২৬ শে মার্চ, ২০১৩। সময় সকাল ১০টা।
কালবিলম্ব না করে নিচে নেমে এলাম। ৫টা বাড়ির পরেই দেখলাম, মহাসমারোহে বিবাহের রান্না হচ্ছে। গরুর মাংস কেটে হাঁড়িতে ফেলানো হচ্ছে। পাশেই একদল লোক পেঁয়াজ, মরিচ কাটছে। ৩ জন ১৫-১৬ বছর বয়সী ছেলে কাজগুলো তদারকি করছে, আর গানের তালে তালে মাথা, হাত-পা দোলাচ্ছে। হাবেভাবে মনে হয়, যেকোনো সময় কোমর দোলানো শুরু হয়ে যাবে।
কোমর দোলানো শুরুর আগেই জিজ্ঞেস করলাম, এই তোরা (এলাকার ছোটভাই, তাই “তুই” সম্বোধন) হিন্দি গান শুনছিস কেন? আজ যে স্বাধীনতা দিবস, জানিস না?’ ওরা আমার কথায় খুব একটা অবাক হল বলে মনে হলো না।
একজন বলে উঠলো, ‘ভাইয়া, সারাবছর তো এসব গান শুনি। আজ শুনতে গেলে কি হারাম?’
হালাল-হারাম তর্ক মানেই ধর্মীয় ব্যাপার-স্যাপার এবং আমার ওই মুহূর্তে ধর্মীয় আলাপ-আলোচনা করার একদমই ইচ্ছা ছিল না। ওদের বললাম, ‘আজকের দিনের সম্মানটা অন্তুত তোরা রাখ। বাংলা গান শোন। অনেক সুন্দর সুন্দর বাংলা গান আছে, ওগুলো বাজা। ’
বাসায় আসতে আসতে ব্যাপারটা আমাকে ভাবাতে থাকল। আসলেই তো, ছেলেগুলো ভুল কিছু তো বলেনি। সারা বছর ওরা যে ধরনের গান শুনে অভ্যস্ত, একদিনের জন্য ‘বাঙালি’ হতে হয়তো ওরা ভুলে যায়। থাক, ওদেরকে আর দোষ দিয়ে কী লাভ?
মুক্তবাজারের এই যুগে শিল্প-সংস্কৃতিকে একটা পণ্য হিসেবেই গন্য করা হয়। প্রতিটি দেশ তার শিল্প-সংস্কৃতিকে, কৃষ্টি– ঐতিহ্যকে অন্যদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরে। প্রতিটি দেশের শিল্প-সংস্কৃতি, কৃষ্টি– ঐতিহ্য স্বতন্ত্রমণ্ডিত, আপন আলোয় ভাস্বর।
এগুলোই হল একটি দেশ, একটি জাতির আসল পরিচয়। পৃথিবী নামক বিশাল এই পরিবারের প্রতিটি দেশরুপি সদস্যই আলাদা, আলাদা তাদের কথাবার্তায়, চাল-চলনে, পোশাক-আশাকে।
এগুলো যে কেবল নাচ-গান দিয়েই প্রকাশ পায়, তা নয়। একেবারে দৈনন্দিন জীবন-যাপনের প্রক্রিয়াতেও এগুলোর সুস্পষ্ট স্বকীয়তা থাকে, যা একটি দেশের শিল্প-সংস্কৃতি, কৃষ্টি– ঐতিহ্যকে ধারণ-লালন করে থাকে।
শুধু তাই নয়, একটি দেশের মধ্যে অনেক জাতিগোষ্ঠী থাকতে পারে, তাদের সংস্কৃতি-কৃষ্টি– ঐতিহ্য দেশের মূল সংস্কৃতির সঙ্গে নাও মিলতে পারে।
তবে এক্ষেত্রে একটি ব্যাপার না বললেই নয়। পণ্যের বাজারের বিস্তৃতির স্বাভাবিক নিয়মের মতই সংস্কৃতির বাজার বিস্তৃতি করতে সব দেশই চায়। প্রত্যেকেই চায়, তাদের সংস্কৃতিটা অন্যদেশের মানুষ গ্রহণ করুক, পালন করুক। পণ্য কেনাবেচার মতই একটি দেশ তার শিল্প-সংস্কৃতি, কৃষ্টি–ঐতিহ্য অন্যদেশের কাছে এমনভাবেই বিক্রয় করে, যাতে করে ওই ব্যাপারটাতে সে অভ্যস্ত হয় এবং ঠিক এখান থেকেই সংস্কৃতি আগ্রাসনের আবির্ভাব।
প্রভাবশালী দেশের সংস্কৃতি স্বাভাবিকভাবেই বেশি আগ্রাসী হবে। তাদের সংস্কৃতি অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোর উপর চাপাতে তারা সদা সচেষ্ট হবে। আবার, একটি দেশের মূল সংস্কৃতি চাইবে ভূখণ্ডের উপ-সংস্কৃতিগুলোর উপর দখল রাখতে।
বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি, কৃষ্টি–ঐতিহ্য যেমন স্বকীয়তায় ভাস্বর, তেমনি অনেক সমৃদ্ধশালী।
গানের কথাই ধরা যাক। এতোরকম গান রয়েছে যার সবগুলো রপ্ত করা একজন শিল্পীর কাছে অনেক কঠিন। আবার গবেষকদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় অনেক হারানো গান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, যা কালের গর্ভে এককালে বিলীন হয়ে গিয়েছিল।
প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ স্যার পরিচালিত শেষ চলচিত্র ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’ তে আমরা ‘ঘেঁটুগান’ নামক একটি প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়া গানের শাখা সম্পর্কে জানতে পারি।
সুতরাং, আমরা আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি, কৃষ্টি– ঐতিহ্য নিয়ে অনেক গর্বই করতে পারি। আমাদের ভাষা আন্দোলনের কথাতো সারা বিশ্ববাসী জানে এবং ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে সাড়ম্বরে, যথাযথ সম্মানের সঙ্গে পালন করা হয়। সুতরাং এরকম একটি দেশের সংস্কৃতিতে বৈদেশিক সংস্কৃতির আগ্রাসন কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গেই আমাদেরকে এই বৈদেশিক সংস্কৃতির আগ্রাসন দেখতে হচ্ছে। সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রই আজ এটার দ্বারা আক্রান্ত। দেশের জনপ্রিয় গায়ক-গায়িকারা আজ মঞ্চে উঠে হিন্দি গান গাইছেন মহানন্দে। দেশীয় চলচিত্রগুলো তো হিন্দি ছবির দুর্বল অনুকরণ।
শিশুরা এখন বাংলা ভালোভাবে শেখার আগেই হিন্দি শিখে যাচ্ছে ‘ডোরেমন’ ও ‘নিনজা হাতুরি’ নামক কার্টুনগুলোর ‘কল্যাণে’।
বাসায় বাসায় এখন হিন্দি সিরিয়ালগুলো নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। ধিশুম-ধিশুম, ধুরুম-ধারুম শব্দ (অনেকটা বাংলা ছবির নায়কদের মারকাটারি দৃশ্যের মত) করে নায়ক-নায়িকা যখন পর্দাতে আবির্ভূত হন, তখন তাদের মুখে সে কি উত্তেজনা, তা আর বলতে, যে উত্তেজনার কাছে মেসি-রোনালদো কিংবা শচিন-স্টেইনের রণহুংকার একেবারেই ম্রিয়মান। তাদের অদ্ভুতুড়ে সাজসজ্জার নির্মম শিকার আমাদের তরুণ সমাজ। এসব হিন্দি সিরিয়ালগুলোর মূল উপজীব্যই হল পরকীয়া, বউ-শ্বাশুড়ির যুদ্ধ, অবিশ্বাস, বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক-যা দ্বারা প্রতিনিয়তই আমাদের সমাজ-ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নৈতিক অবক্ষয় এমন পর্যায়ে চলে গেছে, যার জন্যে আমরা নিজেদের স্বকীয়তা পুরোপুরি হারাতে বসেছি। যার প্রমাণ, এই মহান বিজয় দিবসের মাসেও এফ.এম. রেডিওগুলোতে চলছে হিন্দিগান।
কিছু অর্বাচীনদের হাতে আজ আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি, কৃষ্টি-ঐতিহ্য বিলীন হতে বসেছে। যাদের বাঙালি শিল্প-সংস্কৃতি, কৃষ্টি–ঐতিহ্য সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান নেই, তারাই আজ এগুলোর প্রচারে নেমেছে। জনপ্রিয় শিল্পী ফাহমিদা নবীর ফেসবুকের ক্ষুব্ধ স্ট্যাটাস কিংবা আমার এই লেখার কথাবার্তা পুরোপুরিই অর্থহীন হয়ে যাবে, যদি এই ব্যাপারে সমাজের সবাই সচেতন না হোন।
শিল্প-সংস্কৃতি, কৃষ্টি–ঐতিহ্য আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। আমরা যেমন কারো দয়া-দাক্ষিণ্যে এই দেশ লাভ করিনি, তেমনি এই সমৃদ্ধ শিল্প-সংস্কৃতি, কৃষ্টি–ঐতিহ্যও আমাদের পরিচয়, আমাদের রক্তে মিশে আছে, যা কারো কাছ থেকে ধার করা নয়। শিল্প-সংস্কৃতি, কৃষ্টি–ঐতিহ্যর বিনিময় অবশ্যই হবে, তবে সেটা হবে ভারসাম্যপূর্ণ। আমরা আমাদেরটা যথাযথ বিনিময় করতে হবে।
অন্যের ভালোটা আমরা অবশ্যই দেখবো, তবে সেটার অন্ধ অনুকরণ আমরা করবো না। আমাদের এটা দেখা উচিৎ, যে হিন্দি ভারতের অন্যতম প্রধান ভাষা হলেও, রাজ্যভিত্তিক আলাদা ভাষা রয়েছে। শুধু তাই নয়, অনেক জাতিগোষ্ঠী, যেমন, তামিল, তেলেগু-এসব ভাষার চলচিত্রশিল্প পর্যন্ত রয়েছে এবং এসব চলচিত্র বলিউডি ছবির মত বিশাল বাজেটের, জনপ্রিয় অভিনেতাদের সঙ্গে রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে।
সুতরাং, আমাদের এই মানসিকতা নিয়ে শিল্প-সংস্কৃতি, কৃষ্টি–ঐতিহ্য বিনিময় করতে হবে, যাতে করে আমরা আমাদেরটা যথাযথভাবে তাদের সামনে প্রতিযোগিতামূলকভাবেই তুলে ধরতে পারি। এজন্য দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দরকার সচেতনতা। আর সচেতন হলেই অর্বাচীনদের কবল থেকে উদ্ধার পাবে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি, কৃষ্টি–ঐতিহ্য। একমাত্র সচেতন নাগরিকরাই পারবেন নিজেদের শিল্প-সংস্কৃতি, কৃষ্টি–ঐতিহ্যকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে এবং তাহলেই বিদেশি আগ্রাসন থেকে নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষা করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৪০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৩