মাথার ওপর ঝুলছে হত্যা, ধর্ষণ আর লুণ্ঠনের মত অভিযোগের নিশান। এদের জন্য বাংলাদেশের তারুণ্যে না আছে ভালোবাসা, না কোন সহমর্মিতা। তাই আজ তারা বেপরোয়া। শাস্তি যখন সুনিশ্চিত তখন আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের মাধ্যমে বাঁচবার সর্বশেষ প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানের এই ঔদ্ধত্যের জবাব দেবে আমাদের দেশপ্রেমিক জনগণ। সেটা তার এবারের বিজয় দিবসেই দেখিয়ে দিয়েছেন। লাখো তারুণ্য পতাকায় ইতিহাস গড়ার পাশাপাশি চলমান সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের দ্রোহ ও ঘৃণা জানিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে-এ দেশ এ জাতি পরাভব মানে না।

ইমরান খান, বান কি মুন বা জন কেরী কেউই কেউ নয়। আসলে মানুষ-ই সব। তারা যা বলবেন যা করবেন সেটাই ইতিহাস। ইমরানের উচিৎ নিজের দেশের ময়লা সাফ করা। তাদের নিজেদের আপদ দূর করা। যে দেশে মানুষ সারা দিন ভয়ে ভয়ে বাঁচে- সে দেশের নেতার ফালতু হুংকার শোনার সময় নেই তাদের। বরং তাদের আমরা ধন্যবাদ জানাই-আমাদের চোখের কুয়াশা বা পর্দা সরিয়ে দেয়ার জন্য। কারণ, কিছুতেই ঐক্যবদ্ধ হতে পারছিলাম না আমরা। আমাদের ভুলে যাওয়া শৌর্য আর হারিয়ে যাওয়া বিক্রম ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে সাহায্যের জন্য তাদের ধন্যবাদ দেব না, বলব-আপনারা আপনাদের কাজ করেছেন। বাঘকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, সে আসলে অপপ্রচারে বেড়াল বলে ভ্রম করলেও তার পরিচয় রয়েল বেঙ্গল টাইগার। একাত্তরে তার গর্জনে ধরাশায়ীরা এবার কি করবেন সেটাই বরং ভাবনার ব্যাপার।

অজয় দাশগুপ্ত: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।