ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বর্জন ও গর্জনে জেগে ওঠা বাংলাদেশ ভুল করো না

অজয় দাশগুপ্ত, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৩
বর্জন ও গর্জনে জেগে ওঠা বাংলাদেশ ভুল করো না ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম/ফাইল ফটো

এক)
বাংলাদেশের তারুণ্য পাকিস্তানি পণ্য বর্জনের ডাক দিয়ে মাঠে নেমেছে। গত সতের বছর যে দেশে বসবাস করছি তার পুরোটাই বহুজাতিক।

এ দেশে না এলে আমি এত দেশের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ পেতাম না। পৃথিবীর হেন দেশ নেই, যে দেশের মানুষ এখানে থাকেন না।

উত্তর কোরিয়া বা কিউবার মত একা নি:সঙ্গ দেশের মানুষও থাকেন এ দেশে। দু’এক জন হলেও তাদের সঙ্গে দেখা হবার সুযোগ ঘটেছে আমার। বলাবাহুল্য পাকিস্তানিরাও আছেন এখানে। আমার পরিচিত দু’এক জন পাকিস্তানিকে আমি কিছুতেই মন্দ মানুষ বলতে পারবো না।

কামরান মীর্জা নামে এক তরুণ পাকিস্তানি চাকরি সূ্ত্রে পরিচিত, তাদের একটি বড় পেট্রোল স্টেশনও আছে সিডনিতে। এক দুপুরে গিন্নীকে নিয়ে যাচ্ছিলাম এক পারিবারিক দাওয়াতে। তেল ভরে টাকা দিতে গিয়ে দেখি কামরান বসে আছেন কাউন্টারে। বেরিয়ে এসে গলাগলি করার ফাঁকে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন ডোনাট নামের এক বাক্স মিষ্টি। নাছোড়বান্দা কামরানের কাছ থেকে এই উপহার না নিয়ে বেরিয়ে আসার উপায় ছিল না।

সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান মোস্তফা কামাল। যতদিন সেখানে কাজ করতাম বিকেল হলেই এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আড্ডা আর কফি পানে অনেক সময় কেটেছে আমাদের। কখন যে তিনি কফির টাকা শোধ করে দিতেন টেরও পেতাম না।

পাকিস্তানি খ্রিস্ট্রান তরুণী ইরাম জোসেফ। তিনিও আমার এক সময়ের সহকর্মী। বাড়িতে বানানো কেক আর মিষ্টি খাইয়ে আমার শর্করার অসুখে অসামান্য অবদান রাখা ইরামকে ভোলা অসম্ভব।

মাইক্রো লেভেলে এত ভালো আর বন্ধুভাবাপন্ন পাকিস্তানিদের পণ্য বর্জনের আহ্বান খুব একটা সহজ নয় আমার কাছে।

দুই)
পাকিস্তানিদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে বন্ধুত্ব বা ভাব হয়ে গেলেও সামষ্টিকভাবে চলা যায় না। এটা আমার কথা নয়। এ বাস্তবতা এখন দুনিয়ার। এরও দুটো কারণ। প্রথমত, তাদের জঙ্গিপনা। দ্বিতীয়ত, তারা আচার-আচরণ ও ব্যবহারে সভ্যতা বিরোধী। বাংলাদেশে জন্মলগ্নে জুলফিকার আলী ভুট্টোর মত পাশ্চাত্য ডিগ্রিধারী জমিদার নন্দনের আস্ফালনের কথা মনে করুন। জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে কাগজ কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলার মত অসভ্যতা করতেও তার বিবেকে বাধ সাধেনি। এটাই যদি চরিত্র হয় তবে তা বজায় রাখা আর বন্ধুকে বন্ধু, শত্রুকে শত্রু ভাবাই তো আদর্শ- সেটাও করতে পারেনা পাকিস্তান। এই ভুট্টোই সিমলা চুক্তির নামে ভারতীয়দের সঙ্গে অসম চুক্তি করে নিজের নাকে খৎ দিতে গেলেন পরের বছর। তাও আবার কন্যা বেনজীরকে সঙ্গে নিয়ে। কন্যাকে সঙ্গ নিয়ে যাওয়ার কারণ ছিল ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে পরিচিত করানো, তার কাছ থেকে কিছু শিখে আসা। যাঁর নেতৃত্বের কাছে পরাভূত হয়েছিল কথিত অপরাজেয় পাকবাহিনী।

ভণ্ডামী আর কাকে বলে! আবার এই পাকিস্তানিরাই তাকে গলায় রশি ঝুলিয়ে হত্যা করতে বিলম্ব করে নি।

কাদের মোল্লার ফাঁসির পর আমি তাদের কাছে প্রশ্ন রাখি, ভুট্টোর ফাঁসি জায়েজ হলে কাদেরের কেন নয়? কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে তো গণহত্যার অভিযোগ, ছিল কবি হত্যা, লুণ্ঠন আর ধর্ষণের অভিযোগও। তোমাদের নিজেদের বেলায় যা জায়েজ আমাদের বেলায় তা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে লজ্জিত হও না তোমরা?

না, লজ্জা বলে কোন বিষয় তাদের অভিধানে নেই। থাকবে কি ভাবে? এ দেশের খেলোয়াড়রা চ্যাম্পিয়ন হতে না পেরে রৌপ্য পদক পায়ে ঝুলিয়ে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন থেকে বহিষ্কৃত হয়। কমনওয়েলথ গেমস থেকে নাম কাটা যায় তাদের। হিংসা আর মারামারির কারণে সে দেশে আক্রান্ত হয় তাদের পরম মিত্র দেশ শ্রীলংকার খেলোয়াড়রা। এই শ্রীলংকাই একাত্তরে পাকিদের যুদ্ধজাহাজে তেল ভরার সুযোগ দিয়ে বাঙালি নিধন ত্বরান্বিত করেছিল। তাদেরও রেহাই দেয়নি পাকস্তানি বর্বরতা। যে আমেরিকার টাকা আর অস্ত্রে পাকিস্তানের যুদ্ধংদেহী ভাব আজ তারাই তাদের জানী দুশমন। আগে বলা হতো, আমেরিকা বন্ধু হলে তার কোন শত্রুর প্রয়োজন হয় না। আর এখন বলা হয় পাকিস্তান সঙ্গে থাকলে বোমা বানাতে হয় না, সে নিজেই ফুটতে শুরু করে।

তিন
এমন বাস্তবতার পরও ইমরান খান, পাক সংসদ, পাকিস্তানিরা যখন আমাদের নিজস্ব ব্যাপারে নাক গলায়, আমাদের হেদায়েত করতে আসে- তখন জবাব দেয়াটাই তো সমীচীন।

একদা পাক ভারতের ধর্মীয় রাজনীতি আমাদের একদেশে থাকতে বাধ্য করেছিল বলে কেউ আমাদের মাথা কিনে নেয় নি। তাদের বেলায়ও সেটা সত্য। তারাও একদা ভারতের অংশ ছিল। তাই বলে কি ভারতের ব্যাপারে কথা বলতে পারে? পারে না।

তাছাড়া যখন কোন দেশ বা জাতি নিজের বাহুবলে এগিয়ে যায় তখন তাকে সমীহ করতে হয়। আজ আমরা ততটা না এগুলেও যতদূর এগিয়েছি তাতে পাকিস্তানিদের ভয় বা তোয়াক্কা করার কারণ নেই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একঘরে এককেন্দ্রিক পাকিস্তান মূলত ভয় আর বিপদের উৎসভূমি। আমরা আমাদের দেশটিকে সে জাতীয় ভয়ভীতি ও অপসম্ভাবনা থেকে বাঁচাতে চাই বলেই রাজাকার নামধারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে নেমেছি। বাস্তবে এদের পাশে দাঁড়িয়ে পাকিস্তান আবারো প্রমাণ করলো তারা হত্যা, খুন ও অপরাধের ছায়াসঙ্গী এবং তাদের এই অবস্হান জীবনেও শোধরাবার নয়।

চার
বর্জনের কথায় ফিরে আসি। এটাকে যারা রাজনীতির পুঁজি করছেন আমি তাদের দলে নই। এটা একটা প্রতীকী ব্যাপার। পাকিস্তানি দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে বা তাদের সঙ্গে মারামারি করতে হবে, ব্যাপার এমনটা নয়। আমরা সভ্য ও আধুনিক জাতি। আমাদের কি আছে কি নাই তারচেয়ে বড় কথা আমরা ইতিহাসে উজ্জ্বল। আমাদের আছে উদার সংস্কৃতি। ইতিহাস ও সংস্কৃতিই আমাদেরকে তাদের কাছ থেকে পৃথক করেছে।

আমাদের সংখ্যাগুরু মানুষের ধর্মবিশ্বাস যেমন অটুট তেমনি অটুট তার অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ। এত উস্কানি এত ঝামেলা আর জঙ্গিত্বের পরও তাই তারা দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধাতে পারছে না। ফলে পণ্য বর্জনের ভেতর যে প্রতিবাদ আর প্রতীকী বর্জন সেটাই যেন মুখ্য হয়ে ওঠে।

বদলাতে হবে আমাদের চরিত্র। এখনো যারা পাকিস্তানের ক্রিকেট টিমকে সমর্থনের নামে গালে মুখে তাদের পতাকা এঁকে মাঠে যান, তাদের গাল বা মুখ কি বর্জন করব আমরা? না কেটে নিতে পারবো? কি হবে সে তরুণীর যিনি লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন, আফ্রিদি মেরি মি?

এদের ঠিক করাই আমাদের কর্তব্য। আমরা কাকে সাপোর্ট করব কি করব না সেটা ব্যক্তিগত পছন্দ হলেও এমন কিছু করব না যাতে আমাদের দেশ, মা ও সম্মান নষ্ট হয়। এমন কোন দল বা দেশের জন্য কাঁদব না যার কারণে আমার বোন বিধবা মা সন্তানহারা হন, পিতা লাঞ্ছিত হন। এমন কোন জাতিকে মাথায় তুলবো না যে আমাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। আমাদের গোলাম বানিয়ে রাখতে চায়।

এখানে ধর্ম বিষয় নয়। যদি হতো আমরা বিশ্বকাপে আর্জন্টিনা বা ব্রাজিলের না হয়ে ইরানের জন্য মাতম করতাম। বিষয় রাজনীতির, বিষয় দেশপ্রেমের। তাই পণ্য বর্জনের মাধ্যমে আমরা তাদের জানিয়ে দেব- আমরা তোমাদের খবরদারি বা মাতবরি চাই না। যেখানে আছো সে খানে থাকো, আমাদের সামনে এসো না।

এটাই বর্জন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। পাকিস্তানের খোয়াব পাকিস্তানেই থাকুক। শ্যামল বাংলাদেশ তাকে চায় না। এটাই আমাদের ম্যাসেজ বা বার্তা। আধুনিক ও সভ্য হতে হলে পাকিদের বর্জন করার বিকল্প নেই- এ বার্তা সারাদেশ ও বিশ্বের বাংলাদেশিদের প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে যাক।

অজয় দাশগুপ্ত: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১১০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।