আমাদের মহামান্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত হলেন আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশ সরকারের যত মন্ত্রী ছিলেন এবং আছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে সত্যবাদী। তিনি রাজনীতিবিদদের বিশেষ গুণ ‘অন্তরে এক মুখে আরেক’ এই গুণাবলী মোটেও রপ্ত করতে পারেননি।
ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. আমাদের অর্থমন্ত্রী বাংলা ভাষায় কিছু ইংরেজি শব্দ এমনভাবে ঢুকিয়ে দেবার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন যে, এগুলো যে ইংরেজদের আবিষ্কৃত শব্দ তা আর বিশ্বাস করতে মন চায় না। এই যেমন রাবিশ ও বোগাস। এই শব্দ দু’টি যেন বাংলাভাষায় আবুল মাল মুহিতের অনন্য সংযোজন।
রাবিশ ও বোগাস শব্দ দু’টি বিভিন্ন অবস্থায় কিভাবে ব্যবহার করতে হয় অর্থমন্ত্রী তা এই পাঁচ বছরে এতো এতো উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, অক্ষর জ্ঞানহীন এবং বোধহীন ব্যক্তিও শিখে গেছেন কোথায় কোথায় এই শব্দ দু’টি ব্যবহৃত হয়। কিছু ভালো লাগছে না, বলে দিন ‘রাবিশ’। কারো কথা বিশ্বাস হচ্ছে না, বলে দিন ‘বোগাস’।
গ্রামীণ ব্যাংক, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, নোবেল কমিটি, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক যে রাবিশ ও বোগাস তা অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকেই আমরা জেনেছি। আমরা শিখে গেছি যে, মতের বিরুদ্ধে গেলেই অর্থমন্ত্রীর ন্যায় অবলীলায় বলতে হয়, ‘রাবিশ, অল আর বোগাস। ’
আবুল মাল মুহিত যখনই অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন, তখনই কেন জানি শেয়ার বাজার বড্ড দুষ্টু হয়ে যায়। এই দুষ্টু, অবাধ্য শেয়ার বাজার যখনই ধসে পড়ে, তখনই অর্থমন্ত্রীর মুখ থেকে রাবিশ ও বোগাস শব্দ দু’টি নিসৃত হয়। একবার তো তিনি বলে বসলেন যে, শেয়ার মার্কেটে কোন ইনভেস্টর নাই, সব জুয়াড়ি। অথচ নির্বাচনী হলফনামায় উল্লেখিত সম্পদের হিসাব থেকে জানা যায় যে, জুয়াড়িদের শেয়ার বাজার থেকেই নাকি তার আয় আসে। নিজেকে জুয়াড়ি পর্যায়ে নামানোর এই কৃতিত্ব একমাত্র আমাদের মহান অর্থমন্ত্রীরই আছে বটে!
বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে? কোনো সমস্যা নেই। অর্থমন্ত্রীর কাছে এই সমস্যার চটজলদি সমাধান আছে। তিনি বলেছেন, একদিন বাজারে না গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কাজেই অর্থমন্ত্রীর দেয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বাজারে একদিন যাবেন না, দেখবেন জিনিসপত্রও কিনতে হবে না। কাজেই দাম বাড়ল কি কমল এ নিয়ে মাথা ঘামানোরও দরকার পড়বে না। মাথা ব্যথা? মাথা কেটে ফেলুন। ব্যস না থাকলো মাথা, না থাকলো ব্যথা। সুন্দর সমাধান, তাই না?
তবে পদ্মাসেতু যে বিদেশি অর্থায়ন ছাড়া সম্ভব নয়, তা কিন্তু আমাদের দূরদর্শী অর্থমন্ত্রী অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলেন। তাই তো দেশপ্রেমিক বহুবিধ আবুলদের ভিড়ে আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মুহিত ঠিক ঠিক বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসার দিকে পথ চেয়ে বসেছিলেন। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের ন্যায় মধুলোভী চীন, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, ইন্ডিয়া সবাইকে পদ্মাপ্রকল্প থেকে দূরে হটিয়ে রেখেছিলেন।
বিজয় দিবসে স্মৃতিসৌধে না যাওয়ায় ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূতের আচরণকে বেয়াদবিতুল্য বলার সাহস কিন্তু আমাদের অর্থমন্ত্রীই রাখেন। এ কারণেই তো আমরা তার সেই অমর প্রবাদতুল্য বাণী পেয়েছি, ‘দিস ইজ বেয়াদবি, এক্কেবারে বেয়াদবি’।
তবে ড. ইউনূসের নোবেল পাওয়ায় নিজের এতো এতো যোগ্যতা থাকা সত্বেও অর্থমন্ত্রীকে নোবেল না দেয়ায় অর্থমন্ত্রীর চরম রাগ দুর্নীতিগ্রস্ত(?) ইউনূসের উপর থাকলেও হলমার্ক কেলেঙ্কারির হোতা তানভীরের উপর অর্থমন্ত্রীর সদয় ভাব আসলে তার মহানুভবতারই পরিচয় বহন করে।
তাইতো তিনি আলাভোলা বেচারা(!) তানভীরের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেছিলেন, ‘তিন বা চার হাজার কোটি টাকা নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। এটা কোনো বড় অংকের অর্থ নয়। এ নিয়ে হৈচৈ করার কিছু নেই। ’
সত্যি তিনি কতই না মহান, কতই না উদার!! শুধু এই মহানুভবতার জন্যই তো তাকে ২০১৩ এরর বর্ষ সেরা মন্ত্রীর খেতাবে ভূষিত করা যেতে পারে।
তবে যদি পাঠকদের তার মহানুভবতার প্রতি বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে তবে আশা করি তার সত্যবাদিতার প্রতি কারো কোনো সন্দেহ থাকবে না। বিশ্বাস হচ্ছে না? তবে শুনুন তার সাম্প্রতিক উক্তি।
ক্ষমতায় থাকলে যে আয় বাড়া স্বাভাবিক, এই চরম সত্য কথাটি কি আগে কোনো মন্ত্রী এভাবে প্রকাশ্যে বলার সাহস করেছেন? না করেন নি। আমাদের সত্যবাদী অর্থমন্ত্রী ক্ষমতার মসনদে বসা রাজনীতিকদের অস্বাভাবিক আয়ের উত্স যে ক্ষমতা তা কতই না সুন্দর করে অনায়াসেই জানিয়ে দিলেন! তার অসংখ্য অমর বাণীর ন্যায় এই বাণীও ইতিহাসের পাতায় নিঃসন্দেহে ঠাঁই করে নেবে, ‘দুনিয়ার ইতিহাস হচ্ছে, যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের আয় বাড়ে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ’
এখন আপনারাই বলুন, বঙ্গদেশে রঙ্গ করার মত এহেন মহানুভব, দূরদর্শী, সত্যবাদী মন্ত্রী আছেন কি কেউ?
ড. জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
বাংলাদেশ সময়: ০৭০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৩