ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রধানমন্ত্রী দায় এড়াতে পারবেন কি?

ড. জিনিয়া জাহিদ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৩
প্রধানমন্ত্রী দায় এড়াতে পারবেন কি? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা/বাংলানিউজ ফাইল ফটো

ঢাকা: সামনে আমাদের জাতীয় নির্বাচন! নির্বাচনের নাকি আর মাত্র দিন ছয়েক বাকি! নির্বাচনের প্রধান দল সরকার পক্ষ, মানে আওয়ামী লীগ। বিপক্ষেও আছেন সরকারপক্ষ, মানে সরকারের বন্ধু জোটের কেউ।



পত্রিকা থেকেই জানতে পারলাম, ১৫০টিরও বেশি আসনে নাকি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই নেই। প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ভোট ছাড়াই তারা নির্বাচিত ঘোষিত হয়েছেন। এর অর্থ হলো জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করেই এ সব মহান ত্যাগী (!) নেতা পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে নিজেদের অর্থ-সম্পদ কয়েকশ’ গুণ বাড়ানোর লাইসেন্স অলরেডি পেয়ে গেছেন।

এই আসনগুলোতে জনতা তাদের পছন্দমত কোনো প্রার্থী নির্বাচিত করতে পারছেন না। তারা তাদের মূল্যবান ভোট প্রদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ভালো লাগুক আর না লাগুক যেহেতু অন্য কোনো প্রার্থী নেই, কাজেই সরকারের মনোনীত সেই প্রতিনিধিকেই তাদের বাধ্য হয়েই মেনে নিতে হবে! একটি গণতান্ত্রিক দেশে এই নজির আসলেই বিরল।

আমাদের বড় দু’দলের হোমরা-চোমরা রাজনীতিবিদরা সবসময়ই যেকোনো ইস্যুতে জনগণের দোহাই দিয়ে থাকেন। তারা নাকি যা করেন সব জনগণের ভালোর জন্যই করেন।

এই যে আওয়ামী লীগ নিজেরা নিজেরাই সংবিধান বদলে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক বাতিল করে দিল, তাতে কি জনমত যাচাই করা হয়েছিল??

বিরোধীদল যে এই সংবিধান পরিবর্তনে মত দিতে সংসদে আসবে না, কিংবা এলেও যে তাদের কণ্ঠ সংসদে কোনো কাজে আসবে না, এটা তো সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ খুব ভালো করেই জানতো! লোক দেখানো সংলাপের ইচ্ছের আড়ালে বিরোধীদল নির্বাচনে যাতে না আসে সেই নীল নকশাই কি আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে আঁকেনি?

‍প্রধানমন্ত্রী তনয় যে, ‘আমার কাছে তথ্য আছে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে’ বলে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলেন, সেই কথাটাই কি আওয়ামী লীগের এই নীল নকশার বহিঃপ্রকাশ নয়? ক্ষমতায় পাকাপাকি বসার জন্য আওয়ামী লীগের নীল নকশা কি আদৌ সফল হবে?

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগ এই প্রহসনের নির্বাচন দিয়ে বিরোধীদলগুলোকে সমূলে গুঁড়িয়ে দেবে। গণতান্ত্রিক তকমা টিকিয়ে মাজা ভাঙ্গা জাতীয় পার্টির কোন একটি অংশকে ডামি বিরোধী বানিয়ে দেশোদ্ধারের জন্য পাকাপোক্তভাবেই ক্ষমতার মসনদে থেকে যাবে।

আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা দরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য- এমন যুক্তির পরও কথা থেকে যায়। এর মানে এই নয় যে, তারা নিজেরা নিজেরাই ডামি নির্বাচন করবে। জনতার ভোটের তোয়াক্কা না করেই নির্বাচনের আগেই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যাবে! যদি আওয়ামী লীগ ভালো কাজ করেই থাকে তবে এত কিসের ভয় তাদের?

বিরোধীদলকে আটকে রাখার জন্য হেন কাজ নেই যা আওয়ামী লীগ করছে না। সরকারি দল হয়েও কার্যত দেশকে তারা অচল করে দিয়েছে। দূরপাল্লার গাড়ি চলতে দেয়া হচ্ছে না। বিরোধীনেত্রীর বাড়ির সামনে তার নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে এমন হাস্যকর যুক্তি দেখিয়ে ডজন ডজন পুলিশ মোতায়েন করে কার্যত তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বিরোধী নেতা-কর্মীদের ঢালাওভাবে গ্রেফতার করা হচ্ছে।

বিরোধী মতামতকে কেন আওয়ামী লীগের এত ভয়? বিরোধীদল বা সরকার বিরোধী যেকোনো আন্দোলনকে কেন যেকোনো মূল্যে ঠেকিয়ে রাখতে হবে? দেশে কি সবাই সরকার সমর্থক বলেই সরকার মনে করেন? প্রধানমন্ত্রীর পদ আ‍ঁকড়ে ধরে প্রহসনের নির্বাচন করে প্রধানমন্ত্রী সংবিধান সংবিধান করে দেশকে গৃহযুদ্ধের মুখে কি ঠেলে দেননি?

কিসের জোরে, কোন খুঁটির জোরে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে দমিয়ে এই নির্বাচন দিতে চাইছেন?

বাংলানিউজে প্রকাশিত “চায়ের কাপে ভোটের ঝড়” সংবাদগুলোতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের এই নির্বাচন নিয়ে মনের ভাব প্রকাশ পেয়েছে। এই ধারাবাহিক রিপোর্টগুলো আমাদের কাছে অনেকটা নির্বাচন নিয়ে গবেষণার জন্য জনতার মতামতের উপর করা ফিল্ড ওয়ার্ক। বেশিরভাগ খেটে খাওয়া মানুষ এই নির্বাচনে একমত নয়।

আম-জনতা সংবিধান বোঝে না। তারা ভোট দিতে চায়। তারা একদিনের জন্য হলেও রাজা হবার সুখ পেতে চায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের এই স্বৈরাচারী কায়দায় নির্বাচনে রাজনীতির সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতাহীন ব্যক্তিও হতাশ।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীপুত্র জয়, সুরঞ্জিত, মায়া, হানিফ, সাজেদা, ইনুসহ সরকার বাহিনী ইচ্ছেমত উস্কানিমূলক বাণী এখানে সেখানে দিয়ে যাচ্ছেন।  

দেশে কার্যত গৃহযুদ্ধ চলছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। কখন কার বাসায় বোমা হামলা হবে, কখন কাকে রাস্তায় পুড়িয়ে মারা হবে, এই শংকায় সবাই আতংকিত। নিরাপত্তার জন্য রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষকে দফায় দফায় থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এসব কি স্বাধীন কোনো দেশের সরকারের গণতান্ত্রিক আচরণ?

দেশের এমন পরিস্থিতে আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিতরাও রেহাই পাচ্ছে না। যাদের দায়িত্ব জনসাধারণদের নিরাপত্তা দেবার তারাই নিজেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। মানুষে মানুষে বিশ্বাস উঠে গেছে। হানাহানি ক্রমেই বেড়ে চলছে।

অথচ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ৭ দিন আগে ইশতেহার নিয়ে মহাব্যস্ত। বিতর্কিত নির্বাচনকে সামনে রেখেই ভবিষ্যতে দেশের কি কি উন্নয়ন সাধন করবেন সেই নিয়ে বাণীবর্ষণ চলছে।

কোথাও কোনো নির্বাচনের আমেজ নেই। সাজ সাজ রব নেই। সেনাবাহিনী ঘুরছে রাস্তায় মোড়ে মোড়ে। বিরোধী কোনো দল নেই। তারপরও চোরাগোপ্তা হামলা হচ্ছে, পুড়ে ছাই হচ্ছে গাড়ি, গরু। কয়লা হচ্ছে মানুষ। তবুও সংবিধান রক্ষা করতেই হবে। কেউ ভোট দিক আর না দিক সংবিধান রক্ষা করতেই হবে!!
 
নির্বাচন কোনমতেই হলেই কি সব ঠাণ্ডা হবে? এটা সরকারের ভ্রান্ত ধারণা। সহিংসতা কমানোর জন্য নির্বাচনের পরেও সর্বদাই সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রাস্তায় থেকে যাবে, তার নাম গণতন্ত্র নয়।

নিজেরাই নিজেরাই সংবিধান পরিবর্তন করে, সেই সংবিধান যেকোনো মূল্যে বাস্তবায়ন করতে নির্বাচন করার যে জেদ আর তার ফলে আজকে গৃহযুদ্ধের ন্যায় দেশের এই যে করুণ অবস্থা, এর জন্য বিরোধীদলের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীও অনেকাংশেই দায়ী।

আওয়ামী লীগের অনেক ভালো কাজের মূল্যায়ন ভবিষ্যতে হারিয়ে যাবে শুধুই এই ন্যাক্কারজনক প্রহসনের নির্বাচনের আড়ালে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর দায় এড়াতে পারবেন কি?

ড. জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

বাংলাদেশ সময়: ০৮২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।