পাকিস্তান ‘বাংলাদেশ’ নামক ভূ-খণ্ডের মালিক না হতে পারলেও স্বার্থক তারা, তাদের আন্দোলন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর একাত্তরে হয়তো দেশ অর্জন করেছে স্বাধীনতা কিন্তু সেইসঙ্গে এ দেশে হিংসা-বিদ্বেষ, মিথ্যা, লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, প্রতারণা ও লুট-লাম্পট্যের যে বীজ বপন করে গিয়েছিলো তা এই ৪১ বছরে আমাদেরই কারো কারো সহযোগিতায় পরিপক্কতা পেয়ে পরিণত হয়েছে বিশাল মহীরূহে।
অথচ এই বীজরূপী মহীরূহগুলো বেড়ে উঠেছে বাংলার আলো, বাতাস, পানি ও মাটির রূপ, রং, রস ও গন্ধ শুষেই। যে দৃঢ়তা নিয়ে আমার বাংলা বলি আমরা, একই দৃঢ়তায় আমাদের মা, মাটি, দেশ নিয়ে কুৎসা, মিথ্যা প্রচারণা ও প্রাণঘাতি সব কর্মকাণ্ড করতে পিছপা হয় না তারা।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, যারা এটা করে তাদের সকলেই কিন্তু আমাদের পরিচিত, স্বজন। কেবল মগজে-মননে চিন্তার ভিন্নতা। কারণ তারা মানুষরূপী পরজীবী।
এখন তারা আরো বেশি উদ্ধত, আরো বেশি সহিংস। এখন তারা প্রকাশ্যেই নিজেদের পরিচয় জানান দেয়। অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে স্বজনদের সামনেই চিৎকার করে বলে ‘পাকিস্তানের জয় হো’। ভাই, ভাতিজা, প্রতিবেশী, মা, বোনের জান-মাল নিয়ে খেলতে দ্বিধা করে না এতটুকুও। অথচ এদের অনেকের বয়স ২৪ বছরও না!! পাকিস্তানি সেনারা এদেশ দখলের পায়তাঁরা করেছিলো ৪০ বছর আগে। তাহলে এই ২৪ বছর বয়সীরা এলো কোত্থেকে?
আমরা যারা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, তারা কেউ সরাসরি যুদ্ধ করেছি, কেউ যারা যুদ্ধ করেছে তাদের কাছে শুনেছি, কেউ বীর যোদ্ধার সন্তানের সন্তান। বয়সের পার্থক্যটা এখানেই। যুদ্ধের সেই ভয়াবতা নিজের চোখে না দেখলেও তা আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে গভীর থেকে গভীরে। আমরাও কেঁদে উঠি যখন কোনো মাকে কাঁদতে দেখি। যখন কোনো পিতাকে কেউ কষ্ট দেয়, সে কষ্ট ফিরে এসে আমাদের বুকেও বেঁধে সেল হয়ে!
যখন কোন বোন বা ভাই আহত হন, সে রক্ত কেবল তাদের শরীর থেকেই ঝড়ে না, আমাদের শরীর থেকেও শেষ হতে থাকে বিন্দু বিন্দু। তাই এক পরিবারে জন্ম না নিয়েও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা একই পরিবারভুক্ত। একে অপরের একেবারেই কাছের কেউ। এই বিশ্বাসটা আমার! এই বিশ্বাসটাই আমাদের সেতুবন্ধন।
অন্যদিকে, যারা পাকিস্তানীদের দোসর হয়ে একাত্তরে কাজ করেছিলো, কিন্তু ‘বাংলাদেশ’ নামক ভূ-খণ্ডটা তাদের হাতে তুলে দিতে পারেনি, হেরে যাওয়ার গ্লানি নিয়ে তারাও বেঁচে আছেন এই বাংলার মাটিতেই। যারা বাংলার মা-বোনকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুড় তুলেছিলেন, কিংবা বাংলাদেশের বিজয় মিছিল দেখে যারা ঢুকড়ে কেঁদেছেন, আজো কাঁদেন, এই দেশে আছেন তাদের সন্তানেরাও।
তারাও নিশ্চয় তাদের সন্তান-শুভাকাঙ্খী-সুহৃদ-স্বজনদেরচোখে কেবল অখন্ড পাকিস্তানেরই স্বপ্ন বোনেন!! তাইতো, বাংলার আলো, বাতাস, মাটি, পানি, রূপ, রস, গন্ধ মেখে বেড়ে উঠলেও চিন্তা-চেতনা-মননে-মানসিকতায় তারা পাকিস্তানি। তাইতো এদেশের মানুষ, সম্পদ ধ্বংস করতে একটুও দ্বিধা করেন না।
এটা আসলেই বোধের ব্যাপার, পারিবারিক মূল্যবোধের ব্যাপার। আমরা গল্প শুনতে শুনতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে বেড়ে উঠেছি আর তারা বড় হয়েছেন, হচ্ছেন পাকিস্তানি চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে।
এক্ষেত্রে অগ্রজদেরই ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, গূরুত্বপূর্ণ পারিবারিক বেষ্টনীও। এসব থেকেই তৈরি হচ্ছে মূল্যবোধ। মা, মাটি, দেশের প্রতি মমতা-ভালোবাসার বীজ বপন করছে কেউ, আর কেউ রোপন করছে ঘৃণা-ক্রোধ-হিংসার বীজ।
সেকারণেই দেশের মোট জনগোষ্ঠীর বিরাট একটা অংশ দেশের প্রতি ঘৃণা-ক্রোধ-হিংসা নিয়ে বেড়ে উঠেছে। আর এই বেড়ে ওঠাকে সাহায্য করেছি, করছি আমরা অনেকেই। যারা কেবল মুখেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী কিন্তু অন্তরে-মননে-মানসিকতায় পাকিস্তানি চেতনায় বিশ্বাসী।
জামায়াত-শিবির বাংলাদেশ বিরোধী-এটা প্রমাণিত! এর বহু প্রমাণ তারা অতীতেও দিয়েছেন, দিচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও দেবেন-এটাই সত্য। শুরুতেই এদের দমন করাটা উচিতও ছিলো, সহজও ছিলো। কারণ সংখ্যাটা তখন অনেক কম ছিলো, হয়তো শ’খানেক বা হাজার খানেক। কিন্তু এখন নিশ্চিত করে বলা যায় যে, এ সংখ্যা কোটিরও বেশি!!
শুধু কি সংখ্যায় বেশি তারা? না, এই সময়ে নিজেদেরকে দেশি-বিদেশী শক্তির সহায়তায় ব্যক্তি থেকে সংগঠনে পরিণত করেছেন, যুক্ত করেছেন। সেই সংগঠনের শক্তি বেড়েছে বহুগুণ। যা এতদ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দলগুলো করতে পারেননি। বরং স্বার্থের প্রয়োজনে বিপরীত মানসিকতার এই সংগঠনকেও সঙ্গী করে পথ চলেছেন। দুধ-কলা দিয়ে দেশের জন্য কালসাপ পুষেছেন। সেই কালসাপ ও তাদের ছাওয়েরা এখন দংশন শুরু করেছে, ঠ্যালা সামলাও!!
স্বর্ণলতা, নয়নাভিরাম উদ্ভিদ। এর বড় বৈশিষ্ট হলো পরজীবী, এটি নিজের খাবার নিজে তৈরি করতে পারে না। খাদ্য তৈরি, বেঁচে থাকা ও বেড়ে উঠার জন্য অন্য এতটি উদ্ভিদের ওপর নির্ভর করতে হয় স্বর্ণলতাকে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, যে উদ্ভিদের ওপর ভর করে জীবন ধারণ করে সে, পরবর্তীতে যে উদ্ভিদের উপর ভর করে বেঁচে উঠলো সেই গাছেই এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, মূল গাছের আর খাদ্য আহরণের সুযোগই থাকে না, অর্থ্যাৎ মূল গাছের মৃত্যুর কারণ হয় স্বর্ণলতা। এটাই স্বর্ণলতার প্রধান বৈশিষ্ট!
জামায়াত-শিবির হলো স্বর্ণলতা গোত্রের উদ্ভিদ। যারা নিজেরা নিজেদের খাবার তৈরি করতে পারেন না। খাবার তৈরির জন্য তাদের অন্যদলগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয়। আর একবার দলে ভিড়তে পারলে সেই দল থেকেই জীবিকা ধারণ করে ও সেই দলের ওপর ভর করেই নিজেদের ইচ্ছা পূরণ করে। বিনিময়ে কিছুই দেয়না!!
* সাজেদা হক, সহকারী বার্তা সম্পাদক, বৈশাখী টেলিভিশন
বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৩
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর