আমাদের দেশের প্রায় সব রাজনীতিক জিরো থেকে হিরো বনে যান। এই জিরো হলো অর্থনৈতিক জিরো।
এরপর সময় গড়ায়, দাপট বাড়ে। বাড়তে থাকে ক্ষমতা। আর ক্ষমতা যত বাড়তে থাকে, পকেট তত ভরতে থাকে। পকেট উপচে পড়া অর্থ দিয়ে একেকজন অঢেল অর্থের মালিক বনে যান। কপর্দকশূন্য ব্যক্তিটিও রাজনীতির পরশ পাথরে হয়ে ওঠেন কোটিপতি। সামাজিক জীবনে তো বটেই, পরিবার জীবনেও তারা কোটি টাকার পতি হয়ে অহংকার বাড়ান পত্নীদের। এমনকি তাদের ড্রাইভার-পিয়নরাও পেয়ে যান লাখপতি তকমা।
কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারসূত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতার মালিকানা পেয়ে যান। সঙ্গে পেয়ে যান আরাম-আয়েসে অর্থকড়ি উপার্জনের লাইসেন্স।
সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন, আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা নিজের জন্য ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াই করেন। কখনোই দেশের জন্য, মানুষের স্বার্থে লড়েন না। বক্তব্য-বক্তৃতায় যা বলেন, তা বিশ্বাস করেন না। তারা সবাই পাকা অভিনেতা, কপটাশ্রয়ী রাজনীতি ব্যবসায়ী।
‘রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই’ এর মতো অনেক সুবিধাবাদী ডায়ালগ নিজেদের সুবিধার্থে তারাই চালু করেছেন। তারা সকালে এক কথা বলেন, লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে বিকেলেই বেমালুম পাল্টে ফেলেন সে কথা। কখনো যুদ্ধাপরাধী, কখনো স্বৈরাচার সঙ্গী করে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার নীতিহীন নীতি দেখে আমরা এখন বিস্মিত হতেও ভুলে গেছি।
জনগণের জন্য আলগা দরদ দেখিয়ে ৫ বছরের জন্য টাকা কামানোর ধান্দাবাজির লাইসেন্স নেওয়াই থাকে তাদের মূল উদ্দেশ্য। এসব নেতা, যাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য স্লিপ পাঠিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন বসে থেকেও ২ মিনিটের সাক্ষাৎ লাভ দুষ্কর হয়ে পড়ে, তারাই ভোটের সময় স্যুট-টাই ছেড়ে ভাঁজ ছাড়া পুরনো পাঞ্জাবি পরে গ্রাম-গঞ্জে ভোট ভিক্ষা করেন। গ্রামের হাটে বসে ভাঙা কাপে চা খান। কি দারুণ দক্ষতায় মিশে যান আমজনতার ভিড়ে।
দূরে শুল্কমুক্ত পাজেরো দাঁড় করিয়ে, গ্রামের ধুলিময় রাস্তায় পায়ে হেঁটে নিজেদের জনতার কাতারের মানুষ বলে প্রমাণের প্রানান্তকর চেষ্টায় হাস্যকরভাবে নিজেদের নিয়োজিত করেন তারা। যদিও দলীয় চামচারা পাশে পাশে ছুটে এসব মহান(!) নেতার মাথায় ছাতাটা মেলে ধরেন ঠিক ঠিক।
আর নারী রাজনীতিকদের চলন-বলন, মানুষ ভজানোর কৌশল তো আরো হাস্যকর। নির্বাচনের আগে ওমরা করার সে কি প্রতিযোগিতা! দেখতে ভালো লাগুক আর না লাগুক, কড়া মেকাপে সংসদের আসনে বসে বসে অকথ্য ভাষায় ঝগড়া করা নারী রাজনীতিকরা হঠাৎ করেই মাথায় কাপড় তোলেন। ফুল স্লিভ ব্লাউজের সঙ্গে শরীরে চাপান সুতি শাড়ি। আহাহা, কতই না পরহেজগার। ভোটারদের ধোকা দেওয়ার জন্য ভেক ধরতে এদের আসলেই কোনো জুড়ি নেই। ভোট শেষ, তো তুই কে আর মুই কে।
তো এতসব অভিনয়, কলা কৌশলের মূলেই হলো অর্থনীতি। অর্থ্যাৎ রাজনীতির মূলেই আছে অর্থনীতি। অর্থের লোভেই ক্ষমতার লোভ। প্রায় সবাই ক্ষমতায় আসে লুটেপুটে খেতে। লুণ্ঠিত দেশে রাজনীতির খোলসে আরো লুণ্ঠন চালাতে।
আর জনসেবার নামে জনগণের পকেট কাটা এই লুটপাটের টাকা কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সুইস ব্যাংকে জমা করেন। নিজেদের বউ-ছেলেমেয়ের নামে বিদেশে বাড়ি কেনেন। তাদের হাই কোয়ালিটি এডুকেশনের বন্দোবস্ত করেন। ব্যস একবার এমপি হতে পারলেই, সারাজীবন নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা পাক্কা।
অথচ এই মহান নেতারা মনে হয় ক্ষমতার নোংরা লড়াইয়ে একটা জিনিস একেবারেই দেখতে পারছেন না। আর তা হলো, এদের দেশোদ্ধারের আলগা ঢঙের কারণে আজ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে দেশের অর্থনীতি। অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় অচল হতে চলেছে। সাধারণ জনগণের জীবিকা বন্ধ হবার যোগাড়। উত্পাদন যা হয়েছে তা অবরোধের কারণে বাজারে আসতে পারছে না। যাও অল্প কিছু আসছে, দাম নাগালের বাইরে।
যারা বিদেশে থেকে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রেমিটেন্স পাঠিয়ে আপনাদের আরাম-আয়েসের সুবন্দোবস্ত করে দিচ্ছে, তাতেও তো বিড়ম্বনা বাড়াচ্ছে আপনাদের মহান রাজনৈতিক কর্মসূচি। দেশে রেমিটেন্স পাঠানো যাচ্ছে না। এভাবে রেমিটেন্স কমতে থাকলে শুধু যে আমরা সাধারণেরা কেবল গ্যাঁড়াকলে পড়বো তা ভেবে নিশ্চিন্ত হবেন না যেনো, আপনারাও যে চরম বিপদে পড়বেন তা হলফ করেই বলা হয়।
দেশে ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের ব্যবসাপাতি সব বন্ধ হলে, আমাদের যেমন কষ্ট হবে, আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে আপনাদেরও।
গত অর্থবছরে যেখানে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ, সেখানে চলতি বছর তা কমে হবে সাড়ে ৫ শতাংশ। এভাবে চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা আন্দাজ করতে অর্থনীতিতে পিএইচডি করার দরকার পড়ে না।
ক্ষমতায় যেতে একদল অবরোধের পর অবরোধ দিয়ে যাচ্ছে, আরেক দল আজীবন ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করছে। আহা কি চমত্কার। দেশটাকে এইভাবে মারামারি করে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিলে, ক্ষমতা নিয়ে আর কি করবেন?
এত যে মানুষ পুড়ছে, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে- এসব নিয়ে দেশপ্রেমিকরা একেবারেই চুপচাপ। সরকার দলের একজন তো পাল্টা হুমকি দিয়েই বসলেন যে, তারাও নাকি অ্যাকশনে যাবেন। তো প্রশ্ন হলো, আপনি কি নিজে অ্যাকশনে যাবেন, নাকি ঘরের ভেতর পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাঝে আইফোন দিয়ে নিরীহ কর্মীদের নির্দেশ দেবেন?
নির্মম সত্য হলো, দুই দলের প্রত্যেকেই সুবিধাবাদী, সুবিধাভোগী। কেউ দেশের কল্যাণ, জনগণের সুবিধা নিয়ে ভাবেন না। যদি ভাবতেন তবে ৪২ বছরে তিলে তিলে গড়া অর্থনৈতিক অবস্থা এভাবে বিপর্যয়ের হুমকিতে পড়তো না।
আর কতোকাল এসব ক্ষমতালিপ্সু ধূর্ত রাজনীতিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলে বার বার নিরীহ জনগণকে প্রতারিত করবে? উন্নয়ন যখন শূন্যের কোঠায় নামবে, রাজকোষাগারে যখন অর্থ থাকবে না, তখন হাড্ডিসার জনগণের পক্ষ থেকে এসব বিড়ালতপস্বী দেশপ্রেমিকের উদ্দেশে জিজ্ঞাসা, টাকাই যদি না থাকে তো ক্ষমতা দিয়ে করবেনটা কি?
ড. জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৩