১.
গত সপ্তাহটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সপ্তাহ। একাত্তরের এই সপ্তাহে বাংলাদেশকে মুক্ত করার শেষ যুদ্ধটি শুরু হয়েছে।
সেই হত্যাকারীদের বিচার করে বিচারের রায় হয়েছে। প্রথম রায় কার্যকর হয়েছে সেই একই সপ্তাহে, ডিসম্বরের ১২ তারিখ। আমি ৪২ বছর ধরে এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। শুধু আমি নই, আমার মতো স্বজন হারানো অসংখ্য মানুষ অপেক্ষা করেছিলো। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষরা অপেক্ষা করেছিলো, আর অপেক্ষা করছিলো এদেশের নতুন প্রজন্ম। আমাদের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম। আমরা মুক্তিযুদ্ধকে তীব্র আবেগ দিয়ে অনুভব করি। আমি কখনো কল্পনা করিনি এদেশের নতুন প্রজন্মও মুক্তিযুদ্ধকে ঠিক আমাদের মতোই তীব্রভাবে অনুভব করবে। তাদের জন্মের আগে ঘটে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের সেই অবর্ণনীয় কষ্ট আর অকল্পনীয় আনন্দ তারা এত তীব্রভাবে অনুভব করতে পারে সেটি আমাদের জন্যে এক অবিশ্বাস্য স্বপ্নপূরণ।
গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কথা দিয়েছিলো তাদের নির্বাচিত করলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে। এদেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম তাদের কথা বিশ্বাস করে বিপুল ভোটে তাদের নির্বাচিত করে এনেছিলো। সরকার তাদের কথা রেখেছে। ট্রাইব্যুনাল তৈরি করে বিচার করে বিচারের রায় দিয়ে রায় কার্যকর করতে শুরু করেছে। এই সরকারের কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। তাদের প্রতি আমার অসীম কৃতজ্ঞতা, দেশকে গ্লানিমুক্ত করার জন্য। এতদিন যখন এদেশের শিশুরা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করতো, যারা এই দেশ চায়নি, যারা এই দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে তারা কেমন করে এই দেশে এখনো স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়? কেমন করে রাজনীতি করে, মন্ত্রী হয়? যে পতাকাটি ধ্বংস করার জন্যে হত্যাকাণ্ড করেছে সেই পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়? আমি কখনো তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। মাথা নিচু করে থেকেছি। আর আমার মাথা নিচু করে থাকতে হবে না, কেউ আর আমাকে এই প্রশ্ন করবে না। সেই প্রশ্নের উত্তর তারা পেয়ে গেছে, সত্যি কথা বলতে কী সেই প্রশ্নের জবাব তারাই আমাদের উপহার দিয়েছে।
২.
আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে এই বিচারের কাজটি যতোটুকু সহজ ছিল, এতদিন পর সেটি আর সহজ থাকেনি। যুদ্ধাপরাধীর দল ক্যান্সারের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, মিলিটারি শাসনের আড়ালে শক্তি সঞ্চয় করেছে, অর্থ উপার্জন করেছে, সেই অর্থ দিয়ে অপপ্রচার করেছে, দেশে বিদেশে বন্ধু খুঁজে বের করেছে। হুবহু তাদের মুখের কথাগুলো আমরা বিদেশি গণমাধ্যমে শুনতে পেয়েছি। জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর দেশগুলো আমাদের সরকারকে শুধু মুখের কথা বলে বাধা দেয়নি, চোখ রাঙিয়ে দিয়েছে। ১৯৭১ সালে যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল এত বছর পরও তারা আবার সেই পাকিস্থানের পদলেহীদের পক্ষে! আমাদের অনেক সৌভাগ্য এই প্রচণ্ড চাপেও আমাদের সরকার দিশেহারা হয়নি, যুদ্ধপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর করেছে। নির্বাচন নিয়ে আমাদের দেশের সব পেশাদার বুদ্ধিজীবীদের এখন প্রথম কাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এক হাত নিয়ে নেওয়া। সেটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু যখন হরতাল অবরোধ কার্যকর করার জন্য পেট্রল বোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়, ট্রেন লাইন উপড়ে ট্রেনকে লাইনচ্যুত করা হয়, বাস ট্রাকের যাত্রীসহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়, রাস্তা কেটে এলাকা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, তখনও এই বুদ্ধিজীবী, পত্রিকার সম্পাদকরা তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ‘অদূরদর্শিতা’কে দায়ী করেন। তখন আমি একটা ধন্ধের মধ্যে পড়ে যাই।
এই কাজটি করে এদেশের বড় পত্রিকার বড় বড় সম্পাদকরা যে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলোকে এক ধরনের নৈতিক সমর্থন দিয়ে ফেলেছে সেটি তারা একবারও বুঝতে পারছে না? যে ভয়ংকর তাণ্ডব দেখে তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কথা সেটা দেখে তারা এই সরকারের ব্যর্থতার অকাট্য প্রমাণ পেয়ে উল্লসিত হচ্ছেন। এটি কেমন করে সম্ভব? আমি পেশাদার বুদ্ধিজীবী বাজারে আমার সত্য ও মিথ্যার মাঝখানে কিংবা ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝখানে নিরপেক্ষ থাকার কোনো চাপ নেই। তাই আমার যে কথাটি বলার ইচ্ছা করে সোজাসুজি বলতে পারি। নির্বাচন নিয়ে কী হবে সেটা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নিষ্পত্তি করুক। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর না করার জন্য আমেরিকার পরাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির হুমকিকে তোয়াক্কা না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রায় কার্যকর করার জন্য দেশের মানুষের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সেই প্রতিজ্ঞাটি বাস্তবায়ন করেছেন সেজন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা, তাঁর প্রতি অভিনন্দন। তার বাবা বঙ্গবন্ধু আজ যদি বেঁচে থাকতেন নিশ্চই তার মেয়ের বুকের পাটা দেখে খুশি হতেন।
৩.
১৯৭১ সালের পর আমি কখনো পাকিস্তানের কোনো জিনিস হাত দিয়ে স্পর্শ করিনি। অনেক টাকা বেঁচে যাবে জেনেও যে প্লেন পাকিস্তানের মাটি স্পর্শ করবে আমি কোনোদিন সে প্লেনে উঠিনি। পাকিস্তানের ওপর দিয়ে যখন কোনো প্লেনে উড়ে যাই, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই দেশটির ভূমি সীমার বাইরে না যাই ততক্ষণ নিজেকে অশুচি মনে হয়। পাকিস্তান দল যত ভালো ক্রিকেট খেলা খেলুক না কেন আমি তাদের কোনো খেলা দেখি না (ষাটের দশকে টোকিও অলিম্পিকে স্বর্ণ বিজয়ী পাকিস্তান হকি টিমের একজন প্রাক্তন খেলোয়াড় পাকিস্তান মিলিটারি অফিসার হিসেবে আমার বাবাকে ৭১-এ হত্যা করেছিলো বলে আমি জানি। )
কেউ কেউ আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে ইতিহাসের একটা বিশেষ সময়ে একটা বিশেষ গোষ্ঠীর কাজকর্মের জন্য সারা জীবন একটা দেশের সব প্রজন্মকে দায়ী করা যায় না। কথাটি নিশ্চয়ই সত্যি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। একাত্তরে আমি আমার নিজের চোখে পাকিস্তান নামের এই দেশটির মিলিটারির যে নৃসংশতা, বর্বরতা দেখেছি সেটি থেকে আমার মুক্তি নেই। দেশটি যদি নিজের এই নৃশংশতার দোষ স্বীকার করে নতজানু হয়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাইতো তাহলে হয়তো আমার বুকের মধ্যে ধিকি ধিকি হয়ে জ্বলতে থাকা আগুনের উত্তাপ একটি কমানো যেত। তারা সেটা করেনি, আমার বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা আগুনের উত্তাপও কমেনি।
আমি যে রূপ দেখে অভ্যস্ত, দীর্ঘদিন পর এই দেশটির ব্যথা আমাদের নতুন প্রজন্ম নতুন করে দেখার সুযোগ পেয়েছে। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার বিচারের রায় কার্যকর করার পর প্রথমে তাদের একজন মন্ত্রী প্রতিবাদ করেছে, তারপর তাদের পার্লামেন্ট থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব নিয়েছে। নিন্দা প্রস্তাবের সময় আলোচনার বিষয়বস্তু অত্যন্ত চমকপ্রদ ছিল। তারা জোর গলায় বলেছে কাদের মোল্লা হচ্ছেন একজন ‘সাচ্চা পাকিস্তানি’। একাত্তরে সাচ্চা পাকিস্তানি থাকার জন্যেই তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। শাহবাগের তরুণ ছেলেমেয়েরা দিনের পর দিন এই কথাটি বলে স্লোগান দিয়েছে, ‘জামায়াতে ইসলাম, মেড ইন পাকিস্তান’, যাদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল জামায়াতে ইসলাম একাত্তরে এই দেশে কী করেছিল, এখন তাদের কারো ভেতরে কী আর কোনো সন্দেহ আছে?
পাকিস্তান থেকে বক্তব্য দেওয়ার সময় তারা ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছে একাত্তরে “ঢাকা পতন” হওয়ার এতদিন পর সেই পুরানো “ক্ষত” কথাটি নিয়েও আমার গুরুতর আপত্তি আছে, এটি আমার জন্যে ক্ষত নয়, এটি পাকিস্তানের জন্যে “ক্ষত”- শুধু ক্ষত নয় এটি হচ্ছে দগদগে ঘা, চল্লিশ বছরে সেই ঘা শুকায়নি, শত বৎসরেও সেই ঘা শুকাবে না। পৃথিবীর ইতিহাসে পাকিস্তানকে পরাজয়ের এই দগদগে ঘা নিয়ে আজীবন বেঁচে থাকতে হবে।
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা এবং সবশেষে পরাজয়ের এই দগদগে ঘা তাদের অবশ্যই লুকিয়ে রাখতে হবে, কিন্তু আমাদের কেন সেটি লুকিয়ে রাখতে হবে? ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের সেই বিজয় দিবস আমাদের ক্ষত নয়, সেটি আমাদের গৌরব, আমাদের অহংকার। আমরা শত সহস্রবার সেটি দেখতে চাই। তাই প্রত্যেক বছর এই বিজয় দিবস আমাদের কাছে আগের চাইতেও বেশি উদ্দীপনা নিয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসে।
পাকিস্তানের সাথে আমরা কোনো যোগাযোগ নেই। যদি থাকতো তাহলে অবশ্যই আমি তাদের বিছু উপদেশ দিতাম। আমি তাদের বলতাম, তোমরা তোমাদের দগদগে ক্ষত দেখতে চাও না, খুব ভালো কথা, তোমরা চোখ বন্ধ করে থেকো। আমরা কি করবো সেটি নিয়ে ধৃষ্টতা দেখাতে এসো না। ১৯৭১ সালে এই দেশ থেকে তোমাদের বিতাড়ণ করে আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি, অনেক বিষয়ে আমরা সারা পৃথিবীর মডেল। একটু ধৈর্য ধর- যখন দেখবো আমরা ঠিক ঠিকভাবে যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে রায় রায় কার্যকর করে সারা পৃথিবীকে দেখাবো কীভাবে সেটি করা যায়, তখন সেটিও সারা পৃথিবীর একটা মডেল হয়ে যাবে। আপাতত তোমরা নিজেদের নিয়ে মাথা ঘামাও। মিলিটারির বি-টিম হয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যা করছে সেখান থেকে বের হতে পার কি না দেখো। লেখাপড়া করতে চাইলে মেয়েদের মাথায় গুলি যেন করতে না পারে সেটা খেয়াল করো। সারা পৃথিবীর সন্ত্রাস রপ্তানি করার যে সুনামটুকু কুড়িয়েছো সেই সুনাম থেকে মুক্ত হতে পারো কি না দেখো।
পাকিস্তানের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। যদি থাকতো তাহলে এই তালিকাটি আমি আরও দীর্ঘ করে দিতাম।
কাদের মোল্লার পক্ষে বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে যে নিন্দা প্রস্তাবটি নিয়েছে সেটি আমার কাছে এই রাষ্ট্রটির সাথে মানানসই একটি কাজ বলে মনে হয়েছে। এদেশে তাদের যে অনুচররা আছে তাদের চেহারাটি মনে হয় দেশে ভালোভাবে উন্মোচন করা হয়েছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম এর নামে ভয়ানকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। আমি ঠিক এধরনের প্রতিক্রিয়াই আশা করেছিলাম। তারা আমাকে নিরাশ করেনি।
৪.
১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লক্ষ মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে আমি বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছিলাম। সৃষ্টিকর্তা আমার গলায় কোনো সুর দেয়নি, আমার মাঝে মাঝে সেজন্য খুব দুঃখ হয়। আমার মনে হয়, যদি আমার গলায় একটু সুর থাকতো তাহলে “আমার সোনার বাংলা” গানটি আমি না জানি কত সুন্দর করে গাইতে পারতাম! যত বেসুরো গলাতেই গাই না কেনো, এই গানের চরণগুলো উচ্চারণ করার সময় আমার চোখ ভিজে আসে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেসুরো গলায় আমি যখন গানটি গাইছিলাম তখন একটি একটি করে চরণ গাওয়া হচ্ছিলো আর আমার মনে হচ্ছিলো, আহা আরও একটি লাইন শেষ হয়ে গেলো। আমার মনে হচ্ছিলো আহা যদি অনন্তকাল এই গানটি গাওয়া যেতো! যদি কোনোদিন এই গানটি শেষ না হতো!
জাতীয় সঙ্গীত শেষ হওয়ার পর সাবধানে আমি আমার চোখ মুছেছি। আমাদের প্রজন্মের কাছে এটিতো শুধু একটি সঙ্গীত নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ব, এটি আমাদের দুঃখ-কষ্ট-বেদনা। আমাদের আনন্দ, আমাদের উল্লাস।
আমার পাশে কমবয়সী একটি মেয়ে দাঁড়িয়েছিলো। জাতীয় সঙ্গীত শেষ হওয়ার পর আমাকে বললো, স্যার জানেন যতবার আমি ‘আমার সোনার বাংলা’ গান গাই আমার চোখে পানি আসে।
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাদের নতুন প্রজন্ম কেমন করে আমাদের সব স্বপ্ন, আমাদরে সব ভালোবাসা, সব মমতাকে এমনভাবে গ্রহণ করতে পারলো?
বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৩